যে লেখে সে আমি নয়...
বাংলাদেশে এতো সুন্দর জায়গা থাকতে পারে আমি আগে ভাবিনি। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এতো সুন্দর ! পতেঙ্গা বীচে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের দুই দৃশ্যই দেখা যায়। পৃথিবীর অতি অল্প কিছু জায়গার এটি একটি। সাদিয়া যখন আমাকে কক্সবাজার যাওয়ার প্ল্যানের কথা বলল, আমি তেমন কোনো উৎসাহ দেখাইনি। আমার মনে হয়েছিল, পশ্চিম গোলার্ধের অনেক অসাধারণ সমুদ্র সৈকতে আমি ঘুরেছি।
যেগুলোর তুলনায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত কিছু না। এখন দেখছি আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ছিল। ইন্টারনেটে উইকিপিডিয়ায় কক্সবাজার সম্পর্কে জানতে গিয়ে বিস্ময়ে আমার চোখ কপালে উঠেছে। কারণ এই সমুদ্র সৈকত নাকি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কোথায় এবং তার নাম কি আমি জানতাম না।
কিন্তু সেটা যে বাংলাদেশে হতে পারে আমার কখনোই তা মনে হয়নি।
কক্সবাজারে আমরা তিনদিন ছিলাম। আমরা বলতে মামা, মামি, সাদিয়া এবং আমি। এই তিনদিন আমাদের মধ্যে সবচে বেশি আনন্দিত ছিল সাদিয়া। কারণ প্রথম দিন কাকতালীয় ভাবে টাকমাথাওয়ালার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
সে তার মা বাবাকে নিয়ে ঘুরতে এসেছে। তারাও এয়ারপোর্ট থেকে বের হচ্ছে আমরাও বের হচ্ছি। হঠাৎ সাদিয়া বলল, নিশা দেখ তো ওই ছেলেটাকে সালমানের মতো মনে হচ্ছে না ? আমি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম আসলেই তাই। টাকমাথাওয়ালা সানগ্লাস চোখে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে বের হচ্ছে।
সাদিয়া !
বলো।
ছোটবেলায় মনে করতাম, আকাশের চাঁদ মানুষের সঙ্গে এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যায়। তোমার বেলায় দেখছি টাকমাথাওয়ালা চাঁদের ভূমিকা নিয়েছে।
সাদিয়া কৃত্রিম ভঙ্গিতে আমার পিঠে একটা চাপড় মারল।
এতটুকু লিখে নিশা ডায়রি বন্ধ করল। তার খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে।
কাল রাতেই সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। বারান্দা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, জহির বাগানে পানি দিচ্ছে। জহিরকে ডেকে সে কি সিগারেট এনে দিতে বলবে ? ইদানিং জহিরকে দিয়ে তার কোনো কাজ করাতে ইচ্ছা করে না। বেচারা গরিব মানুষ বলে আজ তাকে অন্যের বাড়িতে চাকরের কাজ করতে হচ্ছে। পয়সাওয়ালা হলে ঘটনা অন্য রকম হতো—তার বাড়িতে অন্য মানুষ কাজ করতো।
এমন যদি হয়, জহির কয়েক বছর পর মামার চেয়ে বেশি পয়সার মালিক হয়ে যায় তাহলে এই সাইদ মামাই তার সঙ্গে বিনয়ী হয়ে কথা বলবে। জগত বড়ই বিচিত্র। এখানে সবকিছুই প্রকৃতির খেলার সামগ্রী। এজন্যেই কথায় বলে, নদীর এপার ভাঙ্গে ওপার গড়ে এই তো নদীর খেলা, সকালবেলার বাদশা তুমি ফকির সন্ধ্যাবেলা।
মামা যেদিন জহিরকে মাথা কামিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল, নিশার খুব মন খারাপ হয়েছিল।
সারাদিন সে মুখে কৃত্রিম হাসি ধরে রেখেছে ; কিন্তু ভেতরে ভেতরে এই ঘটনার জন্যে নিজেকেই অপরাধী মনে হয়েছে। তার মনে হয়েছে, সে যদি বাংলাদেশে না আসতো তাহলে এই ঘটনা তাকে দেখতে হতো না।
কয়েকদিন ধরে নিশা অবাক হয়ে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছে, জহিরের প্রতি সে অন্য রকম টান অনুভব করছে। কোনো কারণে মন খারাপ থাকলে এই মানুষটার চেহারা দেখলে অন্য রকম একটা আনন্দ সে অনুভব করে। কেন করে ? অনেক ভেবেচিন্তেও নিশা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়নি।
যতই দিন যাচ্ছে জহিরের প্রতি তার টান বাড়ছে। এই যে সে বাগানে পানি দিচ্ছে এটা দেখে নিশার ইচ্ছা করছে নিচে গিয়ে জহিরের হাত থেকে পাইপ নিয়ে সে নিজের হাতে বাগানে পানি দেয়।
নিশা বারান্দায় দাঁড়িয়ে জহিরকে ডাকল, জহির !
