নিশা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
নিজের চোখকে সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। রাস্তার ওপাশের ডাস্টবিনে আট নয় বছর বয়সী একটা ছেলে উপুড় হয়ে বসে ছিল। নিশা প্রথমে ভেবেছিল, ছেলেটা হয়তো পেশাব করতে বসেছে। এখন দেখছে ছেলেটা ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খাচ্ছে।
এবং একটা পলিথিনে কি যেন ভরছে। নিশার মনে হল, সে দুঃস্বপ্ন দেখছে। আসলেই সে দুঃস্বপ্ন দেখছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্যে নিশা সিগারেট ফেলে দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরাল। সিগারেটটা সে জানালা দিয়ে না ফেলে নিজের পায়ের উপর ফেলেছে। বুড়ো আঙ্গুলের মাথা খানিকটা পুড়ে গেছে মনে হয়।
জ্বলছে। তার ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে ডেকে জিগ্যেস করে সে ডাস্টবিন থেকে খাবার খাচ্ছে কেন ? বাংলাদেশে আসার আগে এই দেশ সম্পর্কে নিশা তার বেস্ট ফ্রেন্ড জনের কাছেঅনেক অদ্ভুত কথা শুনেছে। এখানে অনেক মানুষ রাস্তায় ঘুমায়। তাদের বাড়িঘর বলে কিছু নেই। রাস্তার উপরেই নাকি তাদের সংসার।
শুনে প্রথমে সে বিশ্বাস করেনি। এখন মনে হচ্ছে, জন মিথ্যা কথা বলেনি। লন্ডনের হিথরোএয়ারপোর্টে তাকে প্লেনে তুলে দিতে এসে জন বলেছিল, তুমি খুব নোংরা একটা দেশে যাচ্ছ। ওই দেশের মানুষ রাস্তায় ঘুমায়। ডাস্টবিনের খাবার খায়।
নিশা বলেছিল, যত কিছুই হোক এটা আমার বাবার দেশ। আমার জন্ম ব্রিটেনে হলেও আমি বাঙালি।
জন তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে হেসেছিল।
ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে নিশা বাথরুমে ঢুকে বিস্মিত হয়ে গেল। কি নোংরা বাথরুম।
দেখে মনে হচ্ছে, বাথরুম বানানোর পর কোনোদিন পরিষ্কার করা হয়নি।
নিশার মামা সাইদ খন্দকার তাকে নিতে এলেন। এই প্রথম সে তার মামাকে দেখেছে। তার উচিত ছিল মামাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সালাম করা। বাংলাদেশের মেয়ে হলে এটাই করতো।
নিশা এসব কিছুর ধার দিয়েও গেল না। মামাকে দেখে প্রথমেই জিগ্যেস করলো, মামা, তোমাদের বাথরুম এতো নোংরা কেন ?
সাইদ সাহেব থতমত খেয়ে বললেন, তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না।
নিশা পরিষ্কার বাংলায় বলল, প্লেন থেকে নেমে আমি বাথরুমে গিয়েছিলাম। নোংরা দেখে ঢুকিনি।
সাইদ সাহেব নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছেন, ও আচ্ছা।
চল আমরা বাসায় যাই। বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
নিশা তার মামার সঙ্গে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে সিগারেট ধরাল। সাইদ সাহেব আড়চোখে তাকালেন। তিনি শুনেছেন, বিলেতের মেয়েরা ফ্রি মাইন্ডের হয়।
এতোটা ফ্রি মাইন্ডের হয় এটা তিনি ভাবতে পারেন নি।
নিশা গাড়িতে ওঠো। সামনে বসবে নাকি পেছনে বসবে ?
নিশা কোনো জবাব না দিয়ে পেছনের দরজা খুলে গাড়িতে উঠল। তার নিজস্ব একটা নিয়ম আছে। যে গাড়ি তার পছন্দ হয় না সেই গাড়ির সামনের সিটে সে কখনো বসে না।
মামার গাড়ি দেখে তার মন খারাপ হয়ে গেছে। কালো প্রাডো গাড়ি কোনো গাড়ি হল ? মার কাছে সে শুনেছে, তার মামা বাংলাদেশের শীর্ষ ধনিদের একজন। দামি গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করে। এখন দেখছে মামা খুব সেকেলে একটা গাড়ি ব্যাবহার করে। মামার উচিত ছিল লিমোজিন বা হেমার ব্যাবহারকরা।
ছেলেটা এখনো খাবার কুড়াচ্ছে। একটু পর পর ভীত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। নিশা সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে বারান্দার মেঝেতেই বসে পড়লো। তার অদ্ভুত একটা রোগ আছে। মাঝে মাঝে কল্পনায় নিজেকে সে একেক রকম করে ভাবে।
অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা দেখলে কল্পনায় নিজেকে সেই স্থানে দাঁড় করিয়ে ভাবার চেষ্টা করে, তার বেলায় এমন হলে সে তখন কি করতো ?
