আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুখোশ

(১) আজ অনেক দিন পর ছাদে এসে অন্যরকম লাগছে মাহার। বিকেলটা এতো সুন্দর!সূর্য ঢলে পড়ছে পশ্চিম দিগন্তে। আকাশ এতো নীল!পাখির পালকের মতো আলতোভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘগুলো। কয়েকটা চিল আকাশের এ মাথা থেকে ও মাথা চষে বেড়াচ্ছে নিচের দিকে তাকিয়ে। কতো পাখি!একজোড়া শালিক একসাথে উড়ে চলে গেল মাথার উপর দিয়ে।

দূরে বেশ কয়েকটা ঘুড়ি উড়ছে। এখন কী শরত্কাল?হিসেব কষে দেখলো মাহা। হ্যা,এখন তো শরত্ কাল ই। সে কারণেই বিকেলটা এতো অসাধারণ। শরতের শেষ বিকেলের অসাধারণ সৌন্দর্য্যের কথা তো ভুলতেই বসেছে মাহা।

অথচ শেষ বিকেল তার প্রিয় মুহুর্ত। একদম অল্প সময়। টুপ করে চোখের পলকে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এই অল্প সময়টায় পার্থিব এ পৃথিবীকে অপার্থিব মনে হয়। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য্যের স্থায়িত্ব থাকে অল্প।

এতো অসাধারণ মুহুর্তটাও তাই স্বল্পস্থায়ী। মাহা প্রায়ই চিন্তা করে,দিন রাতের সব সৌন্দর্য্য,সব অস্থিরতা আর সব অপার্থিবতা এসে জমা হয় এই শেষ বিকেলে,তবে এ শেষ বিকেলের স্থায়িত্ব বিধাতা এতো অল্প রাখলেন কেন?এরকম কতো অসাধারণ শেষ বিকেল কেটেছে মাহার,নদীর তীরে বসে,রিফাতের সাথে। সময় পেলেই দুজন চলে যেত শহরতলী ঘেঁষা নদীর পাড়ে। নদীর পাড়ে কাঁশের ছন্নছাড়া ঝোপগুলো সাদা হয়ে থাকতো তুলোর মতো ফিনফিনে কাঁশফুলে। দখিনা বাতাসে দমকে দমকে দুলে উঠতো কাঁশফুলগুলো।

শেষ বিকেলের সূর্যের আলোয় চিকচিক করতো নদীর স্রোত। রিফাতের কাঁধে মাথা রেখে তখন মাহা গাছের মাথায় সূর্য ডোবা দেখতো। টকটকে লাল সূর্যটা ঢুলু ঢুলু চোখের পলক পড়ার মতো আলগোছে হারিয়ে যেত দিগন্তে। দিনগুলো এখনো মনে পড়ে। আগামী সপ্তায় অবশ্য রিফাতের সাথে দেখা হবে।

মাঝে একটা বছর কি ভয়ংকর সময় গেছে মাহার জীবনে!তার একটা কিডনি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অপরটার অবস্থাও ভালো ছিল না। দ্রুত কিডনি প্রতিস্থাপন না করলে মাহাকে বাঁচানোই যাবে না বলে দিয়েছিলেন চিকিত্সক। কিন্তু,হঠাত্ করে কিডনি কোথায় পাবে?তাছাড়া,তখন শেয়ার বাজারে বিশাল ধস নামায় মুনাফা হারিয়ে তার বাবা আর্থিকভাবে হঠাত্ করে দারুণ অসচ্ছল হয়ে পড়েন। ধার দেনা করে সংসার চালাতে হচ্ছিল।

কিডনি কেনার টাকা কোথায়?মাহার মায়ের অলংকার,ঘরের ফার্নচার প্রভৃতি বিক্রি করেও চিকিত্সার খরচ কুলানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাদের গ্রামের বাড়ির জমি বন্দক রেখে চড়াসুদে টাকা এনেছিল তার বাবা। উফ,চিন্তা করতেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় মাহার। তখন হঠাত্ করে উদ্ধারকর্তা হিসেবে এগিয়ে আসেন এক ব্যাক্তি। নিজের একটা কিডনি দান করেন মাহাকে।

