আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বঙ্গোপসাগরের দিনলিপি


২৭ ডিসেম্বর, ২০১৩, শুক্রবার
ল্যাটিচিউড ২১ ডিগ্রী ০১ মিনিট নর্থ, লংগিচিউড ৯১ ডিগ্রী ২০ মিনিট ইস্ট
শীতের সন্ধ্যা ছয়টায় কুচকুচে আঁধারে বিশ্বচরাচর ডুবে থাকার কথা, কিন্তু জানালা দিয়ে মৃদু মন উদাস করা আলো ঢুঁকে কিছুটা হলেও শীতের ভীতিকর আঁধারকে দূরে রেখেছে চারপাশ থেকে। পায়ের নিচে পৃথিবী দুলছে, কাঁপছে আপন উল্লাসে নীল দরিয়া, আমাদের হাতের মুঠোয় নিয়ে। বঙ্গোপসাগরের কোন এক কোণে আমাদের জাহাজ, গন্তব্য নেই। আসলেই গন্তব্য নেই, বিরামহীন ভাবে লাবিবা নামের জাহাজখানা চলছে লোনা দরিয়া দিয়ে আগামী ৩০ দিন, রূপোলী ফসল হচ্ছে তার একমাত্র লক্ষ্য, ২০০ টন মাছ আহরণ করে তারপর সে তীরে ফিরবে, ফাঁকতালে আমরা কজনা অতিথি হয়েছি বিশেষ একটু জায়গায় নজর বোলাবার জন্য যা বিখ্যাত সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড নামে।

ভোরে যাত্রা শুরু হয়েছে, একা জাগা দাঁড়কাক আর কুয়াশায় প্রায় হারিয়ে যাওয়া শালিখের দলের সাথে বিদায় নিয়ে চট্টগ্রাম সদরঘাট থেকে ডিঙ্গি চেপে আশা হয়েছিল আমাদের আগামী এক সপ্তাহের আস্তানা এই জাহাজে, মূলত প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের তিন জন সদস্য ভিডিও তথ্যচিত্র সংগ্রহ এবং গবেষণার কাজের চলেছেন বঙ্গোপসাগরের, তাদের আমন্ত্রণের অতিথি হিসেবে পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হকের সাথে যোগ দিয়েছি আমিও।

কোন অহেতুক ঝুঁকি না নিয়ে ডিঙ্গিতে আরোহণের আগেই বিশেষ ধরনের পানিরোধক ব্যাগে ক্যামেরাগুলো বস্তাবন্দী করে নদীর অল্প অংশটুকু পেরিয়ে সোজা জাহাজে আমরা, ঘন কুয়াশাময় বন্দরে তখন ফ্লাইং ডাচম্যান ধরনের ভুতুড়ে অবয়বের জলযানের ভিড়, সূর্যদেবের দেখা দেবার পাত্তাও নেই মেঘের আস্তরণ ফুঁড়ে, এমনকি জাহাজের ক্যাপ্টেনও হাজির হন নি জাহাজের পাটাতনে। শোনা গেলে কুয়াশাময় ঝুঁকিপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে অপেক্ষা করা হবে পথ কিছুটা দৃশ্যমান হওয়া পর্যন্ত, সেই জন্য দরকার হলে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে !

বেশ বড় ধরনের মাছ ধরার ট্রলার লাবিবা, প্রায় ৪০ জন্য কর্মী এখানে কাজ করবে দিবা-রাত্র। প্রতি চার ঘণ্টা পর পর বিশাল জাল খানা তোলা হবে সমুদ্র থেকে, তাতে অবস্থা ভেদে থাকে এক টন থেকে ৮ টন মাছ থাকে, যখন জাহাজটির হিমাগারের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ২০০ টান মাছ ধরা হয়ে যাবে তখন তারা তীরের দিকে ফেরা শুরু করবে। সাধারণত এই কাজে ৩০ দিন সময় লাগে, এবং এই সময়ে ইঞ্জিন সচল থাকবে সর্বদাই।

ক্যাপ্টেন এসে গেছেন, আবহাওয়াও আগের চেয়ে কিছুটা নমনীয়, এমতাবস্থায় শুরু হল আমাদের যাত্রা।