জে ম্যাডাম।
একটু উপরে আসো।
জহির উপরে এসে বলল, ম্যাডাম কিছু বলবেন ?
নিশা বলল, তোমার কাছে কি সিগারেট আছে ?
জহির ইতস্তত করে বলল, জে।
দাও।
জহির সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিল। আজো সে এক প্যাকেট বেন্সন কিনেছে। প্যাকেটটা এখনো খলা হয়নি।
নিশা জিগ্যেস করল, এই প্যাকেটটা কি তুমি আমাকে দেয়ার জন্যে কিনেছ ?
জহির ফ্যাকাসে চোখে নিশার দিকে তাকিয়ে বলল, জে না।
তুমি তো বেন্সন খাও না।
জহির ইতস্তত করে বলল, আজ্ঞে এইটা আফনেরে দেওয়ার ইচ্ছা করে কিনেছি।
নিশা বেডসাইড টেবিলে প্যাকেটটা রাখতে রাখতে বলল, এই প্যাকেট আমি রাখলাম।
জহির সবগুলি দাঁত বের করে বলল, আপনের কৃপা।
জহির !
জে।
তুমি পড়ালেখা কতটুকু করেছ ?
জহির নির্বিকার গলায় বলল, ইংরেজি সাহিত্যে এম এ করেছি।
নিশা থতমত খেয়ে গেল। এই ছেলে বলে কি ? সে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ করেছে। তাহলে এই বাড়িতে কাজ করছে কেন ? আশ্চর্য !
ম্যাডাম খুব অবাক হইছেন মনে হচ্ছে ?
অবশ্যই অবাক হয়েছি। ইংরেজি সাহিত্যে এম এ করে তুমি এই বাড়িতে চাকরের কাজ করছ কেন ?
কপালের দোষ।
নিশা বলল, শুদ্ধ বাংলায় কথা বলো। তুমি কি সত্যি ইংরেজি সাহিত্যে এম এ করেছ ?
জি।
তাহলে কোনো চাকরি করছ না কেন ?
জহির হেসে বলল, চাকরিই তো করছি। এ বাড়িতে আমাকে চাকর হিসেবেই রাখা হয়েছে।
তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
বুঝতে পারার কথাও না। একজন চাকর শ্রেণির মানুষ ইংরেজি সাহিত্যে এম এ করেছে এটা বুঝতে আপনাদের মতো ধনি মানুষের কিছুটা সময় লাগার কথা। এটাকে বলে টাকার অভিশাপ।
মানে ?
মানে, একজন রিকশাওয়ালাকে যদি বলতাম, ভাই কপালের দোষে আমি এক ভদ্রলোকের বাড়িতে চাকরের কাজ করি। কিন্তু আমি একজন শিক্ষিত মানুষ, ইংরেজি সাহিত্যে এম এ করেছি, তাহলে আমার কথা বিশ্বাস করতে রিকশাওয়ালার এতোটা সময় লাগতো না যতটা আপনার লেগেছে।
অঢেল সম্পদশালী মানুষেরা সবসময় জগতের কঠিন এবং তিক্ত সত্য থেকে বঞ্চিত থাকে। এটা প্রকৃতির নিয়ম।
নিশা অবাক হয়ে জহিরের কথা শুনছে। কি সুন্দর করেই না সে কথা বলছে ! অশিক্ষিত হলে নিশ্চয়ই সে এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারতো না।
তুমি কোনো অফিসে চাকরি নেওনি কেন ?
