আমার ছোট্ট খাটটির পাশে বেশ কয়েকটি বই পরে রয়েছে ক'দিন হল। বুদ্ধদেব বসুর 'শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ', রমিলা থাপার এর 'ভারতবর্ষের ইতিহাস', হাসানের 'চালচিত্রের খুঁটিনাটি', মওলানা আবুল কালাম আজাদের 'ভারত স্বাধীন হল'- এইসব বইগুলি আমার বিছানার পাশে বেশ একটা ঢিবির আকৃতি নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তবে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে, কিছুতেই বই পড়ায় মনোনিবেশ করা যাচ্ছেনা। একটি বইয়ের কিছু অংশ পড়ি তো আরেকটি বইয়ে হাত দিই। মনে শান্তি না থাকলে যা হয়!
পাঁচ পাঁচটি বছর কেটে গেল এই ইটালিয়ান পেনিনসুলায়।
কত বিচিত্র, বর্ণীল মানুষের সাথে পরিচয় হল। কতশত জায়গায় যাওয়া হল। কত শত বাঙালি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন পুরো দেশটা জুরে। যেখানেই গেছি, সেখানেই বাঙালির সন্ধান মিলেছে। সেইযে শুরুর দিকে বারিতে দেখা ফুল হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এক অর্ধবয়স্ক বাঙালি।
রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছি, আমাকে দেখে কেমন আড়ষ্ট একটা ভাব তাঁর, করবেন না তাঁর ফুল বিক্রি আমার কাছে। উপহার দিয়েছিলেন একটি লাল টকটকে গোলাপ! মনে পড়ছে এই বোলোনিয়ার পাহাড়ে দেখা আনিসের সাথে। ১৮ বছরের এক বালক। কত শত পথ পেরিয়ে, বাধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে, কখনও ডিঙ্গি নৌকো, কখনও বা গাড়ির পেছনে মাথা লুকিয়ে এসে পরেছে ইটালির দক্ষিনে। চোখ মেলতেই দেখেছে পুলিসের চোখরাঙ্গানি।
ঘুরতে ঘুরতে এসে আশ্রয় পেয়েছে এই শহরের এক সরকারি আশ্রমে। আবার একজন রাজ্জাক কে দেখেছি জেনোয়ায়। জেনোয়াতে গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে ফোনের ক্রেডিট শেষ করেছি যেই, সেইমাত্র সন্ধান পেয়েছি এক বাংলা ফোনের দোকানের। সেখানে অচেনা রাজ্জাক আমার দশ মিনিট খরচ করা ফোনের টাকা নিলেননা তো নিলেনইনা। কত জোর করলাম, তাও কাজ হলনা।
গারদা লেক দেখতে গিয়ে এক সুন্দরীকে দেখেছি লেকের ধারে বই পড়তে। কাছে এসে ছবি তুলতে চাই বলতেই রাজি হয়ে গেলো। সেদিন আকাশ ভরা মেঘ, বৃষ্টি বুঝি নেমে আসবে এখুনি! মায়াবতীকে দেখে মনে হয়েছিল যেন কতদিনের চেনা! ও কি আমার মতই দুদণ্ড আশ্রয় চেয়েছিল এই শহরে?
পাঁচ বছরের খানিক বেশিই হয়ে গেল এই ইটালি থাকা। এখানে একে একে অণু এল, আনন্দ আপা এল, ঝুমা এল, কৌশিক এল, কৌস্তুভ এল, সবশেষে এল বাঁধনরা। ওদের সবার হাত ধরে হেঁটেছি ইটালির পথে পথে।
সচলে লিখতে শুরু করলাম এখানে এসেই। লিখতে না লিখতেই সচলের সূত্রে দেখা হয়ে গেল সমমনা এক ঝাঁক তরুণের। মিঠু ভাই, জিল্লুর ভাই, মুরাদ ভাই, রিমন, শিপলু ভাই, সাথী ভাবী, শিল্পী ভাবী। সবাই মিলে এখানেও গড়ে তোলা হল এক সংগঠন। দেশে গণজাগরণ মঞ্চ হচ্ছে, সেটা ঘিরে এখানেও ব্যাপক উত্তেজনা, আশার আলো।
এই আকাংখাকে কেন্দ্র করে দেখতে দেখতে এখানেও কিভাবে জানি একটা পাঠাগারও আমরা নির্মাণ করে ফেললাম। এই পাঠাগারে বই দিতে প্যারিস থেকে ছুটে এল সজীব, এ যেন কল্পনাকেও হার মানায়!
