আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুজুরের সাথে একদিন...............



বাদশাফয়সাল স্কুল থেকে (থ্রি পড়ে) যখন মাদ্রাসা লাইনে আসি (বাবা-মা মান্নত করেছিল), তখন ক্লাস টু তে ভর্তি করায় দিল হুজুররা (কারন উর্দু আরবি কিছু পারতাম না তাই)। / আলিয়ায় যাবার আগে ৪ বছর কওমিতেই ছিলাম। আমার বন্ধু মুজ্জামিল ও সেই সময় আমার সাথে ভর্তি হল ( টূ থেকে টুয়েল্ভ ক্লাস এক সাথেই পড়েছি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে) । / দুই জন (আরোকিছু সহ) সারাদিন বাদ্রামি করতাম। তিন তলা বিশাল মসজিদের পুরটাই দৌড়াই বেড়াতাম, কলম দিয়ে ক্রিকেট খেলে বেড়াতাম আর বন্ধুদের জালায়তাম।

তখন শরির মোটা ছিল বলে সবাই চিনত আমাকে। আমার আব্বু মটর সাইকেলে সকালে দিয়ে যেত, আর এশার পর এসে নিয়ে যেত। সবাই মুটামুটী ফেস চিনতো। ক্লাস ফাইভে যখন দড়াটানা মাদ্রাসায় ছিলাম (কওমি) তখন নাসিরুল্লাহ হুজুরের সাথে আমাদের প্রথম পরিচয়। ফার্সি পড়াইতেন আমাদের, সেই রকম গঠন আর রাগ, সবাই বাঘ বলত উনাকে।

আমি আর আমার বন্ধু Muzzammil সেই রকম মাইর খাইতাম উনার কাছে (ফার্সি পারতাম না বলে)। \ কিন্তু একই সাথে আমাদের আদর ও করতেন । মনে আছে, আমাকে ক্লাস ফাইভের মাদ্রাসা বোর্ড পরিক্ষায় হুজুর নিজের ভ্যসপাই করে নিয়ে গেসিলেন পরিক্ষা কেন্দ্রে......... তার পর থেকে (২০০২) আজ প্রায় ১১ বছর তার সাথে দেখা করিনি, ভয় আর কাওমি মাদ্রাসা ছেড়ে আলীয়া আর ভার্সিটি পড়ার কারনে এক ধরনের হিনমন্যতার কারনে। জানতাম হুজুর দের মতে, যারা এইসব লাইনে ঢুকে যায়, তাদের আমল-আখলাক ঠিক থাকেনা। তাই উনারা যদি জানতে পারেন যে কোন ছেলে আলিয়ায় ট্রাই মারসে, তাকে ভর্তি করতে চান না।

করন সে নাকি নিজেতো এক সময় আবার বিদায় নেই, সাথে করে আরো ভাল ৪ জন কে নিয়ে বে্র হয় (যারা কিনা ভাল করত কাওমি লাইনে)... যাই হোক, এর পরও, এই বখে যাওয়া ছাত্রদের প্রতি তার ভালবাসা আমাদের মুগ্ধ করেছিল গতকাল সন্ধায়। প্রায় ১১ বছর পর যখন প্রথম দেখা করলাম উনার সাথে, অনেক কত্থা হল। আর তার আচরনে বার বার মুগ্ধ হচ্ছিলাম। বিশেষকরে তার ক্ষমতার আর লিঙ্কের কথা শুনে। তিনি আসলেই যশোরের বর্তমানে ক্ষমতাবানদের একজন বটে (হুজুর + নন হুজুরদের ভেতর)।