ম্যাডাম, বাংলাদেশে চাকরি এতো সস্তা না।
বড় বড় ডিগ্রিধারী লোকেরা এখানে চাকরির জন্যে বছরের পর বছর বিভিন্ন অফিসে চক্কর লাগাতে থাকে।
নিশা বলল, তোমার এই ব্যাপারটা কি এখানে কেউ জানে ?
না।
কাউকে জানানোর দরকার নেই। তুমি এক কাজ করো। আমি হাজার পাঁচেক টাকা দিচ্ছি।
যতো তাড়াতাড়ি পারো একটা পাসপোর্ট বানিয়ে ফেলো।
জহির অবাক হয়ে বলল, কেন ?
আমি তোমাকে লন্ডনে নিয়ে গিয়ে চাকরি দিব।
জহির কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, জি আচ্ছা।
জহির পাসপোর্ট বানানোর জন্যে নিশার দেয়া পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু সে পাসপোর্ট বানায় নি।
এই টকাটার তার খুব প্রয়োজন ছিল। পাঁচ হাজার টাকা ! জহিরের কাছে পাঁচ হাজার সংখ্যাটা কম নয়। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সে তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। ইচ্ছা করলে মরিয়মকে নিয়ে চাইনিজ খেতে পারে। মরিয়মের অনেকদিনের ইচ্ছা, ভাইয়ের সঙ্গে সে চায়নিজ খাবে।
আহ, মেয়েটার কোনো ইচ্ছাই কি পূরণ হবে না ? না, এটা সে হতে দিতে পারে না। আজই সে তার ছোটবোনকে নিয়ে চায়নিজ খাবে। একটা খেলনা রেলগাড়িও কিনতে হবে। মরিয়ম অনেকদিন আগে তাকে একটা খেলনা রেলগাড়ি কিনে দিতে বলেছিল।
জহির সেদিন নিশার সঙ্গে যে নাটক করেছিল তার জন্যে মনের মধ্যে সে কোনো অপরাধবোধ অনুভব করছে না।
নিশার কাছে পাঁচ হাজার টাকা কোনো টাকা না। জহিরের কাছে এই পাঁচ হাজার টাকাই অনেক কিছু। তবে ওইদিন জহির নিজেই তার অভিনয় ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হয়েছে। এতো সুন্দর অভিনয় সে করতে পারবে আগে ভাবে নি।
মরিয়ম জহিরের ছোটবোন।
দশ এগার বছরের মতো বয়স। পাঁচ বছর বয়সে তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ধরা পড়ে। জহিরের মা বাবা তাদের ছোটবেলায় মারা গেছেন। তারা দুই ভাইবোন এক মাসির কাছে বড় হয়েছে। মাস তিনেক আগে এই মাসিও মারা গেছেন।
তখন থেকে তারা বলতে গেলে রাস্তায় জীবন কাটাচ্ছে। সাইদ সাহেবের এখানে চাকরি পাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত তারা ফুটপাতে ঘুমাত। সাইদ সাহেবের বাসার উলটোদিকে একটা চায়ের স্টল আছে। জহির ওই স্টলের মালিকের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করেছে, মরিয়ম রাতে এই স্টলে ঘুমাবে। এর বিনিময়ে মাসে তিনশ টাকা ভাড়া দিবে জহির।
তখন থেকে মরিয়ম এই চায়ের স্টলে রাতে ঘুমায়। এবং সারাদিন সে টোকাইয়ের কাজ করে। জহির কোনোদিন ভালো খানা পেলে লুকিয়ে বোনের জন্যে নিয়ে আসে। ইদানিং মরিয়মের অসুস্থতা হঠাৎ বেড়ে গেছে। গত চারদিন ধরে সে বিছানায় পড়া।
ডাক্তার বলেছে, রোগী সপ্তাহখানেকের বেশি টিকবে না। আজ চারদিন পুরো হয়েছে—মরিয়ম আর মাত্র তিনদিন বাঁচবে।