চিকিত্সার অর্ধেক ব্যায় বহন করেন। কিন্তু,আশ্চর্যের ব্যাপার হলো মানুষটা নিজের পরিচয় দেন নি। অচেনা,অজানা একটা মানুষের কিডনি ব্যবহার করে সে বেঁচে আছে,ভাবতেই কেমন যেন অস্থির লাগে মাহার। এযুগেও এমন বিশাল মনের মানুষ আছেন!লোকটাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করে মাহার। দেখা হলে তার পা ছুঁয়ে একবার সালাম করতো মাহা।

এ ধরণের মানুষের সংস্পর্শেও পূণ্য হয়। সূর্যের আলো আরো ফিকে হয়ে গেছে। খানিকবাদেই সূর্য ডোবে যাবে। সানজিদ কি এখনো বসে আছে ড্রয়িংরুমে?একসাথেই পড়তো ওরা। তবে,ছেলেটাকে একদম ভালো লাগেনা মাহার,বরং বিরক্তিকর লাগে।

এমনিতে সানজিদ ভালো ছেলে,নম্র,ভদ্র,পড়াশোনায় সিরিয়াস। কিন্তু,তাকে মাহার কেমন যেন "ভাদাইম্যা" টাইপ মনে হয়। আর,সবচেয়ে বিরক্তিকর হচ্ছে ও সম্ভবত মাহাকে পছন্দ করে। মাহা অসুস্থ হওয়ার আগে খেয়াল করতো,ক্লাসে বা ক্যান্টিনে তার দিকে সানজিদ ক্যাবলার মতো করে তাকিয়ে আছে। এমনকি রিফাতের সাথে সম্পর্কটা জানার পরও।

নওশীন একদিন গোলচত্বরে আড্ডায় মজা করে বলছিল 'দোস্ত,সানজিদের অবস্থা হয়ে গেছে অনেকটা শকুনের মতো। শকুন যে রকম গরু মরার জন্য দোআ করে,ও বেচারাকে দেখলেও মনে হয় ও মনে প্রাণে চাচ্ছে মাহা আর রিফাতের রিলেশনটা ভেঙ্গে যাক। ' 'ওদের রিলেশন ব্রেকআপ হলে সানজিদের কি লাভ?'শান্তা জিজ্ঞেস করে। 'আরে বেকুব,তখন সানজিদ মাহার জন্য উঠে পড়ে লাগতো,হি হি হি...'হাসতে থাকে নওশীন। 'দূর,ঐ ভাদাইম্যার সাথে মরে গেলেও না।

আস্ত একটা ক্ষেত' নাক কুঁচকায় মাহা। সানজিদকে দেখলেই মাহার মাথা ধরে। সুস্থ হওয়ার পর আজ ওকে দেখতে এসেছে সানজিদ। কিন্তু,তাকে বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারেনি মাহা। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখে সোফায় বসা সানজিদ খুব মনোযোগ দিয়ে দাঁত দিয়ে হাতের নখ কামড়াচ্ছে।

মাহা ঢুকতেই দাড়িয়ে গেল। "কেমন আছো?" "ভালো", বসতে বসতে জবাব দেয় মাহা। "তুমি বেশ শুকিয়ে গেছো। " বিরক্ত হয় মাহা। এতো বড় অপারেশন হলো।

বেঁচে আছে এটাইতো বেশি। শুকানোতো খুবই স্বাভাবিক। ছেলেটার ইদানীং ন্যাকামো বেড়েছে। কিছুক্ষণ পর,ছাদ থেকে কাপড় আনার অজুহাত দিয়ে উঠে পড়ে মাহা। এরপর ছাদে চলে আসে।

মাহা কেন যে সানজিদের উপর এতো বিরক্ত,তা সে নিজেও জানে না। ধ্যাত্,ভাদাইম্যাটা কে নিয়ে মাথা ঘামাতে মোটেও ইচ্ছে করছে না মাহার। রিফাতের সাথে আগামী দিনগুলো নিয়ে ভাবতেই ভালো লাগছে এই শেষ বিকেলে। তবে,মাহা যখন অসুস্থ ছিল রিফাত ওকে তেমন একটা দেখতে যায়নি। ব্যাপারটা একটু খারাপ লেগেছিল মাহার কাছে।

অবশ্য,ও খুবই ব্যাস্ত। তাছাড়া,ওর চাকরিতে ছুটোছুটিও বেশি। মোবাইলে রিংটোন বেজে ওঠে মাহার। নাফিসা কল করেছে। 'হ্যালো জানু ,কি খবর? এই তো দোস্ত,ভালো,তোর খবর কি?কি করিস? "ছাদে,সানসেট দেখছি।

