সাইদ সাহেব নিশাকে ডেকে বললেন, বোস। তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করি।
নিশা বসতে বসতে বলল, কি গল্প করবেন ?
তেমন কিছু না। আমাদের দেশ তোমার কেমন লাগছে ?
মামা, দেশ তো শুধু আপনাদের না, এটা আমারও দেশ। আমার জন্ম লন্ডনে হলেও এটা আমার আসল দেশ।
আমার গায়ে এই দেশের আলো বাতাস এবং মাটির রসে গড়ে উঠা মানুষের রক্ত।
নিশার কথা শুনে সাইদ সাহেব মনে মনে খুব তৃপ্তি পেলেন। অন্য দেশের কালচারে বড় হয়েও তার ভাগ্নি যে নিজের দেশের প্রতি এতোটা শ্রদ্ধাশীল এই ব্যাপারটা তাঁকে খুব আনন্দিত করলো।
সাইদ সাহেব বললেন, ঢাকা শহরে অনেক দর্শনীয় স্থান আছে। তোমার যখন ইচ্ছা হয় গাড়ি নিয়ে ঘুরে আসবে।
জি আচ্ছা।
সাদিয়ার কলেজ এখন বন্ধ। ওকে সঙ্গে নিয়ে যেও। দুজনে মিলে ঘুরলে আনন্দ পাবে। আর সম্ভব হলে কোনো পুরুষ মানুষ সঙ্গে নিয়ে যেও।
শুধু ড্রাইভারের উপর ভরসা করা ঠিক হবে না।
পুরুষ মানুষ কাকে নেব মামা ?
জহিরকে নিতে পারো। সে অবসরই থাকে।
জি আচ্ছা।
নিশা, কিছু মনে কোরো না, তোমার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারলাম না।
আমার আবার একটা জরুরি মিটিং আছে।
মামা, কি যে আপনি বলেন। আমি আবার কি মনে করবো ?
সাইদ সাহেব চলে যাওয়ার পর নিশা তার নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। মামি এসে একবার দরজায় শব্দ করলেন। কিন্তু সে দরজা খুলল না।
ভেতর থেকে চেঁচিয়ে বলল, Please live me alone.
মামি চলে গেলে নিশা তার ব্যাগ থেকে চকলেট কালারের ব্যক্তিগত ডায়রি বের করল। এই ডায়রিতে সে তার ক্ষুদ্র জীবনের অনেক গোপন কথা লিখে রেখেছে। তার ধারণা, মা অথবা বাবা এই ডায়রি পড়লে হার্টফেল করবেন। এমন অনেক কথা সে লিখেছে যা একজন মানুষের জীবনে শুধু ভয়ঙ্কর না—অতি ভয়ঙ্কর। মাঝে মাঝে ডায়রি খুলে বিশেষ বিশেষ ঘটনা সে পড়ে।
পড়তে পড়তে অনেক সময় তার চোখে পানি এসে যায়। আবার অনেক সময় হাসি পায় এই ভেবে, আগে কতো বোকা ছিলাম। নিজের ছেলেমানুষি অনেক ঘটনা পড়ে একা একা সে খিল খিল করে হাসে। এতো জোরে হাসে যে, বাইরে থেকে কেউ শুনলে মনে করবে মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে।
নিশা ডায়রি খুলে প্রথম যে পাতা বের হল সেখান থেকে পড়তে শুরু করলো—
আজ আমার মন অসম্ভব খারাপ।
মনে হচ্ছে, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। অন্তত আমার জন্যে কোনো অর্থ হয় না। যাকে দেখছি তাকেই অসহ্য লাগছে। সকালবেলায় সূর্য দেখে মনে হয়েছে এরচেয়ে অভিশপ্ত জিনিস পৃথিবীতে আর নেই। কেন জানি পৃথিবীর কোনো বস্তুরই ভালো দিক আজ আর আমার নজরে পড়ছে না।
আমি শুধু মন্দ দিকটাই দেখছি। মানুষগুলিকে মনে হচ্ছে জন্তু।
নিশা পাতা উল্টালো। চার দিন পরের লেখা। সবটা পড়ে নিশার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।
এক সময় কি ভয়ঙ্কর কাণ্ডই না সে করতে চেয়েছিল। ভাগ্যিস শেষ পর্যন্ত করেনি—
সকাল সাতটা বিশ মিনিট।
আমি কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আজ রাতে আমি আত্মহত্যা করবো। সমস্ত যন্ত্রণার অবসান ঘটাবো।
যেহেতু আগে কখনো আত্মহত্যা করিনি কাজেই জানি না মৃত্যুর পর সমস্ত যন্ত্রণার অবসান হয় কিনা। মরে গিয়ে যদি দেখি পরকালের জগত এই জগতের চেয়ে জঘন্য তাহলে বিরাট ঝামেলা হয়ে যাবে। হোক। তবু আমি আত্মহত্যা করবো। ঝামেলা নিয়েই যদি থাকতে হয় তাহলে ওই জগতের ঝামেলা নিয়ে থাকি।
