আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রতিভার কোন দেশ নাই, কুসংস্কারেরও তাই



কে বলে কুসংস্কার অশিক্ষিত, পশ্চাৎপদ, দুর্বল মানুষের অসহায় আত্মসমর্পন ছাড়া আর কিছুই না? প্রায় এক দশক ধরে একই পোশাক পড়া, রাস্তার কোন এক নির্দিষ্ট পাশ ধরে চলাচল, কোন একটি নির্দিষ্ট রঙের প্রতি বিরাগ বা অনুরাগ অথবা বিশেষ কোন আচার নিষ্ঠা যে নামেই অভিহিত করা হোক তালিকা করতে গেলে বাদ যাবে না পৃথিবীর সবচেয়ে বাস্তববাদী, সবচেয়ে বিজ্ঞানমনা কোন দেশও। এর কোন বিশেষ ব্যাখ্যা থাকতে পারে আবার হতে পারে ব্যক্তিবিশেষের শ্রেফ মানসিক সান্তনা, কিন্তু কুসংস্কার কিংবা অদ্ভুত বা অস্বাভাবিক আচরণ যাই বলি না কেন ফুটবলে এটা আছে সত্য, ছিল এবং কিছুটা সংশয় রেখেই বলা যায় ভবিষ্যতেও থাকবে।

পল দ্য অক্টোপাস
আরেকটি বিশ্বকাপ দুয়ারে। ২০১০ বিশ্বকাপে পল-এর কীর্তি ফুটবলপ্রেমীদের এত শীঘ্রই ভুলে যাবার কথা নয়। ফুটবল মাঠ থেকে সী লাইফ সেন্টারের ভৌত দূরত্ব যাই হোক না কেন ভিন্ন জগতের এই বাসিন্দার কথা ফুটবল ইতিহাসে অমর হয়েই থাকবে।

মাত্রই আড়াই বছরের ”পেশাদার” জীবনে পল মূলত জার্মানির জাতীয় দলের খেলা আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোর ভবিষ্যৎবাণী করেছে এবং ১৩ ম্যাচে ১১টি সঠিক ভবিষ্যৎবাণীতে তার সাফল্যের হার শতকরা ৮৫ শতাংশ! একেবারে জন্মের প্রথম বছরেই ২০০৮ সালের ইউরো থেকেই তার সাফল্য গাথার শুরু। তবে তার বিশ্বজোড়া খ্যাতি চুড়ান্তরূপ লাভ করে ২০১০ বিশ্বকাপেই। এমনকি চাইলে বলা যেতেই পারে স্পেনের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ে পলের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ! ২০১০ বিশ্বকাপের মাস তিনেক পরেই মহাপ্রয়াণ ঘটে এই কীর্তিমানের।
পল-এর ”অতিমানবীয়” কোন ক্ষমতা ছিল কিনা কে জানে তবে তা ছুয়ে গিয়েছিল সারা বিশ্বের তথাকথিত আধুনিক, বিজ্ঞানমস্ক সহ সকল মানব-মানবীকেই। তবে সু-সংস্কার বা কুসংস্কার যাই বলি না কেন, অক্টোপাস পলের মতো এতটা সার্বজনীন না হলেও ব্যাক্তিগত বা দলগত পর্যায়ের ফুটবলে এই বিশ্বাস অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে হয়তো থাকবে ভবিষ্যতেও।



গ্যারি লিনেকার
কিংবদন্তীর ইংলিশ স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকার দীর্ঘদিন ছিলেন স্প্যানিশ লীগে হ্যিিট্রক করা একমাত্র ইংলিশ খেলোয়াড়। ১৬ বছর এবং প্রায় ৬০০ ম্যাচের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে লাল কার্ড তো দূরের কথা কখনও হলুদ কার্ড বা রেফারি কর্তৃক সতর্কিতও হননি এই ইংলিশ। এই বিরল অর্জন সম্ববপর হয়েছে তার অসাধারণ জীবনাচারনের জন্যে। তবে ফুটবলের বিশুদ্ধতম খেলোয়াড়ের খেতাবের পাশাপাশি তার অপর একটি জীবনাচারণ তাকে দিয়েছে অন্যতম কুসংস্কারাচ্ছন্ন খেলোয়াড়ের তকমা। লিনেকার ওয়ার্ম-আপ বা অন্য কোন ধরনের অগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে কখনোই গোলে শট নিতেন না।

লিনেকারের অন্ধ বিশ্বাস ছিল তার ভাগ্যে বরাদ্দকৃত মোট গোলের সংখ্যা সীমিত। যদি তিনি গা-গরমের ম্যাচেই তার সেই সীমিত বরাদ্দ থেকে গোল করে ফেলেন তাহলে টান পড়ে যাবে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের গোল সংখ্যায়!