এবং বিদায় দিতে হল কাক ও ভুবন চিলের মত ডাঙ্গার সখাদের, গাংচিলের দল এসকর্ট করে নিয়ে চলল জলরাজ্যে গভীর থেকে গভীরে। জাহাজের দল পিছু পড়ে গেল, চলে গেল ন্যাভাল অ্যাকাডেমী, শুধু অসীম জলের বিস্তার, আমরা খুঁজব এখানে পাখি, ডলফিন, তিমিদের আর জাহাজের মানুষেরা খুঁজবেন মাছের ঝাঁক।


তারপর বেশ কঘণ্টা হয়ে গেল, বিস্তর চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা সকলেই সাগরের দুলুনির সাথে অভ্যস্ত হতে , যাতে সী-সিকনেসে আক্রান্ত হয়ে এত চমৎকার ভ্রমণটা শুরুর আগেই শেষ না হয়ে যায়।
( সম্পূর্ণ লেখাটিই জাহাজে বসে লেখা, দুলুনির মাঝে থেকেই, অনেকটা রোজনামচার মত, তাই হয়ত তাল কেটে যেতে পারে, দিক ভুল হতে পারে, কিন্তু আবেগটা ছিল নিখাঁদ- সাগরে ভাসার আনন্দ, নতুন পাখি আবিস্কারের রোমাঞ্চ, নাবিক সাজার মজা, আকাশ ভরা তারা আলোয় ভেজার স্নিগ্ধতা , সবই একসাথে আছর করেছিল যে !)

(মৃত এক জোড়া হাতুড়িমাথা হাঙর )
২৮ ডিসেম্বর, শনিবার
ভোর ৪-১৫
ঘুম ভাঙল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, নাকি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েই ঘুম ভাঙল! যেভাবেই হোক, ঘুম ভেঙ্গেছে আজব এক মৃদু দুলুনিতে আর শরীরের বর্জ্য তরলের বাহির হবার তাগিদে , সম্বিত ফিরে পেতেই সেই ঘুটঘুটে আঁধারে বুঝলাম জাহাজেই আছি যখন, জলের দুলুনিতে এমন হতেই পারে ! ঘরের সবাই ঘুমিয়ে, খানিক পরেই নিজেকে আবিস্কার করলাম আঁধার বঙ্গোপসাগরের মাঝে, পায়ের নিচে চলন্ত ফেনিল সাগর কেঁপে কেঁপে উঠছে, মাথার উপরে নক্ষত্রের চাঁদোয়া, মুখে লোনা বাতাসের ঝাঁপটা, কী এক অপূর্ব সুখানুভূতি! যদিও পুরোপুরি একাকী ছিলাম না, আকাশের পানে তাকাতেই জ্বলজ্বলে লুব্ধক নক্ষত্র সাথী হল নৌবিহারের, তাকে অনুসরণ করেই এল কালপুরুষ, তার উল্টো পাশে সপ্তর্ষি। এমন সাগর বিহারে নিয়েই কী জীবনানন্দ লিখেছিলেন- নিশীথের অন্ধকারে সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে !

(হাতুড়িমাথা হাঙরের চোখ)
টাটকা বাতাসের পাগলামোতে ঘুম রেশের কেটে দূর দিগন্তে চলে গেল,জাহাজের ক্যাপ্টেনের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে জানা গেল পরের বার জাল তোলা হবে ভোর সোয়া পাঁচটায়।

বিছানার উষ্ণতায় ফিরে সময় নষ্ট না করে আগের দিন চট্টগ্রামে সংগ্রহ করা লাবণ্য দাশের লেখা মানুষ জীবনানন্দ পড়া শুরু করলাম। শুরু থেকেই কেমন কেঠো ভাষায় লেখা বইটা, একজন অতি সংবেদনশীল মানুষের সাথে বিশটি বছর একত্রে কাটাবার পর এমন স্মৃতিকথা দুঃখ জাগায় বইকি।