নিশা চোখ বন্ধ করে নিজেকে ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খাওয়া ছেলেটার জায়গায় ভাবার চেষ্টা করলো। নিশা কল্পনায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, এই মুহূর্তে সে ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়াচ্ছে। ছোট ছেলেটার মতো সেও উবু হয়ে ডাস্টবিনের সামনে বসে আছে। আশ্চর্য, ডাস্টবিনটা তার কাছে নোংরা মনে হচ্ছে না। কিন্তু ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।
কেমন যেন গা গোলাচ্ছে।
নিশা।
নিশা চমকে তাকাল। সাদিয়া নিঃশব্দে এসে তার পেছনে দাঁড়িয়েছে। সাদিয়া তার মামাতো বোন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলোসফি নিয়ে পড়ছে। কথায় কথায় দার্শনিকদের মতো মন্তব্য করা তার স্বভাব। দেখতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রূপবতীদের একজন মনে হলেও নিজের রূপ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। বাংলাদেশের মেয়ারাও যে ডাকসাইটে রূপবতী হতে পারে এটা সাদিয়ার সঙ্গে দেখা না হলে নিশা কখনোই জানতে পারতো না। তবে সাদিয়ার ব্যাপারে সবচে ভয়ঙ্কর কথা হচ্ছে, অসম্ভব রূপবতী হয়েও সে টাকমাথাওয়ালা একটা ছেলের প্রেমে পড়েছে।
নিশা তুমি এখানে কি করছ ?
নিশা সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বলল, দেখতেই পাচ্ছ কি করছি।
সাদিয়া অবাক হয়ে বলল, তুমি সিগারেট খাও ? নিশা লন্ডন থেকে এসেছে তিনদিন হয়েছে। এই তিনদিনে সাদিয়া তাকে সিগারেট খেতে দেখেনি। দেখার কথাও না। কারণ, সেদিন এয়ারপোর্টে সিগারেট ধরানোর ব্যাপারটা তার মামা যে পছন্দ করেনি এটা সে লক্ষ্য করেছিল।
এইজন্যে বাসায় আসার পর সে কারো সামনেই সিগারেট খায়নি। ঘরের দরজা বন্ধ করে একা একা খেয়েছে। আজো বাসার সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পরসিগারেট ধরিয়েছে। সাদিয়া ভাবতেও পারেনি নিশা মেয়ে হয়ে সিগারেট খেতে পারে।
নিশা বলল, তোমাদের দেশে কি মেয়েরা সিগারেট খায় না ?
সাদিয়া চোখ কপালে তুলে বলল, মেয়েরা সিগারেট খাবে কেন ?
আমাদের দেশে তো মেয়েরা মদও খায়।
বল কি।
মদ খাওয়া আমাদের দেশে দূষণীয় কিছু না।
তুমিও কি মদ খাও নাকি ?
না। আমি মদ খাই না। এলকোহল আমি পছন্দ করি না।
কখনো খাওনি ?
না।
সাদিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি অনেকক্ষণ ধরে তোমাকে লক্ষ্য করছি। মনে হচ্ছিল, তুমি গভীরভাবে কিছু ভাবছ। কি ভাবছিলে ?
কিছু না।
অবশ্যই কিছু ভাবছিলে।
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
নিশা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, চল ঘরে গিয়ে বসি। মামা কি ঘুমিয়ে পড়েছেন ?
হ্যাঁ।
নিশা সোফায় বসতে বসতে বলল, বারান্দায় বসে আমি ভয়ংকর একটা দৃশ্য দেখেছি। দৃশ্যটা দেখে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি।
মনে হচ্ছে আমি কিছুক্ষণের জন্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমের মধ্যেই কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছি। অথবা আমার হেলুসিনেশন হয়েছে।
সাদিয়া কৌতূহলী গলায় বলল, কি দেখেছ ?
নিশা বলল, আমি বারান্দায় বসেছিলাম। হঠাৎ দেখলাম, রাস্তার ওপাশের ডাস্টবিন থেকে ছোট একটা ছেলে খাবার কুড়িয়ে খাচ্ছে।
আচ্ছা, তোমাদের বারান্দা থেকে যেই রাস্তাটা দেখা যায় সেখানে কোনো ডাস্টবিন আছে ?
সাদিয়া বলল, আছে। তুমি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখনি। আমিও দেখেছি, একটা ছেলে ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়াচ্ছে।
নিশা অবাক হয়ে বলল, বল কি, এই দেশে সত্যি সত্যিই মানুষ ডাস্টবিনের খাবার খায় ?
হ্যাঁ।
এখানে কি মানুষ রাস্তায়ও ঘুমায় ?
সাদিয়া বলল, হ্যাঁ।
তুমি এসব নিয়ে ভাবছ কেন ? তোমাকে তো রাস্তায় থাকতে হচ্ছে না।
নিশা সাদিয়ার কাঠখোট্টা রসিকতার কোনো জবাব দিলো না। চোখ গোল গোল করে সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। সে বিশ্বাস করতে পারছে না বাংলাদেশে এতো গরিব মানুষও আছে। যাদের অবস্থান দারিদ্র সীমারও অনেক নিচে।
নিশার হঠাৎ মনে হল, এরাও তো মানুষ। আমাদের মতো এদের তো আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ভালোবাসা সবই আছে। এদের তো গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে। সুন্দর ছিমছাম একটা নিজস্ব বাড়ির স্বপ্ন এদেরও তো আছে। নাকি এদের কোনো স্বপ্ন নেই ?
নিশা একদৃষ্টিতে ঘরের সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে।
সাদিয়া বিস্মিত হয়ে তাকে দেখছে। সে বুঝতে পারছ না একটা ভিখিরি ছেলের ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়ানো নিয়ে নিশা এতো কি ভাবছে। এটা নিয়ে ভাবারই বা কি আছে। ভিখিরিদের ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়ানো তো আরঅস্বভাবিক কিছু না। বরং এটাই স্বাভাবিক
( চলবে )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।