/ তাই তিনি যখন বললেন যে , কাল সকালে ৮ঃ৩০ এ আমাদের কোথাও নিয়ে যাবেন, রেডি থাকতে হবে, আমরা রাজি না হয়ে পারিনি। বিশেষ করে হুজুর যখন আব্বা আব্বা করে সম্মোধন করেন, তখন কি আর না কথা মাথায় আসে? সকালে উনি সময়মত উনার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন আর আমরা পৌছানো মাত্রই রওনা দিলেন গাজির দর্গার দিকে , ঝিকরগাছার পথে ( যেই রাস্তাকে কেন্দ্র করেই সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড লেখা ) হাজির হলাম হুজুরের একটা এতিম খানায় (তার পরিচালিত ৬-৭ টা প্রতিষ্ঠানের একটা), কুয়েতি জাকাত ফান্ডের অওতায় চলে। ৫২৪ জন এতিম ছেলে আজই ৭ দিনের শীতকালীন ছুটি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। মাদ্রাসার পথে ঢুকতে ছোট ছোট ক্রিম কালারের ইউনিফর্ম (পাঞ্জা্বি ) পরে হুজুরকে সালাম দিচ্ছে বাচ্চারা। সবার হাতি একটা ছুটির এপ্লিকেশনের কাগজ, ছুটি চেয়ে জমা দিয়ে , মা অথবা অন্যকোন আত্মিয়ের সাথে বাসায় দিকে বের হচ্ছে।

কেউ সাতক্ষীরা , কেউ ঝিকড়গাছা, কেউ এমন এমন যায়গা, যার নামও আমি শুনিনি। প্রায় সব সাইজের , সব বয়সের ছেলেই আছে এখানে। সবার মুখে খুশির ভাব। বিগত কয়েকদিন বাসায় এসে টক-শোতে মাদ্রাসাকে ধুলাই করা দেখে খুব কষ্ট পে্তাম, প্রগতিশীলদের যে ভাবনা (মাদ্রাসার ছেলেরা সবাই অসহায়, কেউ আধুনিক শিক্ষার স্বাধ পাইলে মাদ্রাসা পড়ত না ইত্যাদি ইত্যাদি) সেটার প্রকৃত জবাব এই একটা এতিম খানাই দিতে পারে মনে হল, শুধু তারা যদি একবার এসে দেখে যেত। এই মাদ্রাসার ছেলেরা প্রতিবার ১৬ ডিসেম্বর কুচকাওয়াজে প্রথম তো হয়ই, সাথে বিভিন্ন নাটকে অসাধারন অভিনয় করে, হুজুরের iphone এ আমাদের সেই সব দেখাচ্ছিলেন তার নিজের রুমে বসে বসে।

বাচ্চাদের কুচকাওয়াজের আলাদা ট্রেনিং, আলাদা ইউনিফর্ম আর জুতা আমাদের অবাক করেছিল। বিশাল এই মাদ্রাসা কাম এতিমখানা স্ট্রাকচারাল দিক থেকে যেমন সুন্দর (বিশাল বিশাল বিল্ডীং) , তেমনি পরিবেশ হিসাবে মনোরম। বন বিভাগের অধীনে বনায়ন হয়েছে সুন্দর। তিনটা পুকুর বেষ্টিত মাদ্রাসার বনায়নের উপর হুজুরের প্রধানমন্ত্রি অথবা রাষ্ট্রপ্রতি প্রাইজ নেয়ার স্বপ্নের কথা জানলাম, যখন ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন আমাদের। এক সময় আমাদের মাছ মারার বর্শি এনে দিলেন আর আমরা মাছ শুধু ধরলামই না, দুপুরে সেই স্বরপুটি মাছ ভাজি দিয়ে ভাত খাইলাম।

এখানে মাদ্রাসার ছেলেদের প্রত্যেকের একাউন্টে প্রতি মাসে ১২০০ টাকা জমা হয়,যা ১০ বছরে অনেক বড় অঙ্কের টাকা। এই পরিকল্পনায় যে, সেটা তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করবে যখন এখান থেকে বের হবে। সব ছাত্রের নির্দিষ্ট কোড আছে, আর জামার কলারে সেলাই করে নাম লেখা (যাতে জামা কার কোনটা বোঝা যায়)। / সপ্তাহে ৭ দিনের ৩ দিন গোস্ত, ২ দিন দুধকলা , একদিন মাছ, একদিন ডীম (যতদুর মনে পড়ে হুজুরের কথা) এখানে খাওয়া্নো হয়। যা রাত্রে আমার আব্বাকে যখন বলছিলাম, উনি বলে উঠলেন, “তোর মেসের চেয়েওতো ওরা ভাল খাই”।