কিছুটা নতুনত্ব তো অবশ্যই পাওয়া যাবে। মৃত্যুর পরের জগতের ঝামেলা নিশ্চয়ই এই জগতের মতো না।
বিকেল পাঁচটা।
আত্মহত্যার প্রথম পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। একটু আগে ফার্মেসি থেকে তিন পাতা ঘুমের অষুধ কিনেছি।
প্রতি পাতায় বিশটা করে বড়ি আছে। বিশ পূরণ তিন সমান সমান ষাট। এই মুহূর্তে আমার সামনে ষাটটি ট্যাবলেট আছে। রাত দুইটার পরে এক গ্লাস পানির মধ্যে সমস্ত ট্যাবলেট গুলে খেয়ে ফেলব। প্রথমে এক চামচ খেয়ে দেখব তিতা কতটুকু।
বেশি তিতা হলে চিনি মিশিয়ে নেবো।
রাত দশটা তিন মিনিট।
সুইসাইড লেটার এখনো লেখা হয়নি। এই লেখটা শেষ করে সুইসাইড লেটার লিখতে বসবো। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আত্মহত্যার পর সবার আগে বাবা এই ডায়রি পড়বেন।
আমার প্রকৃতিপাগল বাবা। প্রতি পূর্ণিমার রাতে তিনি খালি গায়ে ছাদে বসে থাকেন। ছোটবেলায় বুঝতে পারিনি অনেকদিন পর পর বাবা কেন সারারাত খালি গায়ে ছাদে বসে থাকেন। মাকে জিগ্যেস করলে বলতেন, এক রাতের জন্যে তোর বাবা হিমু হয়েছে। হিমু ব্যাপারটা আমি আগেও বুঝতাম না এখনো বুঝি না।
বড় হয়ে ইন্টারনেট থেকে জেনেছি, হিমু হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ নামক অসম্ভব ক্ষমতাশালী একজন বাঙালি লেখকের সৃষ্ট চরিত্র। অনেক মানুষ এই চরিত্র হজম করে হিমু হয়ে যায়। জোছনারাতে তারা অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড করে। খালি গায়ে বসে থেকে জোছনায় অবগাহন করে। নির্জন রাতে হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে।
একজন লেখক সত্যি সত্যি মানুষকে এতোটা প্রভাবিত করতে পারলে বলতেই হয় উনি অসম্ভব ক্ষমতাশালী লেখক। হুমায়ূন আহমেদ নামের অতি অদ্ভুত এই লেখকের সঙ্গে দেখা করার আমার খুব ইচ্ছা ছিল। শুনেছি উনি মারা গেছেন। যাক্, আমিও মারা যাচ্ছি। সাক্ষাত পর্ব পরকালেই সেরে নেবো।
আর অনেকের সঙ্গে সাক্ষাত করার প্ল্যান আছে। তাদের নাম এখানে লিখবো না। আমার পরকালের প্ল্যান সম্পর্কে কাউকে কিছু জানাতে ইচ্ছা করছে না।
বাবা যেহেতু প্রকৃতিপাগল মানুষ তাই আমি পূর্ণিমার রাতে সুইসাইড করবো। বাবা ছাদের উপর খালি গায়ে বসে ফুল মুন দেখবেন আর আমি তার ঠিক নিচের ঘরে সুইসাইড করবো।
বাবার জোছনা দেখার সময় মাও ছাদে থাকেন। কাজেই আমার প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে খুব কষ্ট হবে না।
ফুল মুন দেখা শেষ করে উনারা যখন নিচে নামবেন তখন অদ্ভুত একটা ব্যাপার হবে। ডাইনিং টেবিলের উপর আমার সুইসাইড নোট দেখে দু’জনেই দৌড়ে এসে আমার ঘরে ঢুকবেন। ঘরে ঢোকার পর তাঁরা অবাক হয়ে দেখবেন ঠিক সামনের দেয়ালে বড় বড় অক্ষরে লেখা—
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হলো তার সাধ।
রাত একটা পঁচিশ মিনিট।
একটু আগে সুইসাইড নোট লিখেছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সুইসাইড নোটে আমার মৃত্যুর জন্যে একজনকে দায়ী করেছি। তবে তার নাম বলিনি। আমার মৃত্যুর পরে যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তাদের সবার নাম লিখে নিচে লিখে দিয়েছি এদের কেউই আমার মৃত্যুর জন্যে দায়ী নয়—দায়ী অন্য একজন।
