নতুন সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়লেন আলোচিত-সমালোচিত ও প্রভাবশালী মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। যাদের অনেকেই ছিলেন মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভায় এবং দলে দাপুটে নেতা হিসেবে স্বীকৃত। প্রবীণদের পাশাপাশি তাদের জায়গা দখল করেছেন ক্লিন ইমেজের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও তরুণ নেতারা। এবার যাদের ঠাঁই হয়নি তাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিগত পাঁচ বছরে অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে যাওয়া, অতিকথনে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা, অদক্ষতা, মন্ত্রী হওয়ার পর তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে ঢাকায় বসে এলাকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা। তাছাড়া অঞ্চল বিবেচনা, তরুণদের সুযোগ দেওয়ার বিবেচনা থেকেও অনেকে মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। এবারের নতুন মন্ত্রিসভায় বিতর্কিতরা নেই জানিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচনের পর সবারই দৃষ্টি ছিল মন্ত্রিসভা কেমন হবে। আমার মনে হয় মোটামুটি ক্লিন মন্ত্রিসভা হয়েছে। টেম্পটেডরা (বিতর্কিত) নেই বললেই চলে।
তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। গতকাল বিকালে রাষ্ট্রপতি তাকে শপথবাক্য পাঠ করান। এরপর শপথ নেন ২৯ জন মন্ত্রী, ১৭ জন প্রতিমন্ত্রী ও এবং দুজন উপমন্ত্রী। শাসক দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকদের মধ্য থেকে কয়েকজন মন্ত্রী করা হয়েছে। পাশাপাশি এবার প্রথমবারের মতো প্রধান বিরোধী দল হওয়া জাতীয় পার্টিরও (জাপা) বেশ কয়েকজনকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে।
আলোচিত-সমালোচিতদের মধ্যে বাদ পড়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, আইসিটি মন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ, ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা, শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডা. আফসারুল আমিন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ, পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, শ্রমমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ, আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, পার্বত্যবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) ডা. মজিবুর রহমান ফকির, শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাই। শুধু মন্ত্রিসভা থেকেই বাদ পড়েননি, দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি, সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস, আইসিটি মন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার এনামুল হক, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শাহজাহান মিয়া। স্বাস্থ্যগত কারণে এবার দলের মনোনয়ন নেননি পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার বীরউত্তম। এ ছাড়া মহাজোট সরকারের জাতীয় পার্টির একমাত্র মন্ত্রী বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদেরও এবার মন্ত্রিত্ব পাননি। ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সরকারকে বিব্রত অবস্থানে ফেলেন। সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর তিনি বিতর্কিত মন্তব্য করেন। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে বার বার আলটিমেটাম, সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে ক্যামেরার সামনেই সাগর-রুনি সম্পর্কে কটূক্তির মাধ্যমে শুধু নিজেকেই নয়, হাস্য-কৌতুকের পাত্র করেছেন সরকার এবং দলকেও। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি ছিলেন মহাজোট সরকারের প্রভাবশালী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি গত পাঁচ বছরে বিদেশ ভ্রমণে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপড়েন বলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই মনে করেন। এ ছাড়াও বিদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতির পরিবর্তে তিনি অবনতি ঘটান। ড. ইউনূসের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিও তার কারণে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগ। তার নিজের দুর্নীতি, স্বাস্থ্য খাতে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ ও দাপটের কারণে কপাল পুড়িয়েছেন। মন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে এপিএস ছাত্রদল নেতা খোকনও আজ কোটি কোটি টাকার মালিক। ঢাকায় কিনেছেন ফ্ল্যাটবাড়ি। ডা. আ ফ ম রুহুল হকের কারণে সাতক্ষীরা মূলত জামায়াত-শিবিরের শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। গত পাঁচ বছরে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কোনো কর্মকাণ্ডে ভূমিকা ছিল না তার। প্রশাসন বেষ্টিত রাজনীতি, আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব, নরসিংদীর জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ডসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় মন্ত্রিপরিষদে স্থান পাননি সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। মেয়র লোকমান হোসেন হত্যার অভিযোগ ও মামলায় মন্ত্রীর ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু, পিএস মুরাদসহ একাধিক আওয়ামী লীগ নেতার নাম ওঠে আসে। রাজিউদ্দিন রাজু ক্ষমতার অপব্যবহার এবং নরসিংদীতে মেয়র লোকমান হত্যার দায়ে তার পরিবারের সংশ্লিষ্টতার খেসারত দিলেন। গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খানের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি, অহঙ্কার এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। তিনি ফ্ল্যাট ও প্লট বরাদ্দে ব্যাপক অনিয়ম করেছেন। তাছাড়া নামে-বেনামে সরকারি বাড়ি কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেছেন। শামসুল হক টুকু তার ছেলের ভোট ডাকাতি, নিজের বাচালতা (সর্বশেষ কাদের মোল্লার ফাঁসির সময় বলে দেওয়া), ক্ষমতার অপব্যবহার এবং নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না করে মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ পড়েন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার ও তার ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। ভাতিজা ও তার এপিএস সাজ্জাদ হোসেন সাগর টেন্ডারবাজি করার সময় রংপুরে পুলিশের হাতে আটক হন। তার ছেলে সোহাগ বাংলালিংক কাস্টমার কেয়ারে চাকরি করতেন। এখন তিনি শত কোটি টাকার মালিক। পুরো জেলার টেন্ডার, নিয়োগ, আন্ডারওয়ার্ল্ড সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে আনেন মাহমুদুল হাসান সোহাগ। আর চাচাতো ভাই আলমগীর হোসেন রন্টু জেলার ঠিকাদারের নিয়ন্ত্রক ছিলেন। মোতাহারের বিরুদ্ধে অনিয়মের রিপোর্ট করতে গিয়ে হাতিবান্ধার সাংবাদিক সায়েম সাবুর বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা দেওয়া হয়েছে। মহাজোট সরকারের প্রথমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেফতারের আলটিমেটাম ও ঈদের ছুটিতে বাড়িতে তালা দেওয়ার কথা বলে সমালোচনার ঝড় তুলেন। এ সমালোচনা ক্ষতিগ্রস্ত হয় দল এবং সরকার। এরপর মন্ত্রিসভার রদবদলে স্বরাষ্ট্রের পরিবর্তে দায়িত্ব পান ডাক ও টেলিযোগাযোগের। অদক্ষতার কারণেই তাকে বাদ রাখা হয়েছে তৃতীয়বারের আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের রেলের অর্থ কেলেঙ্কারির কারণেই এবার মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি। স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানকের কন্যার কোম্পানির কাছে সরকারি অর্থ পাওয়ার খবর পত্রিকায় আসায় তার কপাল পুড়েছে। ক্লিন ইমেজের ড. আবদুর রাজ্জাকও খাদ্যে নিয়োগে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তবে দলের এক প্রভাবশালী নেত্রীর বিরোধিতার কারণেই তার কপাল পুড়েছে বলেও গুঞ্জন রয়েছে। ড. হাছান মাহমুদের স্ত্রীর নামে ব্যবসা-বাণিজ্যের অভিযোগে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ফারুক খান, ক্যাপ্টেন তাজসহ কয়েকজন নেতা ক্ষমতার পালাবদলে স্বাভাবিকভাবেই মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। তবে ফারুক খান সপ্তাহে একদিন বাজার না করার কথা বলে সমালোচিত হয়েছিলেন। প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার অযোগ্যতার কারণেই মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। শিল্প খাতে সাফল্য আসেনি বলেই দিলীপ বড়ুয়াকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তিনি নিজ ও পরিবারের সদস্যের নামেও বেশ কয়েকটি প্লট নিয়ে বিতর্কিত হয়েছেন। পার্বত্যবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার এবার দলীয় মনোনয়ন পেলেও নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।