, সত্যিই তাই। কুয়েতিদের এমন প্রতিষ্ঠান ৫৫ টা দেশে আছে, প্রতি বছর সেইসব দেশের ছাত্রদের প্রতিযোগিতা হয় কুয়েতে, বাংলাদেশি ছিলেরা অনেকবার এ সব প্রাইজ জিতে্ আসছে‌, যা বর্তমান সেকুলার মিডিয়া হুদায় কেয়ার করেনা, তো আমি জানবো কেমনে? সেখানের পালা শেষ করে হুজুর আমাদের নিয়ে যশোর টার্মিনালে আসেন, সেখানে উনি জুম্মা পড়ালেন। খুতবার আগে অসাধারন একটা বয়ান দিলেন (রাসুলের (সঃ) ভালোবাসা্র দরকারিতা আর রাগ নিয়ে ছিল পুরা আলোচনা)্‌। তারপর রওনা দিলাম তার, আরেক মাদ্রাসার দিকে, সতীকাঠিতে ( কূয়েতিদের না, তার নিজের) । , এটা বাংলাদেশের ১৬ তম মাদ্রাসা (কাওমির ভেতর)।

গ্রামের ভেতর একটা মাদ্রাসা কিভাবে এত ভাল করতে পারে, তা গিয়েই বুঝলাম। ৮ বিঘা যায়গাতে (২০ বিঘার টার্গেট) অসাধারন একটা মাদ্রাসা। সেখানে আমারা সেই মাছ (বর্শি দিয়ে ধরা) আরে মুরগি দিয়ে দুপুরের খাবার শেষ করলাম । ৩ পিস বড় মাছ আমাকে খাইতে হল ( হুজুরের পাশে বসার পরিনতিতে) । , খাওয়া প্রায় শেষ, ঠিক সেই সময় এক শিক্ষকের সাথে হুজুরের রুমে এক পিচ্চি ঢুকে বলতে লাগল, সে বড় হুজুরকে দেখতে এসেছে (২-৩ বছর বয়স মনে হল পিচ্চির)্‌ হুজুরের সামনে এসে চুপ করে দাড়াল, হুজুর ও রসিক মানুষ, দুষ্টূমি শুরুকরে দিলেন।

সেই বাচ্চা অবাক করে দিয়ে আরবীতে তার শরিরের সব অংগের নাম বলতে লাগল , যখন হুজুর একটা একটা করে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। অসাধারন লাগল, আসলেই সে ভাগ্যবা্ন , অসাধারন পরিবেশ পাচ্ছে গড়ে ওঠার (ওর ববা মাদ্রাসার ইয়াং হুজুর) । /হুজুরের সাথে একদিন...............আমি নিজেই যেসব জানিনা (নাম, দুয়া), সেসব সেই পিচ্চি আরবিতে বলতে লাগল, মুসাফা, মুয়ানাকার সময় কি বলে, তা করে এবং বলে দেখালো। খাওয়ার সময় হুজুর একটা ছেলেকে দেখিয়ে বললেন , সে গত ৪ বছর ধরে এখানে আছে, বাড়ী যায়না। কারন , তার পরিবা্র তাকে কলেজে দিয়েছিল, কিন্তু তার ভাল লাগেনি, তাই পালিয়ে চলে এসেছে এখানে।