জাল তোলার হাঁকডাকে মাস্তুলের কাছে ক্যামেরা বাগিয়ে দাঁড়ালাম, বিশাল জাল, ২৭৫ মিটার লম্বা দড়ির সাথে বাঁধা, সিন্ধু সেঁচে রূপোলী ফসলের গাঁদি তুলে আনছে ক্ষুধার্ত মানুষের আহার এবং বিলাসী মানুষের বিলাসের জোগান দিতে। এ যাত্রা তেমন কিছু মাছ আসে নি, তারপরও ১ টনের উপরে তো বটেই- তার মাঝে আছে বেশ বড় আকারের স্টিং রে, ভেবেছিলাম তাজা প্রাণীটার আপন জগতে ফিরবার একটা ব্যবস্থা করতে পারব, কিন্তু শুনি তার নাকি বেশ চাহিদা ডাঙ্গার বাজারে, তাই প্যাকেটজাত হতেই হবে, আর সব মাছের মতই।

অধিকাংশ মাছই ছিল সার্ডিন জাতীয়, যাকে এখানে জেলেরা বলে কলম্বো, শ্রীলঙ্কার আশপাশ থেকেই নাকি মাছগুলো এদিকে আসে এমন কথা প্রচলিত বিধায় এমন নাম।

জেলেভাইরা যেন বিশাল জাল দিয়েই সাগর থেকে তুলে আনলেন প্রকাণ্ড সূর্যটাও, অদৃশ্য সাগর আসতে আসতে দৃশ্যমান হয়ে উঠল রাঙ্গা আবীরে নেয়ে, জাহাজের সামনের ডেকে দাঁড়ানো একাকী নিজেকে কেন যেন লর্ড অফ দ্য রিংসের কোন এক চরিত্রের মত মনে হচ্ছে, চলেছি ল্যান্ড অফ মর্ডরের অজানা রাজ্যে, সঙ্গী কেবল অভিযানের রোমাঞ্চ, নতুন পৃথিবী দেখার পিপাসা।



(সী কই হাতে এক জেলেভাই)
পরের বার জাল টানা হল সকাল ১১টায়, জালের সাথে লাগানো ফাৎনা ধরনের জিনিসগুলো দেখেই স্বয়ং ক্যাপ্টেন বলে উঠলেন- অনেক মাছ মনে হচ্ছে ! সেই একবারেই ১২ টন মাছ উঠল, মাছে মাছে সয়লাব হয়ে গেল ডেক, আর সেই লোভে হাজির হল মাছখেকো পাখির দল। নানা ধরনের মাছের স্তুপ থেকে তাদের আলাদা আলাদা করে, ধুয়ে প্যাকেট করে হিমাগারে রাখতে রাখতেই গেল দেড় ঘণ্টার মত,

যদিও তার আগেই জাহাজের বাবুর্চিসাহেব আমাদের বোনাস নাস্তা হিসেবে নিয়ে আসলেন সদ্য ধরা রূপচাঁদা মাছ ভাজা, কত বছর পর যে টাটকা রূপচাঁদা খেলাম! পুরাই অমৃত, মাখনের মত গলে যাওয়া মাছ মশলা প্রায় কিছুই ছিল না। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে যেই না বলেছি- দুপুরে খাওয়া লাগবে না এমন জম্পেশ প্রায় মধ্যাহ্নভোজনের পরে, ক্যাপ্টেন ঠা ঠা হেসে বললেন- দরিয়ার বাতাসের ক্ষিদে লাগে ঘনঘন, দুপুরের খাবারের এখনো দুই ঘণ্টা বাকি, তার আগেই দেখবেন পেট চুঁইচুঁই করছে।

(স্কুইড ও কাটল ফিশ )
এত মাছ একবারে পাওয়াতে সবাই খুব খুশী হল বটে, কিন্তু মুশকিলও দেখা দিল অন্য দিক থেকে,কারণ সিদ্ধান্ত হল সেখানেই বাকি সারা দিন এবং দিবাগত রাত মাছ মারা হবে! ফলে সোয়াচ যাত্রা পিছালো আরও এক দিন, একই অঞ্চলে ক্রমাগত ঘুরপাক খাবার ফলে নতুন কোন পাখিও মিলল না, সারা দিন সেই ২ ধরনের গাঙচিলের ঝাঁক আর সাঁঝের আগে এক পানচিল।

