আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল...
সাইদ সাহেব ভুরু কুঁচকে বসে আছেন।
এখন বাজে সাড়ে আটটা। এতক্ষণে খবরের কাগজ দিয়ে যাওয়ার কথা—এখনো দিয়ে যায়নি। তার মেজাজ ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছে। তিনি নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছেন।
কতক্ষণ সামলে থাকতে পারবেন বুঝতে পারছেন না। আধঘণ্টা আগে শাহেদাকে চা দিতে বলেছিলেন। শাহেদা সেই যে গেছে আর খবর নেই। এক কাপ চা বানাতে আধঘণ্টা লাগে ?সাইদ সাহেব চিৎকার করে শাহেদাকে ডাকতে গিয়েও ডাকলেন না। চোখ বন্ধ করে সোফায় বসে রইলেন।
খালুআফনেরচা। আগুনগরম।
চট করে সাইদ সাহেবের মাথায় রক্ত উঠে গেল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তিনি মেঝেতে ছুড়ে ফেললেন। চিৎকার করে বললেন, এক কাপ চা আনতে দুই ঘণ্টা লাগে ?হারামজাদা বলে, আগুন গরম চা।
আগুন গরম চা আমি কি মাথায় দিব ?বদের হাড্ডি। সবগুলির শরীরে চর্বি হয়েছে।
সাদিয়া দোতলায় তার ঘরে বসে নিষিদ্ধচর্চা করছিল। দরজা জানালা বন্ধ করে সে নিশার ডায়রি পড়ছিল। এমন সময় বাবার চিৎকার শুনে আক্ষরিক অর্থেই তার বুক কাঁপতে লাগল।
সাইদ সাহেবের চেঁচামেচি শুনে শাহেদা রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন। নিশা বসার ঘরের সোফায় বসে টিভি দেখছিল। সাইদ সাহেবের আচমকা চেঁচামেচিতে সেও ছুটে এল। অবাক হয়ে বলল, মামা তুমি এমন বিশ্রীভাবে চিৎকার করছ কেন ?
সাইদ সাহেব থতমত খেয়ে বললেন, না, চিৎকার করছি না। চা আনতে বলেছিলাম...
চা আনতে দেরি হয়েছে বলে চিৎকার করছ কেন মামা।
এই বয়সে মেজাজ সবসময় ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করবে। মেজাজ গরম করলে হঠাৎ একদিন দেখবে ব্রেইনের তার ছিঁড়ে গেছে।
সাইদ সাহেবের মেজাজ আবারো খারপ হতে শুরু করেছে। মেয়ের সমান বয়সী ভাগ্নি তাঁকে উপদেশ দিচ্ছে এটা তিনি নিতে পারছেন না। তাছাড়া কথা বলার সময় নিশার মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ বের হচ্ছে।
এই ব্যাপারটা তার মেজাজ আরো নষ্ট করে দিচ্ছে। কম বয়সী একটা মেয়ে ছেলেদের মতো অবলীলায় সিগারেট খায়। কোনো মানে হয় ?
নিশা !
জি মামা।
এই মুহূর্তে আমার সামনে থেকে বিদেয় হ।
নিশা অবাক হয়ে বলল, কেন মামা ?
তোর মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে।
নিশা লজ্জিত গলায় বলল, সরি।
সরি-টরি কিছু না, তুই সামনে থেকে যা।
মামা, এখন রাগ করার সময় না, নিজেকে সামলানোর সময়।
আমার রাগ সামলানোর জন্যে তোকে লাগবে না। আমি নিজেই নিজেকে সামলাতে পারি।
সামনে থেকে যা।
নিশা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে চলে গেল।
সাইদ সাহেব সন্ধ্যার পরে নিশাকে ডেকে বললেন, মা, রাগের মাথায় অনেক কথা বলে ফেলেছি। কিছু মনে করবে না।
নিশা মাথা নিচু করে বলল, আমি কিছুই মনে করিনি।
আসলে ব্যাপারটা হয়েছে কি শোনো, সকালে খবরের কাগজ আসতে দেরি দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পরে বুঝেছি, খবরের কাগজের জন্যে মেজাজ খারাপ হয়নি। আমি রাতে কিছু খাইনি—ক্ষিধায় পেট মুচড়াচ্ছিল। তাই হঠাৎ মেজাজ নষ্ট হয়ে গেল।
কোনো অসুবিধা নেই মামা।
সাইদ সাহেব নিশার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তাঁর হাসি দেখে মনে হল, সকালবেলার ঘটনায় সারাদিন তিনি মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। এখন সেই যন্ত্রণা নেমে গেছে।
নিশা !