সেই অন্য একজনকে খুঁজতে খুঁজতে পুলিশের জান বের হয়ে যাবে। অবশ্যি আমার এই ডায়রিটা পড়লে খুব সহজেই তারা দোষী ব্যক্তিকে ধরে ফেলবে। আমি ঠিক করে রেখেছি, সুইসাইড করার ঠিক আগ মুহূর্তে ডায়রিটা পুড়িয়ে ফেলব যাতে ভিকটিমকে ধরতে পুলিশের কষ্ট হয়। গ্রেটব্রিটেনের মতো উন্নত দেশের পুলিশকে বেগার খাটানোর মজাই আলাদা। যদিও সেই আনন্দ আমি উপভোগ করতে পারবো না।
রাত দুটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
আমার তো এতক্ষণে মরে ভূত হয়ে যাওয়ার কথা। আমি লিখছি কিভাবে ? হা হা হা। কিছুক্ষণ আগে আমার জীবনের খুব বড় একটা ঘটনা ঘটেছে। কাজেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সুইসাইড করব না।
বেঁচে থাকার আনন্দ কি জিনিস এখন তা বুঝতে পারছি। প্রকৃতি আমাকে আরো কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে। এর পেছনে তাঁর কোনো মহৎ উদ্দেশ্য আছে মনে হয়। এ জন্যেই হয়তো আমার জীবনের কাঙ্ক্ষিত সেই ঘটনাটি কিছুক্ষণ আগে ঘটিয়েছে।
ডায়রি বন্ধ করে নিশা ঘড়ির দিকে তাকাল।
আটটা চল্লিশ বাজে। সাদিয়া এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। তাঁর ঘুম ভাঙ্গে নয়টার পর। নিশা একটা প্যাডে আজকের প্রোগ্রাম গুছিয়ে লিখে ফেলল। এখন সাদিয়ার মত পেলেই হয়।
ইদানিং সাদিয়া তার সঙ্গে কোথাও যেতে চায় না। নানান অজুহাত দেখায়। আসল কথা হচ্ছে, সুযোগ পেলেই সে ওই টাকমাথাওয়ালা ছেলেটার সঙ্গে দেখা করতে যায়। ইদানিং এই ছেলে থুতনিতে ছাগলা দাড়ি রেখেছে। এতো বিশ্রী দেখায়।
দাড়ি রাখতে ইচ্ছে হয়েছে পুরো দাড়িই রাখ—রামছাগলের মতো দাড়ি রাখবি কেন ?
বাংলাদেশে এসে নিশা লন্ডনের সঙ্গে এই দেশের একটা মিল খুঁজে পেয়েছে। এখানকার বড়লোকের ছেলেমেয়েরাও সম্পদ দেখে প্রেমে পড়ে। সাদিয়া যেই ছেলেটির প্রেমে পড়েছে তার বাবাও অসম্ভববড়লোক। ফেব্রিক্সের ব্যবসা করে ভদ্রলোক দুই হাতে টাকা কামাচ্ছেন। সাদিয়া আসলে টাকমাথাওয়ালার প্রেমে পড়েনি।
টাকমাথাওয়ালার বাবার সম্পদের প্রেমে পড়েছে। পৃথিবীতে অধিকাংশ বড়লোকের ভালোবাসা হয় মেকি। মুখে মুখে ভালোবাসা, আসলে কিছুই না। তাদের ভালোবাসা সব সময় টাকার জন্যে।
নিশা।
নিশা চমকে তাকাল।
কি করছ ?
আরে তুমি ঘুম থেকে উঠলে কখন ? নয়টার আগে তো তোমার ঘুম ভাঙ্গে না।
সাদিয়া হেসে বলল, নয়টা কি এখন বেজেছে ?
মানে ?
এখন বাজে সাড়ে দশটা।
বল কি। একটু আগেই তো দেখলাম আটটা চল্লিশ বাজে।
তোমার ঘড়ির ব্যাটারি শেষ।
নিশা দেখল, আসলেই ঘড়ির ব্যাটারি শেষ হয়েছে। রাতেই শেষ হয়েছে মনে হয়। সে লক্ষ্য করেনি।
বাবা বললেন লালবাগের কেল্লা দেখতে যাবে নাকি ?
হ্যাঁ।
কখন ?
তোমার যখন সময় হবে।
সারাদিনই আমার সময় আছে।
নিশা অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি !
খুব অবাক হয়েছ মনে হচ্ছে ?
হুম্। টাকমাথাওয়ালার সঙ্গে...সরি ছগলা দাড়িওয়ালার সঙ্গে আজ দেখা করবে না ? তোমার...
সাদিয়া নিশার মুখ চেপে ধরে বলল, আস্তে বল, মা শুনে ফেলবেন।
নিশা হাসতে হাসতে বলল, অসুবিধা নেই।
শুনে ফেললে উনাকে পরিচয় করিয়ে দেব। জামাই কেমন দেখতে হবে না ?
প্লিজ, চুপ করো।
আচ্ছা চুপ করলাম।
( চলবে )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।