‘লাউড’ নয় ‘আন্ডারটোন’ অভিনয়ের জন্য খ্যাত এই অভিনেতা সত্তর ও আশির দশকের হিন্দি সিনেমার দর্শকদের মনে চির জাগরুক হয়ে থাকবেন। কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিনেতা হিসেবে যেমন তেমনি পার্শ্ব চরিত্রের অভিনেতা হিসেবেও তিনি ছিলেন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।
দর্শকের নিশ্চয়ই মনে আছে ‘উমরাও জান’ সিনেমায় রেখার বিপরীতে তরুণ প্রেমিক নবাব সাহেবের কথা কিংবা মৈত্রেয়ী দেবীর গল্প অবলম্বনে ‘একপল’ সিনেমায় শাবানা আজমির বিপরীতে খামখেয়ালি তরুণ জিৎ বড়ুয়ার কথা।
ফারুখ শেখের কথা বললেই মনে পড়ে ‘তুমহারি অমৃতা’র কথা। ১৯৪৭ এর দেশবিভাগের পর বিছিন্ন প্রেমিক-প্রেমিকার পরস্পরকে দীর্ঘসময় ধরে লেখা চিঠির শ্রুতি নাটক ‘তুমহারি অমৃতা’।
ফিরোজ আব্বাস খানের পরিচালনায় প্রেমিকা শাবানা আজমি আর প্রেমিক ফারুক শেখের অনবদ্য কণ্ঠ অভিনয়ে এই অসামান্য মঞ্চ প্রযোজনা দর্শক স্মরণে চিরস্থায়ী থাকবে। ঢাকার দর্শকদের মনে থাকতে পারে নব্বই দশকে ব্রিটিশ কাউন্সিলে ‘তুমহারি অমৃতা’র পরিবেশনা।
১৯৯২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘তুমহারি অমৃতা’র মঞ্চায়ন হয়। দর্শকের বিপুল ভালোবাসাও পান ফারুক শেখ ও শাবানা আজমি।
২০০৪ সালে ‘তুমহারি অমৃতা’র একটি সিকুয়েল হয় ‘আপকি সোনিয়া’ নামে।
এতে মূল চরিত্রে ফারুক শেখের বিপরীতে ছিলেন সোনালি বেন্দ্রে।
২০১২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘তুমহারি অমৃতা’র বিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠিত হয়।
ভারতের বরোদায় ১৯৪৮ সালের ২৫ মার্চ ফারুক শেখের জন্ম। বাবা মুস্তফা শেখ ছিলেন মুম্বাইয়ের আইনজীবী। মায়ের নাম ফরিদা শেখ।
গুজরাটের বরোদায় বরেলি শহরের কাছে এক জমিদারবাড়িতে ছিল তাদের পারিবারিক আবাস। ধনাঢ্য জমিদার পরিবারের সন্তান হওয়ায় বেশ বিলাসিতার মধ্যেই কাটে তার শৈশব-কৈশোর। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তিনি মুম্বাইয়ের সেইন্ট মেরি স্কুল এবং সেইন্ট জেভিয়ারস কলেজে লেখাপড়া করেন। সিদ্ধার্থ আইন কলেজে তিনি আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন।
নয় বছর প্রেমের পর বিয়ে করেন রূপা জৈনকে। এই দম্পতির দুই কন্যা শায়েস্তা ও সানা।
ফারুক শেখের অভিনয় জীবন শুরু হয় মঞ্চে। এর পর সত্তর দশকের শুরুতেই বলিউডে প্রবেশ করেন। ১৯৭৩ সালে আর্টফিল্ম ‘গরম হাওয়া’-তে প্রধান অভিনেতা বলরাজ সাহানির সঙ্গে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
সিকান্দার মির্জা চরিত্রে তার অভিনয় দর্শক ও সমালোচকদের নজর কেড়ে নেয়।
এরপর ভিন্নধারার চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান অভিনেতা হয়ে ওঠেন তিনি। নাসিরুদ্দিন শাহ, ফারুক শেখ, কুলভূষণ খারবান্দা, শাবানা আজমি, স্মিতা পাতিল, দীপ্তি নাভাল ছিলেন সে সময়ের অবাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী। লখনৌর শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহর জীবনীভিত্তিক ১৯৭৭ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ সিনেমায় ‘আকিল’ চরিত্রে ফারুক শেখের অনবদ্য অভিনয় তাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতি এনে দেয়।
বলিউডি ক্ল্যাসিক ‘উমরাও জান’ চলচ্চিত্রে তিনি খ্যাতিমান নর্তকি উমরাও জানের প্রেমিক নবাব সুলতানের চরিত্রে অভিনয় করেন।