তারপরও উথাল-পাথাল সাগরে অন্যজীবনের স্বাদ সর্বক্ষণই মনে এনে দিচ্ছে রোমাঞ্চ।

ক্ষুদের এক দাগি আবাবিল ( Striated Swallow) এসে আশ্রয় নিল হতক্লান্ত অবস্থায় জাহাজে, সাগরের বাতাসের পালকের পাল তুলে যাবে সে পেরিয়ে মহাদেশ, কিন্তু এখন সময় একটু জিরানোর।

ইনাম ভাই তাকে আবিস্কার করে মহানন্দে আলাপের চেষ্টাও চালালেন, তাকে ছোঁয়া হল, ঘিরে বসল ফটোগ্রাফারের দল, বিরক্ত হয়ে সে অবশ্য অন্য প্রান্তে যেয়ে বসেছিল পরে, দু দন্ড শান্তির আশায়।

২৯ ডিসেম্বর, রবিবার
মধ্যরাত, জাল তোলা হচ্ছে, মহা সমারোহে অপেক্ষা করছি, এযাত্রা দেখেই সটান ঘুম দিব। সমুদ্রের মায়া কাটিয়ে পরাস্ত জাল উপরে উঠাতেই বোঝা গেল মাছ এসেছে খুবই কম, আধা টনও হবে না।

কিন্তু চকচকে রূপোলী স্তূপের মাঝে পিচ্ছিল কালো বর্ণের একটা খোলা মত কী যেন দেখা গেল, মুহূর্তের মাঝে যা পরিণত হল বিশ্বের সবচেয়ে আদুরে প্রাণীদের একটিতে- বিশাল এক অলিভ রিডলে কচ্ছপ!


ডাইনোসরদের চেয়েও অনেক প্রাচীন বংশলতিকার নিরীহ প্রাণীটি আটকা পড়েছে। বুড়ো মানুষের মত মাথা নেড়ে মানুষের বোকামোতে ক্ষোভ প্রকাশ করল কিউট প্রাণীটা, উল্লেখ্য মাছের জালের ধরা পড়লে যদি আধা ঘণ্টার মাঝে না তোলা হয়ত তাহলে অনেক কচ্ছপ অক্সিজেনের অভাবে সেখানেই মারা যায়, এভাবেই বিশ্বে এখনো লক্ষ লক্ষ কচ্ছপ মারা যাচ্ছে অপরিকল্পিত মাছ ধরার জন্য।



পিছলে পড়ার শতভাগ সম্ভাবনা নিয়েও তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নিচের ডেকে ছুটলাম কাছিমটাকে কাছ থেকে দেখে ক্যামেরাবন্দি করার আশায়, কিন্তু দেখি সহযাত্রী ভিডিওগ্রাহক বেলাল ভাই সামুদ্রিক কাছিম ফেলে কী এক মাছ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল, যে কিনা ডেকে তড়পাচ্ছে তিড়িং বিড়িং করে, বেশ বড় আকারের মাছে, সোনালী আঁশ এই আলোতে চকচক করছে । কিন্তু সেটাকে এত গুরুত্ব দেবার আছেটা কী, স্বয়ং কূর্ম অবতারের উপস্থিতি সত্বেও? কারণ মাছটি ছিল- ইলিশ ! জীবন্ত ইলিশ আর আগেও দেখেছি, কিন্তু এত সজীব, স্বর্ণাভ হতে পারে তা জানতাম না, তার প্রতি আঁশে যেন মহাসমুদ্রের নানা প্রান্তরের গল্প প্রতিফলিত হচ্ছে। সেই স্মৃতি নিয়েই ঘুমোতে গেলাম উত্তাল সাগরে।



সকাল আটটায় সহকারী ইঞ্জিনিয়ারের উদ্বাহু চিৎকারে ঘুম ভাঙল - তিমি তিমি! বিছানা থেকে গড়ান দিতেই ক্যামেরা হাতে ছুটলাম সামনের ডেকের রেলিঙয়ে, জানা গেল একটা তিমি জাহাজের খানিক দূরেই ভুস করে তার দর্শন দিয়ে আমাদের যাত্রাকে কৃতার্থ করেছেন। কিন্তু এখন সে লাপাত্তা! কোন জাতের তিমি, কত বড় আকৃতির, কী বর্ণ কিছুই জানা গেল না, শুধু শুনলাম তার সৃষ্ট ফোয়ারার কথা। তবুও অন্তত জানা গেল যে উনি বা উনারা আমাদের উপস্থিতির খবর জানেন, আবারও আশা আছে পুনদর্শনের।
সেদিন সকালের জালের রেকর্ড ১৮ টন মাছ উঠল, এত বেশী মাছ বিধায় মূল জালকে চার বার আলাদা আলাদা পুটুলি করে তুলতে হল, যদিও ক্যাপ্টেন জানালেন তার রেকর্ড আছে ১০ বার আলাদা পুটুলি করে একবারের মাছ উত্তোলন করা।