" "ওয়াও,জানেমান...আমিও তো ছাদে,আজকের বিকেলটা ফাটাফাটি,তাই না রে?" নিচে গেট খোলার শব্দ হলো। মাহা রেলিংএর কাছে এসে দেখে গেট দিয়ে সানজিদ বেরিয়ে যাচ্ছে। মাহা খানিকটা পিছিয়ে গেল,যাতে সানজিদ ওকে দেখতে না পায়। কিরে কথা বলিস না কেন? "ভাদাইম্যাটা চলে যাচ্ছে। " "কে?" "আরে,ঐ ভাদাইম্যা, সানজিদ।

আজকে হঠাত্ করে বাসায় এসে হাজির। ওর জন্যেই তো ছাদে এসে ঘাঁপটি মেরে বসে আছি। " "এভাবে বলছিস কেন?তোর এতো বড় একটা অপারেশন হলো,ছেলেটা তোকে দেখতে এসেছে। আফটার অল,ও তোকে পছন্দ করে। " "করুক গে।

ওকে দেখলেই আমার মাথা ধরে। " "তুই যখন অসুস্থ ছিলি,তখন ওকে প্রায়ই হাসপাতালের সামনে পেতাম। তাছাড়া...." "ডার্লিং,তুই কলটা কেটে দে,রিফাত ওয়েটিংএ আছে। পরে তোর সাথে কথা বলবো,বাই..." ইতস্তত করে নাফিসা কলটা কেটে দিল। একটা জরুরী কথা বলার ছিল নাফিসার,বলা হলো না।

আর মাহার তখন কথার ফোয়ারা ছুটেছে শরতের শেষ বিকেলের আলোচ্ছটার মতো। (২) সানজিদ যখন গেট খোলে বের হচ্ছে,মাহাদের তিনতলা ভবনের ছায়া পূর্বদিকে অনেকদূর ঢলে পড়েছে। সেই ছায়ার মাথায় আরেকটা ছায়াকে একটু উঁকি দিয়েই সরে যেতে দেখলো সানজিদ। একটুক্ষণের জন্য থমকে গেলো সে। পিছনে ফিরে তাকালো না।

সে জানে,তার আবেগ,উপস্থিতি আর অনুভূতি ঐ ছায়ার মানুষটার কাছে কতোটা বিরক্তিকর। কিন্তু,সানজিদের তো কিছু করার নেই। মাহাকে যে সে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসে। শেষবারের জন্য তাই মাহাকে দেখতে এসেছিল। একটা বৃত্তি পেয়েছে,কালই ডেনমার্ক চলে যাবে সে।

(৩) প্লেনে উঠে চুপচাপ বসে আছে সানজিদ। জানালার পাশে তার সিট। খানিকপরেই বিমান টেক অফ করবে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় সে। শেষ বিকেল।

আকাশটা নানা রঙ্গে রঙ্গিন হয়ে আছে। সে জানে,শেষ বিকেল মাহার খুবই পছন্দের মুহুর্ত। নিশ্চই ও এখন ছাদে আছে। ও কি জানবে,খানিক্ষণ পর ওদের ছাদ থেকে যে বিমানটা ও আকাশে উড়ে যেতে দেখবে,সেখানে সানজিদও আছে,যার মতো করে কেউ তাকে ভালোবাসে না?অনেক ঘটনাই হঠাত্ করে আলগোছে মনে পড়ে গেলো সানজিদের। যেদিন মাহা ভার্সিটিতে আসতো না,সেদিন যে রাস্তা দিয়ে ও টিউশনিতে যেত,সে রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা সানজিদ দাঁড়িয়ে থাকতো,মাহাকে একবার দেখবে বলে।

পরীক্ষার আগে প্রায়ই নিজে রাতজেগে নোট ও সাজেশান্স তৈরি করে ক্লাসে চুপিচুপিমাহার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতো। অবশ্য,মাহা মনে করতো ওগুলো সব রিফাতের কাজ। মেয়েটা বরাবরই একটু বোকা টাইপের। কিন্তু,নিজে সেটা জানেনা। পৃথিবীর কোনো বোকাই সেটা জানেনা! কাল খুবই কষ্ট পেয়েছে সানজিদ।