বাণিজ্যিকধারার চলচ্চিত্রেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার অভিনীত ‘নুরি’ (১৯৭৯), ‘চাশমে বদ্দুর’(১৯৮১) ‘কিসিসে না ক্যাহেনা’, ‘বিবি হো তো অ্যায়সা’ বক্স অফিসে সফলতা পায়। দীপ্তি নাভালের সঙ্গে তার জুটি জনপ্রিয়তা পায় কমেডি মুভি কিসিসে না ক্যাহে না’র মাধ্যমে। তার অভিনীত আরও কয়েকটি দর্শক নন্দিত চলচ্চিত্র হল ‘বাজার’, ‘কথা’, ‘আঞ্জুমান’ ইত্যাদি।
বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে তার ইমেজ ছিল হাসিখুশি অভিজাত ভালোমানুষ চরিত্রে।
কমেডিতে তিনি ছিলেন দর্শকপ্রিয়। তবে আশির দশকের মারদাঙ্গা ছবিগুলোতে তিনি ছিলেন বেমানান। তাই বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে কিছুটা সরিয়েই আনেন তিনি। তবে অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘তুফান’, শাহরুখ খান অভিনীত ‘মায়া মেমসাব’ এর মতো কয়েকটি বক্সঅফিসে ব্যর্থ সিনেমায় পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছেন। ইয়াশ চোপড়ার ‘ফাসলে’ সিনেমায় তিনি পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতা হিসেবেও নজর কাড়েন।
চা বাগানের পটভূমিতে নির্মিত ‘এক পল’ সিনেমায় তিনি ছিলেন দ্বিতীয় নায়ক। শাবানা আজমির দায়িত্ব জ্ঞানহীন খামখেয়ালি প্রেমিক ছিলেন ফারুক শেখ আর সহানুভূতিশীল ক্ষমাপ্রবণ স্বামীর ভূমিকায় নাসরুদ্দিন শাহ। তিন প্রতিভার অনন্য অভিনয়ে সিনেমাটি সমালোকদের ব্যাপক প্রশংসা পায়।
সত্যজিৎ রায়, মুজাফফর আলি, হৃষিকেশ মুখার্জি, কেতন মেহতা, ইয়াশ চোপড়ার মতো ভারতের নামজাদা পরিচালক-নির্মতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন ফারুক শেখ। চলচ্চিত্রে আবার তিনি ফিরে আসেন ২০০৮ সালে ‘সাস বহু আউর সেনসেক্স’ সিনেমার মাধ্যমে।
২০১০ সালে তিনি ‘লাহোর’(২০০৯) সিনেমায় পার্শ্বচরিত্রে সেরা অভিনয়ের জন্য ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করেন। চলতি বছর রণবীর কাপুর ও দীপিকা পাড়ুকোন অভিনীত ইয়ে জাওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি সিনেমায় রণবীরের বাবার ভূমিকায় অভিনয় করেন ফারুক শেখ। তার অভিনীত সর্বশেষ সিনেমা ছিল চলতি বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ক্লাব সিক্সটি’।
ফারুক শেখ কমেডি টিভি সিরিয়াল ‘চমৎকার’সহ বেশ কয়েকটি সিরিয়ালে অভিনয় করেছেন এবং দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছেন। নব্বই দশক ও নতুন শতাব্দীর দর্শকদের কাছে তার জনপ্রিয়তা ছিল মূলত টিভি অভিনেতা হিসেবে।
সেলিব্রেটিদের নিয়ে নির্মিত টিভি শো ‘জিনা ইসিকা নাম হ্যায়’-তে তার সাবলীল উপস্থাপনা টিভি দর্শকদের কাছে তাকে তুমুল জনপ্রিয় করে তোলে।
ফারুক শেখ দুবাইতে সপরিবারে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন। সেখানে হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। ২৮ ডিসেম্বর মুম্বাইয়ের রশিদ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ফারুক শেখ।
‘অভিজাত ভদ্রলোক’ ইমেজের এই প্রতিভাবান অভিনেতা যখন চলচ্চিত্রে নতুনভাবে ফিরে এসেছিলেন সে সময় তার প্রয়াণ দর্শকের জন্য বেদনাবহ নিঃসন্দেহে।
চলচ্চিত্রে তার আরও অনেক কিছু দেওয়ার ছিল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।