দুপুর ১২টায় জাল তোলার পরে দূরে ধবধবে সাদা কী যেন একটা ভাসতে দেখে নৌকা ঘুরাতেই এক বিষণ্ণ সাগরের জন্ম হল, যাতে আলগোছে তালে তালে দুলছে একটি মৃত ডলফিন, দেখে মনে হচ্ছে সদ্য মৃত মানুষের লাশ।

কোন রাগ নেই, ক্ষোভ নেই, অভিমান নেই, শুধু আছে এক না থাকা অস্তিত্ব। সম্ভবত মাছ ধরার জালে আটকা পরেই সলীল সমাধি হয়েছে অসাধারণ আমুদে প্রাণীটার, জলের নিচে নির্দিষ্ট কয়েক মিনিটের বেশী থাকলে অন্য যে কোন স্তন্যপায়ী প্রাণীর যা হয়, সেই একই করুণ পরিণতি ঘটেছে তার ক্ষেত্রেও। অনেক সময় জেলেরাও পিটিয়ে মারে ডলফিনদের, অযাচিত আপদ ভেবে। কেন, কে জানে!

সেই দিন সন্ধ্যায় অন্য ধরনের জাল ফেলা হল, যেগুলো সাগর সেঁচে তলদেশের মাছ নিয়ে আসবে। রাত ৮ সেই অন্য জাল তোলা শুরু হতেই প্রথমে আরেকটা কাছিম দেখা গেল, বেঁচে আছে তখনো ।



নানা ধরনের মাছ আসল এবার, যা আগের বারের গুলোতে আসে নাই, মন খারাপ করে দিয়ে উঠে আসল ২টা মৃত হাঙর, ছোট্ট ছোট্ট, হাত খানেকের মত লম্বা। বিশ্বে প্রতি বছর একশ কোটি হাঙর মারা পড়ে মানুষের কারণে, তারই একটা বাস্তবদৃশ্য দেখা গেল চোখের সামনে।



জাল তোলার পরপরই খাবার পালা, সেদিন পাতে বিশেষ আয়োজন ছিল সোনালী ইলিশের ঝোল। অদ্ভুত তৃপ্তিকর সেই স্বাদ, টাটকা মাছের গন্ধের সাথে নোনা বাতাসের কারণে তৈরি ক্ষিদে, একেবারে মানিকজোড়। তরিবৎ করে কবজি ডুবিয়ে খাওয়া হল সদলবলে।

রাতে পড়া শুরু হল টিনটিনের মমির অভিশাপ।

(পোটকা মাছ)
৩০ ডিসেম্বর, সোমবার
সকাল সাড়ে নয়টায় সুনীল সাগরের পিঠ ভেদ করে ছুটে গেল কী এক পোকা ! কয়েক মিটার যেয়ে আবার সাৎ করে সেঁধিয়ে গেল, উল্লাসে চিৎকার উঠলাম – উড়ুক্কু মাছ, ফ্লাইং ফিশ! কিন্তু বার দুই দেখা দিয়েই সে মনে হয় দিক পরিবর্তন করে চলে গেল জাত ভাইদের দলে যোগ দিতে, ফ্রেমবন্দী করার সুযোগ মিলল না , আশা করি আবার দেখা হবে উড়ুক্কু বন্ধুর সাথে।