তখন আমার ওইসব টক-শো গুলার টকারদের কথা মনে হতে লাগল, আর হাসি আসতে লাগলো, যারাকিনা আধুনিক শিক্ষার জাতিয় দালাল হয়ে পড়েছে (মাদ্রাসা শিক্ষার বিরোধিতায়)। সারাদিন হুজুরের সাথে থাকার পর একটাই আফসোস হতে লাগল, কেন যে আজ ক্যমেরাটা নিলাম না , অন্য আজে বাজে যায়গায় ঠিকই নিয়ে যায়, আজকেই শুধু বাদ দিলাম .........অসাধারন কিছু মুহুর্তকে ধরে রাখতে পারতাম। হাসান -হোসেন নামের সেই দুই ভাইয়ের ছবে নিতাম (আপন ভাই) , যারা শিশু শ্রেনির ক্রিকেটে দুই দলের দুই ক্যপ্টেন, যদিও শেষমেশ হাসানের ভাগ্যেই ট্রফিটা গিয়েছে নাকি। ছবি নিতাম ওই ছেলেটার হুজুর যাকে পানি বিশেষজ্ঞ বলেন, যে মাদ্রাসার পানির মেশিন চালায় (খাবার পানির), যে মাছে কেচ ভরে দেয়া থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত ছিল আমাদের সাথে। ওই সব ছাত্রের ( পরের মাদ্রাসার) যারা মাছ কুটতেছিল(আমাদের ধরা) অসাধারন দক্ষতা্র সাথে ।

গ্রামের শোভা বর্ধনকারী মাদ্রাসা বিল্ডিংগুলার কথা নাই বাদই দিলাম। বিকালে ফিরে আসার পর, আছরের নামাজ পড়লাম দড়াটানা মাদ্রাসায়। এর আগে আবার ২৫ তারিখে ঝিনাইদাহ (হুজুরের আরেক প্রতিষ্ঠা্নে) যাবার দাওয়াত পাইলাম। নামাজের পর হুজুর নিয়ে গেলেন যশোরের মেয়রের বাড়ী। সেখানে চা নাস্তা করানোর পর, নিয়ে গেলেন এক চশমার দোকানে (মসজিদের সাথে দোকান), হুজুরদের পেপে পার্টিতে (পেপে খাওয়ালেন), তার পর বিদায় দিলেন, শুধু বিদায় না, এই মাত্র কল দিয়ে (রাতে) জেন নিলেন বসায় আসলাম কিনা,কি করতেসি এইসব।

মজার বিষয় হল, হুজুর ওই কুয়েতি সংস্থার অধীনে নাকি ২৭০ টা মসজিদ বানিয়েছেন(যতটূকু মনে পড়ে), আর ১৭৫ জোড়া গনবিবাহ দিয়েছেন (যৌতুক বিহীন)। , এই শুক্রবারে ২০ জোড়া বিয়ে হবার কথা ছিল, প্যন্ডেল সহ সব দেখলাম রেডী, কলমা পড়ানো আছে, শুধু অবরোধের কারনে হচ্ছেনা। বিয়েতে ৪৯ রকম আইটেম দেয়া হয় বর-কণেকে (মুটামুটি সংসারের যাযা লাগে, সব থাকে)। , দুই পক্ষের ১০ জন করে থাকতে পারে। আগামি শুক্রবারে সৌভাগ্য থা্কলে অভিজ্ঞতা হতে পারে সেই বিয়ে দখার।

যদিও মুজ্জাম্মিলের জন্য হুজুর কে বলে রেখেছি , যেন ওর বিয়ে দিয়ে দেয় এরকম এক প্রোগ্রামে ( ). সেই থেকে মুজ্জামিল আমার উপর খেপে আছে এখনও। অবাক লাগছিল, হুজুর যখনই কারো সাথে আমার পরিচয় করায়, বলে আমি ঢাবিতে পড়ী আর আমেরিকা ঘুরে এসেছি। বলার সাথেই লোকগুল আমার দিকে তাকাতে থাকে, কি জানি , আমাকে কি ভেবে বসেছে...আফটারঅল, তাদের মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যের কারনে আমেরিকার ইমেজ এখনো ভাল না । কারন, মুস্লিমরা তো একটা দেহের মত, তার শরীরের যেই খানেই আঘাত লাগুক, অন্যখানে কষ্ট অনুভব তো হবেই। তাই কি স্বাভাবিক না? সবমিলে সেই রকম একটা দিন গেল, শুধু দেশের অবস্থাটা ভাল নেই বলে অনন্দের যায়গাটা পূর্ন হয়েও যেন বার বার বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে।

হাসলেও, আনন্দ থাকছেনা।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.