আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাদের মোল্লার ফাঁসি কি বন্ধ্যা এক খাসি?

ঘাতক কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় অবশ্যই খুশি হয়েছি। কিন্তু সে খুশি সাথে সাথেই উবে যায়, যখন দেখি কারো ভাই অফিস থেকে ফেরাপথে জামাতের চোরাগোপ্তা হামলার ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে। আরও উবে যায়, যখন দেখি, কারো বোন ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে শিবিরের তাড়ায় আলি-গলি দৌড়ে বাড়ি ফেরে। ঘরের ভেতরে কোনো মায়ের ভীতসন্ত্রস্ত শুকনো মুখ দেখে আমারও মুখ শুকনো হয়ে যায়। পাশের বাড়ির একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবা যখন জামাত-শিবিরের প্রতিহিংসায় বাসের ভেতরে পুড়ে কয়লা হয়ে যান, তখন ফাঁসি-উৎসব পালনের আনন্দে খাসির মাংস তো দুরের কথা, সাধারণ খাবারও গলা দিয়ে নামতে চায় না।

হয়তো খুব ভীতু আমি, বিদেশের মাটির এই নিরাপদ জীবনের আবরণে আমার হয়তো আরেকটু সাহসী হওয়া দরকার ছিল। এই আবরণের আড়ালে সাহস করে খাসি না হোক ভেড়ার মাংসও খেয়েও আনন্দ করতে পারতাম। কিন্তু কী করবো, প্রতিবারই আমার মন বারবার দেশের মাটিতে উড়ে গিয়ে সব সাহস ওখানেই বিলিয়ে আসে।
স্বাধীনতার পর থেকেই দুটো রাজনৈতিক দলের কাছে দেউলিয়া হয়ে আছি আমরা। এরা নিজেদের প্রয়োজনে যখন তখন জামাতকে ডাকে।

যুদ্ধাপরাধী এই জামাতকে পালিশ মালিশ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পোক্ত করেছে এরাই। এতোটাই পোক্ত করেছে যে, জামাতের সহিংস কর্মকাণ্ডকেও প্রতিরোধ করতে তো পারছেই না, বরং নিজেদের স্বার্থে গায়ে হাত বুলিয়ে আরও বেশি তাতিয়ে দিচ্ছে। ।
অথচ আমাদের দেশে এই মুহূর্তে সবচাইতে বেশি দরকার জামাতের বিরুদ্ধে, এই দুই দলের আপোষহীন প্রতিরোধ। প্রতিদিনের পত্রপত্রিকা পড়ে ও বিভিন্ন মানুষের সাথে আলাপ করে যতটুকু জানি, দেশের সাধারণ জনগণের বেশিরভাগই জামাতকে ঘৃণা করে।

কাদের মোল্লার ফাঁসির পর জামাতের অপকর্মে তাদের প্রতি জনগণের ঘৃণা আরও বেড়েছে। যদি ফাঁসির সাফল্যের হিসেব করা হয়, তাহলে জনগণের এই চেতনাটুকুই এই সময়ে যুদ্ধাপরাধী বিচারের সবচাইতে বড়ো সাফল্য। জামাত প্রতিহত করার পথে আমাদের দুই রাজনৈতিক দলের জন্যেই এই জনচেতনা পাথেয় হতো পারতো। কিন্তু এরা শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে নিজেরাই কামড়াকামড়ি করে জনগণের পছন্দের বদলে ঘৃণাই অর্জন করছে বেশি। সময়মত সঠিক পদক্ষেপ না নিতে পারলে এই অপছন্দই একদিন এতো বেশি শক্তিশালী হয়ে দাঁড়াবে যে, জামাতকেই সমর্থন করবে দেশের মানুষ।

স্বাধীনতা থেকে শুরু করে আজ অবধি এই ধারাতেই নিজেদেরকে শক্তিশালী করেছে জামাত।
১৯৫৭ সালে কনরাড আডেনহাওয়ারের নেতৃত্ব জার্মান রাজনৈতিক দল ৫০.২ ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ডয়েচে পার্টির সাথে কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করে। চরম ডানপন্থী নাৎসিদের হাত থেকে গণতন্ত্রকে রক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে তখন দলের স্বার্থের চাইতে এগিয়ে রাখা হয়। ১৯৩১ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট আক্রান্ত করে ব্রিটেনকেও। এই সময়ে ১৯৩১ থেকে ১৯৪০ অবধি লেবার, লিবারেল ও ন্যাশনাল লিবারেল দল মিলে সরকার গঠন করে নিজেদের দলীয় স্বার্থকে পেছনে ঠেলে সে অর্থনৈতিক সংকটকে প্রতিহত করার যুদ্ধে।

যদি সে ভাবে দেখা হয়, তাহলে আমাদের দেশের এখন সবচাইতে জরুরী ইস্যু জামাতকে প্রতিহত করা। ব্রিটেন ও জার্মানির উদাহরণ খুঁজে অনেক দেশই পাওয়া যাবে, যারা এধরণের ইস্যুর প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে পরস্পরের বিরোধী দল হলেও সম্মিলিত ভাবে কাজ করেছে। আমাদের দেশের দুই প্রধান দল কি কখনোই এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে সমর্থ হবে? আমি বিশ্বাস করি না। অন্য কেউ বিশ্বাস করবে, তা ও মনে হয়না আমার। অথচ এই মুহূর্তে এটিই হতে পারতো সবচাইতে সঠিক পদক্ষেপ।

যদি হতো, তাহলে সর্বদলীয় নির্বাচনের পর এক দল বিজয়ী হলেও আরেক দলের সাথে কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করতো। দরকার হলে দুবছর পর পর দুই দলই তাদের একজনকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসাতো। দুর্বৃত্ত জামাতকে রুখতে হলে এর চাইতে ভালো কোনো পথ থাকতে পারে না। তারপর যুদ্ধবন্দীদের বিচার বা ফাঁসি হোক, জামাতের কিছু বলার সাহস থাকতো না।
এসব উদাহরণ আনলে রাজনীতি বোদ্ধারা বলবেন, কার সাথে কার তুলনা! কোথায় আমাদের গণতন্ত্র আর কোথায় ব্রিটেন, জার্মানের! কিন্তু একটু কাছাকাছিও কি যেতে পারি না আমরা? কিন্তু আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের এজাতীয় কোনো ভাবনা নেই।

এদের প্রত্যেকেই নিজদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। যে কোনো ইস্যুতেই এদের কাছে জনগণই একমাত্র সুবিধাজনক জিম্মি। এদের রাজনৈতিক ক্ষমতা জনগণের শক্তিতে নয়, পয়সা দিয়ে লালিত নিজেদের ক্যাডারের শক্তিতে। জামাতের হিংস্রতায় কেউ মরুক বা বাঁচুক, এ নিয়ে তাদের কিছু যায় আসে না। এদের কাছে জনগণ ঢাল, তলোয়ার, লাঠি, সড়কি, ক্ষুরের মতো কোনো অস্ত্র।

যুদ্ধে কিছু খোয়া গেলেও কিছু যায় আসে না। তাই এমনি এক দেশে, যে দেশের রাজনৈতিক আবহের এই চেহারা, তেমনি এক দেশে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হলে খুশী হই বটে, তারপরও জানি, এ ফাঁসি খাসীর মতোই বন্ধ্যা।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.