সকাল ১১ টায় তিমি দেখা গেছে বলে জানাল প্রতিবেশী জাহাজ, সেই মোতাবেক সাগরের ঐ অঞ্চলটাতে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি চলল বটে, যদিও সেই মহাজনের দর্শন তো মিললই না, জালে মাছও উঠল কম। যদিও তাতে আমাদের খানাদানার কোন টান নেই, স্রেফ চিবানোর জন্য নাস্তা আর মধ্যাহ্ন ভোজনের মাঝামাঝি সময়ে মিলল রূপচাঁদা ভাজা, সাথে যোগ দিয়ে ক্যাপ্টেন রেজা তার অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে সাগরের নানা গল্প শোনালেন, বিশেষ করে ঝড়ের পড়ে সমুদ্রে কয়েকদিন ভাসতে থাকা এক কিশোরকে কেমন করে উদ্ধার করে চট্টগ্রামে নিয়ে গেলেন সেই অভিজ্ঞতা মন ছুঁয়ে গেল সবার।

সাগরে গেলে মনটা কেমন যেন হয়ে যায়, ফাঁকা ফাঁকা লাগে, তরঙ্গের সাথে সাথে হৃদয়ে গান আসে, উদ্বাহু সুরে গাইতে থাকি যখন যেটা মনে ভেসে ওঠে সেইটা, বাউলা বাতাসের জাদুতে, আউলা চুলে-

৩১ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার
মধ্যদিনে যে জাল তোলা হল তাতে অন্যান্য মাছের সাথে বেশ কিছু মৃত হাঙর, কাটল ফিশ, স্কুইড যোগ দিল।

তিন গোয়েন্দার অথৈ সাগর পড়ে জেনেছিলাম স্কুইডের কালি বেশী ঘন হয়, আক্রান্ত হলে এই কালি ছিটিয়ে স্কুইড আত্মরক্ষার কাজ সারে, সেই কালি দিয়ে নাকি এক নাবিক লগ-বুক লিখেছিলেন একবার। এবার বঙ্গোপসাগরে দেখলাম কাটলফিশের কালি, সেও বেশ ঘন, যদিও লেখার সুযোগ না নিয়ে সেটাকে সাগরে ফিরে যেতে সাহায্য করলাম, যতই কালি ছিটাক, এমন রোদ সহ্য করা এই বেচারার নরম থলথলে দেহের কাজ না।


আর কত বিচিত্র ধরনের জেলিফিশ যে দেখা গেল, কতগুলো তো কাঁচের মত স্বচ্ছ ! এপার থেকে ওপার ভেদ করে সব দেখা যায় !

এমনকি তাদের ভিতরে থাকা শিকারও-

দুপুর ৩টায় যাত্রাপথে যুক্ত হল স্মরণীয় মুহূর্ত, জাহাজের পাশ দিয়েই তীর বেগে উড়ে গেল এক কালো পাখি, তার পিছু পিছু ধাওয়া করল আমাদের দৃষ্টি, অবশ্যই দূরবীনের মাধ্যমে। অন্য অনেক মহাসামুদ্রিক পাখির মতই সেও জাহাজের পিছনে জলের ঘূর্ণনের পথটা মাছের সন্ধানে একবার দেখে আবার ফিরে আসল পূর্বনির্ধারিত যাত্রাপথে, পাশের ডেক থেকেই শুনি ইনাম ভাইয়ের উল্লাস ভরা কণ্ঠ Thats the Bird, Thats the Bird ! অবশেষে সাগরের ভাসার এতগুলো দিন পরে দর্শন পেলাম পোমরাইন জেগারের ( Pomorine Skua ), ভীম দর্শন পাখিটি আমাদের প্রাপ্তির আনন্দে মুড়ে আবার উড়াল দিল দূর গন্তব্যে। জীবনে প্রথম দেখা মিলল এই বিরল পাখির, এর আগে বাংলাদেশে এই ছবি ছিল মাত্র দুইজনের।



বিকেল ৪টায় স্পেশাল স্কুইড ভাজা চলে আসল টেবিলে, বেশ ঝাল ঝাল করে রাঁধা। স্কুইডের অনুরোধ করায় হেঁসেলের ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন ভাই যত্ন করে রান্না করেছিলেন, যদিও ঝাল বিধায় মুড়ি দিয়ে মাখিয়ে চিবোতে হল। আমরা তখন সুন্দরবনের সমুদ্র এলাকায় চলে গেছি।


বছরের শেষ সূর্যাস্ত চলে আসল দেখতে দেখতে, জন্ম হচ্ছে নতুন রাতের। এবারের নববর্ষকে অন্যভাবেই স্বাগত জানাচ্ছি আমরা, বিশেষ কোন আয়োজন ছাড়াই।

এই প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন বললেন, কারাগারেও টাকা খরচ করলে অনেক কিছু মেলা সম্ভব, কিন্তু জাহাজে না! কারাগারের চেয়েও খারাপ এই কৃত্রিম দ্বীপ!