জি মামা।
তুমি সিগারেট খাওয়াটা ছেড়ে দাও।
নিশা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, অনেকদিনের অভ্যাস। সহজে ছাড়তে পারবো না।
চেষ্টা করো।
চেষ্টা তো করছি।
আরো বেশি চেষ্টা করো।
জি মামা।
সাইদ সাহেবের মনে কয়েকদিন ধরে আশঙ্কা হচ্ছে, নিশার সঙ্গে থেকে সাদিয়াও হয়তো সিগারেট খাওয়া শিখে ফেলবে। কে জানে এতদিনে হয়তো শিখেও ফেলেছে। সাদিয়া তাঁর একমাত্র সন্তান। কাজেই পদে পদে তিনি মেয়েকে লক্ষ্য রাখেন।
তাঁর প্রায়ই মনে হয়, এই মেয়ের ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলে তাঁর জীবনে বেঁচে থাকাটাই অভিশাপ মনে হবে। এত টাকা পয়সা তখন তাকে মানসিক শান্তি দিতে পারবে না।
নিশা তার ব্যাগ খুলে ধাক্কার মতো খেল। ব্যাগে ডায়রি নেই। ডায়রি তো সে ব্যাগেই রেখেছিলো—গেল কোথায়? সাদিয়া নেয়নি তো? সাদিয়া ডায়রি নিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
অনেক গোপন কথা লেখা আছে সেখানে যেসব কথা কাউকেই বলা যায় না।
‘সে তো হায় মৃদু পায় এসেছিল পারিনি তো জানতে’।
নিশা চমকে তাকাল। সাদিয়া কবিতা আবৃত্তি করতে করতে ঘরে ঢুকছে। তার ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি।
মনে হচ্ছে, ডায়রিটা সেই নিয়েছে এবং খুব সম্ভব এতক্ষণে অনেক কথা পড়ে ফেলেছে।
সাদিয়া !
বল।
আমার ডায়রিটা খুঁজে পাচ্ছি না।
সাদিয়া উদাস গলায় বলল, ভালো করে খুঁজে দেখ।
ভাল করেই খুঁজেছি।
সাদিয়া আবারো গুনগুন করছে।
গুনগুন করে কি বলছ?
সাদিয়া মৃদু হেসে বলল, কবিতা পড়ছি। নতুন পড়লাম তো তাই মুখস্থ করার চেষ্টা করছি।
নিশার বুক ধক করে উঠল। সে তো হায় মৃদু পায় এসেছিল পারিনি তো জানতে... অনেকদিন আগে এটা তো সে তার ডায়রিতে লিখেছিল।
নিশা ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল, এই কবিতা তুমি কোথায় পড়েছ?
সাদিয়া নির্বিকার গলায় বলল, তোমার ডায়রিতে।
বল কি !
বিশ্বাস না হলে দেখ। বলেই সাদিয়া ডায়রি বের করল। নিশা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
সাদিয়া কাজটা তুমি ঠিক করনি।
সাদিয়া বলল, জানি।
জান মানে ? আরেকজনের ডায়রি পড়েছ, তোমার লজ্জা লাগছে না?
সাদিয়া আগের মতোই নির্বিকার গলায় বলল, না। তবে খুব আনন্দ হচ্ছে। আবার দুঃখও হচ্ছে।
কেন ?
২৮ ডিসেম্বর ২০০৯ এর ঘটনা পড়ে খুব খারাপ লেগেছে।
নিশার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। আজকের তারিখও ২৮ ডিসেম্বর। অনেকদিন আগে এই দিনে তার জীবনের সবচে বড় দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনা সে কোনদিন মনে রাখতে চায় না। তারপরেও এটা তার জীবনের বাস্তব সত্য ঘটনা।
এই বাস্তবতা নিয়ে সারাজীবন তাকে বেঁচে থাকতে হবে।
নিশার চোখে পানি দেখে সাদিয়া ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, জীবনে অনেক ঘটনাই ঘটে। তার মধ্যে অনেক তিক্ত সত্য থাকে। পেছনের দিনের কথা মনে করে নিজেকে কষ্ট দিও না।
ওই দিনের কথা ভোলার চেষ্টা করো।
নিশা ধরা গলায় বলল, অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি।
তোমাকে পারতেই হবে।
চলবে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।