পেলে
ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তী পেলে একবার তার জার্সি এক ভক্তকে উপহার দিয়ে দেন। দুর্ভাগ্যক্রমে এর পর পরই পেলে ফর্মহীনতায় ভুগতে থাকেন। পেলে তার এক বন্ধুকে দায়িত্বদেন যেখান থেকে পারা যায় সেই ভক্তকে খুজে বের করে তাঁর সেই জার্সি ফিরিয়ে আনতে। সপ্তাহ খানেকের চেষ্টার পর বন্ধুটি পেলেকে সেই জার্সিটি ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হন এবং পেলেও ফিরে পান তার হারানো ছন্দ।


বন্ধুটি যে কথাটি পেলেকে তখন বলতে পারেননি তা হলো, তিনি সেই ভক্তটিকে খুজে বের করতে পারেননি এবং একই রকম দেখতে আরেকটি শার্ট পেলেকে ফেরত দেন। ভাগ্যিস বন্ধুটি সেদিন মিথ্যে বলেছিলেন কালো মানিকের কাছে। নইতো ফুটবলের ইতিহাসই হয়তো হতো অন্যরকম।

ববি মুর
আরেক ইংরেজ কিংবদন্তী ববি মুরের আবার ছিল অন্য বাতিক। মাঠে নামার আগে ড্রেসিং রুমে সবার পরে শর্টস পরতেন তিনি।

তার বিশ্বাস ছিল এটা তার মাঠের খেলায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তার টিমমেট মার্টিন পিটারস অবশ্য বাগে পেলে ছাড়তেন না মুরকে। যখনই মুর সবার শেষে তার শর্টসটা পড়ে নিতেন পিটার তখন খুলে ফেলতেন তার নিজেরটা। যাতে করে মুর সর্বশেষ হতে না পারেন। বলা বাহুল্য মুরও ’লাস্ট’ হবার জন্য বাধ্য হতেন নিজের শর্টস আবার খুলতে।



জন টেরি
সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক এবং চেলসি সেন্টার-ব্যাক জন টেরি মাঠের সৌভাগ্যের প্রত্যাশায় সবসময় টিম বাসের একই সিটে বসেন, প্যাডের চারিদিকে তিনবার করে টেপ আটেন, অনুশীলনে যাবার সময় গাড়িতে একই গান শুনে থাকেন এবং গাড়িটি পার্কের একই জায়গাতেই পার্ক করে থাকেন। এমনকি বার্সেলোনার সাথে চ্যাম্পিয়নস লীগের একটি ফিরতি ম্যাচে হারিয়ে ফেলার আগে একই শীন প্যাড ১০ বছর ধরে ব্যবহার করেছেন! এই ২৯ বছর বয়সী বর্তমানে তার চেলসি সতীর্থ ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড-এর কাছ থেকে ধার করা একজোড়া ”লাকি” প্যাড ব্যবহার করছেন।

সার্জিও গয়কোচোচিয়া
অনেকের মতেই গোল-কিপাররা একটু খ্যাপাটে হয়ে থাকেন। যেমন আইরিশ আন্তর্জাতিক গোলরক্ষক শেই গিভেন খেলা চলাকালীন এক শিশি ”পবিত্র পানি” তার গোল পোস্টের পাশে রেখে দিতেন। তার পূর্বসুরী প্যাকি বোনারও জন্মস্থানের একমুঠো মাটি রেখে দিতেন তার গ্লাব ব্যাগে।

তবে খ্যাপমোর চুরান্ত পরিণতি দিয়েছিলেন বিখ্যাত আর্জেন্টাইন গোলকিপার সার্জিও গয়কোচোচিয়া। সার্জিও পেনাল্টি শট ঠেকানোর জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। আর এ পেনাল্টি ঠেকাতে গিয়েই তিনি জন্ম দেন ফুটবলের বিখ্যাত এবং অদ্ভুত কুসংস্কার গুলোর একটির।
প্রতিটি পেনাল্টি শুট-আউটের পূর্বেই গয়কোচিয়া পিচে মূত্রত্যাগ করতেন! তার ভাষ্যমতে, ”আপনারা জানেন যে খেলাটির নিয়ম অনুসারে ম্যাচ শেষ হবার আগে আপনি মাঠ ত্যাগ করতে পারেন না। এবং আপনার যদি কোন ’জরুরি মানবিক তাড়া’ থাকে, তবে আপনাকে মাঠের পাশেই কাজ সারতে হবে।

ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটেছিল যুগস্লোভিয়ার বিপক্ষে (১৯৯০ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে)। খেলার শেষদিকে আমার সত্যিই প্রচন্ড চাপ ছিল এবং মাঠের পাশেই এটা করা ছাড়া আমার কোন গতিও ছিল না। এবং আমরা জিতে গেলাম। তাই সেমিতে ইতালির সাথে ম্যাচও যখন পেনাল্টিতে গেল আমি আবারও একই কাজ করলাম--এবং এটা আবারও কাজে দিল! এর পর থেকে আমি প্রতি শুট-আউটেই এটা করতাম। এটা ছিল আমার সাফল্যের মূলমন্ত্র!”

রোমিও আনকন্তানি
বিপদে লবন ছিটানো বেশ পুরনো কুসংস্কার।

তাই বলে ফুটবল মাঠে? তাও আবার ২৬ কেজি? ঠিক এ কাজটিই করেছিলেন সাবেক পিসা প্রেসিডেন্ট রোমিও আনকন্তানি। প্রতিটি ম্যাচের আগে রোমিও নিজ মাঠ অ্যারেনা গ্যারিবল্ডিতে ইচ্ছেমতো লবন ছিটাতেন। এতে নাকি সব বাধা দূর হয়ে ম্যাচ জয়ের পথ সুগম হতো! যত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ তত বেশী লবণ। তো একবার নগর প্রতিদ্বন্দী সেসেনার সাথে মহাগুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচের আগে আনকন্তানি ২৬ কেজি পর্যন্ত লবণ ছিটানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মাঠের অবস্থা যেন ফুটবল খেলার চেয়ে স্কী খেলার জন্যেই বেশী উপযোগী হয়েছিল!

মিডল্যান্ড পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট
নিজের বা দলের ভাগ্যের শিকে ছিড়তে অনেকেই অনেক কিছুই করে থাকেন।

জিম্বাবুয়ের ক্লাব মিডল্যান্ড পোর্টল্যান্ড সিমেন্টও দলের ম্যানেমমেন্টও মঙ্গলই চেয়েছিলেন নিশ্চই। দলের মাঝে লুকিয়ে থাকা ”অশুভ আত্মা” ধুয়ে ফেলার জন্য পুরো স্কোয়াডকে তারা নামিয়ে দেন ভিক্টরিয়া জলপ্রপাতের নিকট জাম্বেজি নদীতে। ক্লাব কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করেই এমটি করেছিলেন নাকি ভুলে গিয়েছিলেন কে জানে তারা বেমালুম উপেক্ষা করেছিলেন তীব্র স্রোত এবং জলহস্তী আর কুমিরে পরিপূর্ণ এ নদীতে সাঁতারের উপর নিষেধাজ্ঞার কথা। ফলও পেয়েছিলেন হাতেনাতেই, ১৬ জন গিয়েছিলেন নদীতে, ফিরেছিলেন ১৫ জন। অশুভ আত্মা দূর করতে গিয়ে তারা হারিয়ে ফেলেছিলেন জলজ্যান্ত এক খেলোয়াড়কেই।



এ্যালান কর্ক
১৯৯২-৯৩ মৌসুমে শেফিন্ড ইউনাইটেডের স্টাইকার এ্যালান কর্ক করলেন এক কঠিন পণ। শেফিল্ড ইউনাইটেড এফএ কাপ থেকে বাদ না পড়া পর্যন্ত তিনি আর শেভ করবেন না। এমনিতে শেফিল্ড ইউনাইটেড এর জন্য এটা এমন কোন কঠিন কাজ নয়। তবে সে বছর হিসেব পাল্টে গিয়েছিল। শেফিল্ড ওয়েন্সডে’র সাথে ওয়েম্বলির সেমি-ফাইনাল ডার্বির ম্যাচে যখন তিনি খেলতে নামেন তখন তার ফাকা মাথার তুলনায় ঢের বেশী দৃশ্যমান ছিল শ্মশ্র“রাজি।

এবং কোন পেশাদার ফুটবলারের চেয়ে তাকে বরং মনে হচ্ছিল কোন কোচ বা রেফারি বা এই গোছের কেউ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.