এই পাঁচ বছরে নানান ছুটি ছাটায় কাজের ফাঁকে ইটালির পথে পথে ছুটেছি অনেক, ঘুরেছি অনেক। বড় বড় জাদুঘরে ঢোকার জন্য উন্মুখ হয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এখানেই আমি আমার মত করে আবিষ্কার করতে চেয়েছি বের্নিনিকে, কারাভাজ্জোকে। আল্পস পর্বতের ধার থেকে ভিসুভিয়াসের কোল পর্যন্ত ছুটে গিয়েছি। বোলোনিয়ার হারিয়ে যাওয়া রেশম শিল্পের গল্প জেনেছি, দান্তের কবরে গিয়ে তাঁর মৃতদেহ নিয়ে রাভেনা এবং ফ্লোরেন্স নগরীর দীর্ঘদিনের টানাপড়েনের গল্প শুনেছি! রাভেনায় যিশুর প্রথম মোজাইকের পোর্ট্রেট দেখেছি, জেনোয়ার মুল গির্জার বাইরে এক সিংহ মূর্তির রূপ দেখে বিস্মিত হয়েছি, ভেনিসে সারাদিন টোটো করে ঘুরে বেলাশেষের ট্রেন মিস করে সারারাত ঠাণ্ডায় কাতর হয়ে রেলস্টেশনে ঘুমিয়েছি! শুধু রোম দেখব বলে কত বিনিদ্র রজনী গেছে, মিলানের কেন্দ্রীয় গির্জা কিংবা নেপোলির সমুদ্র তীরের দুর্গ দেখে অভিভূত হয়েছি।
বুট সদৃশ এই ইটালির হিলস্বরূপ সালেন্তো যেমন গিয়েছি তেমনি দেখেছি এর পায়ের পাতার সদৃশ শহর রেজ্জো ক্যালাব্রিয়া। ত্রেন্তোর পাহাড়, পাদোভায় জত্তোর কীর্তি, গারদা লেকের টলটলে জল, ভেরোনায় জুলিয়েটের বাড়ি, বারির বেতের ঝুড়ি, কাতানিয়ার সিরামিক, মুরানোর গ্লাস, পম্পেইয়ের ভস্ম, পালেরমোর বোটানিক্যাল গার্ডেন, মদেনার ভিনেগার, আপেনিনো পাহাড়ের ধার ঘেঁষে গাড়িতে করে ছুটে চলা- এমনি কতশত ছোটবড় স্মৃতি মনের কোণায় ভিড় করছে আজ!
এখন বড়দিনের উৎসব চলছে। দুই সপ্তাহের অখণ্ড অবসর। অনেক কিছু লেখা বাকি। রাহুল দেব বর্মণকে নিয়ে একটি ধারাবাহিক লেখার কাজে হাত দিয়েছিলাম।
প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্তের অভাবে তা এগুচ্ছেনা। বের্নিনিকে নিয়ে লেখারও সেই একই হাল। কি করি কি করি। মনটা ছটফট করছে দুইদিন হল। দেশের পরিস্থিতিও ভাল নয়।
হঠাৎ মনে হল, কিছু ছবি রয়েছে ইটালির। সেগুলি খানিক বিনিময় করা যেতে পারে। এই বিনিময় করে যদি মনে খানিক শান্তি পাওয়া যায়!
১) গারদা লেকের ধারে বইপড়ুয়া সেই মেয়েটি
২) পাখির চোখে দেখা ভেরোনা নগরী
৩) নেপোলির দুর্গ
৪) পম্পেইয়ের ভস্ম থেকে জেগে ওঠা শহর
৫) বোলোনিয়ার পাহাড়ে
৬) অপূর্ব ফ্লোরেন্স নগরী
৭) পিসার হেলানো দালান
৮) প্রাতোর গির্জায় দোনাতেল্লোর অপরূপ শিল্পকর্ম।
৯) রাভেনায় মোজাইকের ওপর আঁকানো প্রথম যিশুর আত্মপ্রতিকৃতি
১০) রোম শহরের জৌলুস
১১) মিলান রেলস্টেশন
১২) পাহাড় থেকে দেখা কুয়াশামাখা তুরিন নগরী
১৩) চিনকুয়ে তেররে কিংবা পঞ্চগ্রামের এক গ্রাম!
১৪) সালেন্তো শহরের সমুদ্রে নীল রঙের আভা
১৫) পালেরমো কিংবা সিসিলিতে ভোর হয় হয়
১৬) রেজ্জ ক্যালাব্রিয়ায় সাগর ধারে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ
১৭) পাদুয়ায় বিয়ে
১৮) জেনোয়ার সিংহ মূর্তি
১৯) তুসকানি রাজ্যের আরেক শহর সিয়েনা
২০) জেনোয়ার অপূর্ব প্রকৃতি
২১) মদেনা শহরে বেলা শেষের এক চিলতে রোদ্দুর
২২) ভেনিসে সন্ধ্যা
২৩) বোলোনিয়া শহরের এক আর্টশপ
২৪) ফ্লোরেন্স শহরে মুক্তিযোদ্ধার হাতে ছাগু নিধন!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।