কৈফিয়ত
গল্পটা এতটুকু লিখে আর লিখতে পারছিনা। কেন পারছি না জানিনা। আমার বিচিত্র একটা রোগ আছে।
কম্পিউটারের মতো আমার সিস্টেমও মাঝেমাঝে হ্যাং করে। কোনো কোনো বই পড়তে সময় এক জায়গায় গিয়ে হঠাৎ থেমে যাই। কিছুতেই আর সামনে পড়তে পারিনা। ওই বই তখন শেলফে তুলে রেখে অন্য বই টেনে নেই। দীর্ঘদিন পরে একদিন হঠাৎ সেই বইটি পড়ার প্রচণ্ড ইচ্ছা হয়।
আমি আবার পড়তে শুরু করি। এই ‘দীর্ঘদিন’ অনেক সময় কয়েক বছরও হয়। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের প্রথম খণ্ড শেষ করে দ্বিতীয় খণ্ড শুরু করেছি—বিশ বাইশ পৃষ্ঠা পড়া হয়ে গেছে। হঠাৎ কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আমার সিস্টেম হ্যাং করল। কিছুতেই আর বাকিটা শেষ করতে পারিনা।
শেষপর্যন্ত অন্য বই পড়তে শুরু করলাম। ২০১০ থেকে ২০১৩ এই দীর্ঘ তিনবছর ‘শ্রীকান্তের’ প্রোগ্রাম হ্যাং হয়ে রইল। সেদিন হঠাৎ ‘শ্রীকান্ত’ পড়ার খুব ইচ্ছে হল। আমি আবার পড়তে শুরু করলাম। আশ্চর্য, দ্বিতীয় খণ্ড পড়ার পর আবার সিস্টেম হ্যাং করল।
শ্রীকান্ত মশাই এখন হ্যাংগিং অবস্থায় আছেন। আরো কয়েকটা বই হ্যাংগিং অবস্থায় আছে। এই মুহূর্তে একটা বইয়ের নাম মনে পড়ছে—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথমআলো’র দ্বিতীয় খণ্ড। ১৬১ পৃষ্ঠা পর্যন্ত গিয়ে এই প্রোগ্রাম হ্যাং করেছে। সুনীলদা প্রায়ই হ্যাং করেন।
তাঁর ‘অর্ধেকজীবন’ অর্ধেকটা পড়ার পর প্রায় দুই বছরের মতো হ্যাং হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের মতো বাসন্তী লেখকের অসাধারণ বই ‘জোছনা ও জননীর গল্পও’ বছর দেড়েকের মতো হ্যাং হয়েছিল। আমি আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি, স্যারের লেখা এই বই কেন আমার সিস্টেমে এসে হ্যাং করেছিল। আমার হার্ডিস্ক মনে হয় পুরোটাই গেছে।
আমার কাছে ২৬ খণ্ডে সমাপ্ত রবীন্দ্রসমগ্র আছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার সিস্টেমে সবচে বেশি হ্যাং করেন রবীন্দ্রনাথ। দিনের মধ্যে কয়েকবার তিনি হ্যাং করেন। তাঁর বই বা কবিতা কোনটা রেখে কোনটা পড়বো দিশা পাইনা—খেই হারিয়ে ফেলি। রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষ হ্যাং করলে আমি খুব আনন্দ পাই। পরম করুণাময় আমাকে এই আনন্দ দেয়ার জন্যেই হয়তো দিনের মধ্যে কয়েকবার রবীন্দ্রনাথকে হ্যাঙ্গিং অবস্থায় রাখেন।
ইদানিং মনে হয় কবিগুরু আমাকে অভিশাপ দিয়েছেন। উনার অভিশাপেই হ্যাঙ্গিং এর ব্যাপারটা আমার লেখার ক্ষেত্রেও চলে আসছে কিনা বুঝতে পারছিনা।
ইবরাহীম ওবায়েদ
দি হেভেন, খিলগাঁও, ঢাকা।
২৬ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ২০১৩
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।