১ জানুয়ারি, বুধবার
সকাল ৬ টা নতুন বছরের প্রথম সূর্য দেখার আনন্দে ডেকে আড়মোড়া ভাঙলাম, মনের মধ্যে ভাবনারা তুফান মেলেছে এই বছরের শত শত পরিকল্পনা নিয়ে। কিছু বাস্তবে রূপ নিবে কিছু কল্পনা থেকে যাবে, আবার আসবে নতুন বছর, স্বপ্নবাজরা চষে বেড়াব এই নীল গ্রহ, স্বপ্ন মাখা চোখে।

সকাল ৭ টায় সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত জেগার (স্কুয়া) আবার হাজির মাছ খাবার জন্য, এবার সেই বেশ কিছুক্ষণ সঙ্গী হয়েই থাকলে জাহাজের, এমনকি জলে বসলও ! সেদিন অবশ্য পরে একসাথে ৪ টা পাখিও আমরা দেখেছিলাম, মানে তাদের সংখ্যা বেশ ভালই আছে মানুষের থেকে দূরে এই কূলকিনারাহীন সাগরে।

সকাল ১০টায় জাল তোলা হল, সেই সময়ে ডলফিনের ভিড়, অন্তত ৫টা স্পিনার ডলফিন বেশ জাকিয়ে ঘুরতে থাকল মাছের আশায়।

নাবিকেরা অনেক সময়ই ৫০টার ঝাঁকও দেখে থাকেন এই অঞ্চলে, তারপরও এবারের ভ্রমণে প্রথমবারের মত জীবিত ডলফিনদের লেজের দেখা পেয়ে আমরা যথেষ্ট আহলাদিত, প্রকৃতি ও জীবন দল ডলফিন দলের পানির নিচের ফুটেজ সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল, আর আমরা পানির উপর থেকেই দেখলাম তাদের শিকার, খুনসুটি, আদর।

এইটাই এযাত্রা সোয়াচের সবচেয়ে গভীরে অবস্থান আমাদের, এবার ফিরতে অন্য মাছের খোঁজে অন্য দিকে।

দুপুর ২টায় জাল তোলা হল, ২ টা কাছিম, স্কুয়া হাজির, সাথে পানচিল, গাঙচিল, আর বিচিত্র সব প্রাণী ।

বিশেষ করে অন্ধকারের লন্ঠন মাছ, যে মাছটা মুখের সামনে নিজের দেহ থেকে উৎসরিত আলো টোপ হিসেবে ব্যবহার করে অন্য মাছকে আকৃষ্ট করে শিকার করে। সাগরের আঁধার জগতের তলদেশে শুয়ে শুয়ে এভাবেই অন্ন সংস্থান হয় তার।

সত্যিকারের অক্টোপাস, আট শুঁড়ের কী বর্ণীল একটা প্রাণী! যদিও মারা যাবার খানিকক্ষণ পড়েই যে ধূসর বর্ণের হয়ে গিয়েছিল।



উঠে এল একটা বিশেষ মাছ যার শরীরের উপরের এবং নিচের অংশের বর্ণ সম্পূর্ণ আলাদা, আর দাঁত পুরাই সারি সারি ক্ষুর।


(একই মাছের দুই পিঠ)
দুপুরে বিশেষ আয়োজন ছিল ইলিশ খিচুড়ি সাথে টাইগার চিংড়ি। ক্যাপ্টেন হাসতে হাসতে বললেন- বাড়ীতে আসলে তো এই চিংড়ি খাওয়ানোর সামর্থ্য হবে না, এইখানেই খাওয়ায় আপনাদের।