সে জানে মাহা হন্য হয়ে একটা চাকরি খোঁজছে। একটা চা কোম্পানির জুনিয়র ডিভিশনাল ম্যানেজার পদের জন্য একটা অফার লেটার নিয়ে গিয়েছিল মাহার জন্য। অনেক বেতন,সুযোগসুবিধা অনেক বেশি। তার ছোটচাচার মাধ্যমে অনেক ছুটোছুটি আর কষ্ট করে এটার ব্যবস্থা করেছিল সানজিদ। চেয়েছিল নিজেই সেটা মাহাকে দেবে।

কিন্তু,তাকে দেখেই মাহার চোখে মুখে একটা অদৃশ্য বিরক্তি সানজিদ ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। পরে ছাদে গিয়ে তো আর এলোই না মাহা। টেবিলের উপর অফার লেটার রেখে চলে এসেছে সে। পেটের বাম দিকের নিচের অংশে চাপ পড়ে হাল্কা ব্যাথা পেল সানজিদ। নাক,মুখ কুঁচকে ফেলল খানিকটা।

অপারেশনের রেশ এখনো কাটেনি পুরোপুরি। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে মেসেজ অপশনে গেল। মাহাকে একটা বিদায় বার্তা পাঠাতে ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে। লাউডস্পিকারে পাইলটের কন্ঠস্বর শোনা গেল। যাত্রীদেরকে মোবাইল ফোন সহ সকল ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস বন্ধ করার অনুরোধ জানালেন।

মেসেজটা মুছে দিয়ে মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে ফেললো সানজিদ। দরকার নেই মাহাকে এই মেসেজটা পাঠানোর। মেয়েটার কাছে এর মূল্য নেই। তা না হলে,তার প্রতি সানজিদের এই বিশাল অনুভূতির কিছুটা হলেও অনুভব করতো। আর পুরোটা অনুভব করলে সমস্ত পৃথিবীকে ভুলে গিয়ে সানজিদের হৃদয়ে চুপচাপ এসে লুকিয়ে থাকতো,কোথাও যেত না।

তার অসুস্থতার সময় বাঁচা মরা মুহুর্তে এই "ভাদাইম্যা" যে নিজের একটা কিডনিই দিয়ে দিল চুপিচুপি,সেই আবেগ বোঝার সামর্থ কি মাহার আছে?নিজের প্রিয় মোটর সাইকেল বিক্রি করে আর ব্যংক ঋণ নিয়ে মাহার চিকিত্সার প্রায় অর্ধেক খরচ চুপিচুপি ডাক্তারকে দিয়ে এসেছিল। তবে,এতো গোপনীয়তার মাঝেও নাফিসা টের পেয়ে গিয়েছিল। তার সাথে হাসপাতালে তখন প্রায়ই দেখা হতো। পরে অবশ্য জেনেছিল,ঐ ডাক্তার নাফিসার খালু হয়। তার কাছ থেকেই সম্ভবত জেনে গেছে কোনভাবে।

কাউকে কিছু না বলার জন্য নাফিসাকে রীতিমত স্রষ্টার নামে প্রতিজ্ঞা করিয়েছে সানজিদ। সানজিদের ভয় হয়,এটা কোনভাবে জানলে তার মতো ঐ কিডনির প্রতিও না বিরক্তি এসে যায় মাহার!এর চেয়ে বরং,কিডনির জন্য অজানা কারো প্রতি মাহার যে শ্রদ্ধা আর আবেগ তৈরি হয়েছে,সেটুকুর অংশ হয়েই মাহার মনে রয়ে যেতে চায় সানজিদ। প্লেন টেক অফ করেছে। জানালা দিয়ে নিচে তাকায় সানজিদ। শেষ বিকেলের আলোয় কি অসাধারণ লাগছে নিচের তার প্রিয় শহরটাকে।

সেই শহরের কোনো এক দালানের ছাদে তার প্রিয় মানুষটা বাতাসে এলোমেলো খোলাচুলে সূর্যাস্ত দেখছে আর নিজের জীবনের জন্য আজানা অচেনা কোন মানুষের মুখোশে ঢাকা সানজিদকেই কৃতজ্ঞাবশত গভীর আবেগে স্মরণ করছে,এটা ভাবতেই এই শেষ বিকেলে অপার্থিব এক তৃপ্তি তাকে ছোঁয়ে যায়! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।