বেজায় খাওয়া-দাওয়া করে একা ডেকের উপরে বেরিয়ে আসছি একটু বাহিরে বসার জন্য, মনে হল অন্য ধরনের এক জোড়া পানচিল মাস্তলের উপর দিয়ে উড়ে যেয়ে আবার দ্রুত ফিরে গেল, মুহূর্তের মাঝেই একটানা ক্লিক করে কে কয়টা ছবি সম্ভব তুলে একটা হাক দিলাম- ইনাম ভাই, ইমারজেন্সি !
ডাক শুনেই ইনাম ভাইয়ের আগে ক্যাপ্টেন দৌড়ে আসলেন কোন দুর্ঘটনা হয়েছে ভেবে, ততক্ষণে পাখিরা লাপাত্তা, ক্যামেরাই তোলা ছবি দেখেই উল্লসিত ইনাম ভাই বললেন- নতুন বছরের জন্য এর চেয়ে ভাল উপহার হতে পারে না, বাংলাদেশের জন্য নতুন পাখি আবিস্কার করেছেন ! (সেটা কী পাখি, তার ছবি ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত লেখা পরে আসিতেছে )
ল্যাটিচিউড ২১ ডিগ্রি ১৫মিনিট নর্থ, লংগিচিউড ৮৯ ডিগ্রী ৪৪ মিনিট ইস্ট এই অবস্থানে পেলাম সেই নতুন আগন্তককে।
বিকেলের দিকে জাহাজের সামনের বেশ বড়সড় কিছু মাছকে পানি ফুঁড়ে উঠে লাফাতে দেখলাম অনেক বার, ফ্লাইং ফিশ নয়, বেশ বড় আকৃতির।

সহকারী নাবিকেরা দেখে জানাল এক ধরনের টুনা, অপূর্ব সব দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে একের পর এক, মাছগুলো চকচকে শরীর বাতাস ফুঁড়ে চলছে, আবার প্রবেশ করছে বিশাল সব ঢেউয়ের মাঝে, তবে ছবি তোলা দুষ্কর, শত শত তুললেও একটাও মাছ শূন্য ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায় না, হয়ত মুড়ো উধাও, না হয় লেজ! অবশেষে একটা মুহূর্ত পাওয়া গেল মন মত-

২ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার
এই জাহাজে আজ আমাদের শেষ দিন, সকাল থেকেই সাগরে মাতম শুরু হয়েছে যেন সেই কারণে! বিশাল বিশাল সব ঢেউ, জাহাজ টালমাটাল, একবার উপরে উঠে তো আবার নামে, ডেকের উপরে পর্যন্ত এসে ঝাঁপটা দিচ্ছে লোনা জল। দরিয়ার মাঝে কাঠের তৈরি মাছ ধরা ট্রলারগুলোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে কোন সময় তলিয়ে যাবে খড়কুটোর মত।

(ছুরি মাছ)
সী-সিকনেসে আক্রান্ত হবার মোক্ষম আবহাওয়া, যদিও গত এক সপ্তাহের অভিজ্ঞতায় কিছুটা খাপ খাইয়ে নিয়েছে শরীর, তারপরও এমন আবহাওয়াতে যে কেউই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। তবে দুপুরের খানাদানাতে কোন ঘাটতি ফেলতে পারল না উম্মত্ত সাগর। নতুন কোন পাখি যদিও বা আসল না সাগরের বার্তা পৌঁছে দিতে, আসলে গত এক সপ্তাহ সাগরে ভাসার পরেও পাখি দেখেছি আমরা মাত্র ৫ ধরনের, তাদের মাঝে নতুন পাখিটি ছিল মাত্র ২টি, আর সিংহভাগই ছিল পালাসি গাংচিল।



সেদিনও জালে উঠে এল ২ টা কাছিম আর নানা রঙের কাঁকড়া, যারা আমাদের স্পর্শ নিয়ে ফিরে গেল অতলে। অবশেষে রাতে অন্য জাহাজে উঠে চট্টগ্রাম রওনা দেবার সময় সাগরের টানে বার বার মনে হচ্চিল-



কেন পিরিতি বানাইলি রে বন্ধু, ছাইড়া যাইবা যদি?
(পোস্টটি আমাদের সত্যিকারের ফাইটার বন্ধু শাহেনশাহ সিমনের জন্য)

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.