আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মন্ত্রী মহসিন আলীর ক্ষমা প্রার্থনা ও সংসদ

১. দশম জাতীয় সংসদের অভিষেক ঘটতে যাচ্ছে আজ। বিকালে বসছে সংসদের প্রথম অধিবেশন। অধিবেশন বসার আগেই তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য প্রবীণ রাজনীতিবিদ সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলীকে নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক নেটওয়ার্ক ফেসবুকে তোলপাড় হয়ে গেল। সোমবার সিলেটে বিজিবির স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের সামনে মঞ্চে বসে প্রকাশ্যে ধূমপান করার কারণে সমালোচনার ঝড় ওঠে। আমাদের রাজনীতিতে ও শাসনব্যবস্থায় অনেকেই ভুল করেন, অনেকেই মহাভুল করেন, অনেকে অন্যায়ও করেন, কেউ কেউ প্রায় হাতেনাতে দুর্নীতিতে ধরাও পড়েন। গণমাধ্যম ও সমাজে বা রাজনীতিতে তাকে নিয়ে বিতর্ক উঠলে তিনি তার অবস্থানের পক্ষে সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে আত্দপক্ষ সমর্থনের নানা যুক্তি খোঁজেন। কথা বলেন। এক্ষেত্রে সৈয়দ মহসীন আলী একজন প্রকৃত রাজনীতিবিদ ও সাহসী মানুষের পরিচয়দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে গতকাল দিনের শুরুতেই সংবাদপত্রে নিজের ছবি ও খবর দেখে আত্দসমালোচনা এবং আত্দগ্লানিতে ভুগে জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে তিনি ছোট হননি, বড় হয়েছেন। শুধু নিজের ভুলই বুঝতে পারেননি, নিজের ভুলই স্বীকার করেননি, একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। তার এ দৃষ্টান্ত সমাজ ও রাজনীতিতে অনেকের জন্য অনুসরণীয়ই নয়, রীতিমতো ভুল বা অন্যায় করলে যে আত্দগ্লানিতে ক্ষমা চাওয়া উচিত সেই পথ দেখাল। অনেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করে, অনেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেমালুম চেপে যান। সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সাহস রাখেন না। সৈয়দ মহসীন আলী সেই কঠিন সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সাহস দেখালেন। এজন্য মানুষ তাকে এই চিরাচরিত অভ্যাসের বশে একটি স্কুলের অনুষ্ঠান মঞ্চে এসেও ধূমপান করার কারণে যেভাবে ক্ষমা চেয়েছেন তা কবুল করবে বলেই বিশ্বাস। একই সঙ্গে সৈয়দ মহসীন আলীর মতো মাঠের পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদদের সরকারের সূচনালগ্নেই এই ধাক্কা আগামী দিনে পথচলার জন্য, সতর্ক থাকার জন্য ভূমিকা রাখবে।

২. ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন, বিতর্ক অনেক। সেই বিতর্ক সহজেই তলানিতে যাবে না। ইতিহাসের অংশ হয়েই থাকবে। দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির বাইরে থাকা এবং দেড় শতাধিক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী বিজয়ের ঘটনা নজিরবিহীন হয়েই থাকবে। কিন্তু সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় এ নির্বাচন গ্রহণ করা ছাড়া মানুষের সামনে আর কোনো পথও ছিল না। অন্যদিকে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের মন্ত্রিসভার চেয়ে উজ্জ্বল বর্ণময় সরকার উপহার দেওয়ায় তা আলোচনায় ইতিবাচক রূপ নেয়। প্রথম দিন সচিবালয়ে গিয়ে সংবাদকর্মীদের সামনে সৈয়দ মহসীন আলীর 'হু ইজ বিএনপি' মন্তব্য তাকে যারা ভালো জানেন ও চেনেন তাদেরও ব্যথিত করেছে। বিএনপি এই দেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের জমানায় দুই দুইবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে। দেশের জনগণের বড় একটি অংশ এখনো বিএনপির সমর্থক। সিলেট বিভাগে বিএনপির অনেক সমর্থকও সৈয়দ মহসীন আলীকে পছন্দ করে। এমনকি বিএনপির শেষ শাসনামলে রাস্তা বড় করার নামে সৈয়দ মহসীন আলীর বাড়ির সীমানা প্রাচীর ভেঙে দেওয়া ছাড়াও তার কর্মীদের ওপর পুলিশি নির্যাতন নেমেছিল। মরহুম সাইফুর রহমান পুত্র নাসের রহমান এমপি হওয়ার সুবাদে ক্যাডার আর পুলিশ দিয়ে পৌর নির্বাচনে তার গণরায় ছিনতাই করা হয়েছিল। কিন্তু বিএনপির সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান মৌলভীবাজার পৌরসভার তিনবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান সৈয়দ মহসীন আলীকে ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন, সম্মানও করতেন। জীবনের শেষ নির্বাচনে পুত্রের ও দলের উন্মাসিক কর্মীদের কারণেই হয়তো সৈয়দ মহসীন আলীর কাছে পরাজয়বরণ করতে হয়েছে। সাইফুর রহমানের নামটি মৌলভীবাজারের উন্নয়নের সঙ্গেই নয়, মানুষের হৃদয়েও লেখা আছে।

৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য সৈয়দ মহসীন আলীকে যারা চেনেন তারা জানেন একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে তিনি গণমানুষের ভালোবাসায় অভিষিক্ত হয়েই রাজনীতির দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছেন। সুমহান মুক্তিযুদ্ধে এই বীর যোদ্ধার বীরত্বের গৌরব রয়েছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সাহসী ও নির্ভীক। মৌলভীবাজারের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনার এক বটছায়াই নন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও উদার পৃষ্ঠপোষক। রাজনীতিতে এসে কেউ কেউ বিত্তবৈভবের মালিক হন। সৈয়দ মহসীন আলী রাজনীতিতে এসে দিন দিন পারিবারিক বিত্তবৈভব ও সম্পদ খুইয়েছেন। লোভ-লালসা, আদর্শহীনতা তাকে টানেনি। মানুষের ভালোবাসাই টেনেছে। সৈয়দ মহসীন আলী শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে মৌলভীবাজারে জেলার কৃষকদের নিয়ে বিশাল আয়োজনে তিন দিনের সেমিনার, কর্মশালা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম সাইফুর রহমানের সঙ্গে ওই উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। দেখেছি তার মানুষের সঙ্গে কি নিবিড় সম্পর্ক! তার বাড়িতে যখন যারা আতিথেয়তা নিয়েছেন তার আশরাফ, আখলাক, আন্তরিকতা এবং দিলখোলা চরিত্র খুঁজে পেয়েছেন।

৪. সৈয়দ মহসীন আলী পাঁচটি ভাষায় কথা বলতে পারেন। গান গাইতে পারেন। তুখোড় আড্ডাবাজ উদারপন্থি মানুষটি একবার এক আড্ডায় মুক্তিযুদ্ধের গান গাইতে গাইতে তার সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়া শহীদদের স্মরণ করে অঝোরে কেঁদেছিলেন। তিনটি কন্যাসন্তান তাকে মায়ের মতো আগলে রাখে। কিন্তু তার প্রিয়তমা স্ত্রী বা সন্তানরা তাকে সিগারেট কখনো ছাড়াতে পারেননি। একসময় দিনে ১০ প্যাকেট বেনসন সিগারেট পান করতেন। আইনস্টাইন কতবার ছেড়েছেন আর কতবার ধরেছেন ক্যান্সারে মৃত্যুর আগে নিজের ধূমপানের নেশার বর্ণনা দিতে গিয়ে নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ উল্লেখ করেছেন। দিলি্লর এস্কট হাসপাতালে বিখ্যাত সার্জন তেহানের কাছে তার বাইপাস অপারেশন হয়। অতিমাত্রায় ডায়াবেটিস থাকার কারণে দেশে এসে তার ইনফেকশন হয়ে যায়। সেই সময় কিছু দিন ধূমপান থেকে বিরত ছিলেন। যতদূর জানি, ২৪ ঘণ্টায় এখনো তার ছয় প্যাকেট সিগারেট লাগে। কন্যারা বাবার রাজনীতির সুবাদে মানুষের সঙ্গে এতটাই একাত্দ যে ক্ষমতার মোহের চেয়ে মানুষের ভালোবাসা ও পিতার দীর্ঘায়ু কামনা করে এসেছেন। তার ভক্ত-স্বজনরা এতটাই তার প্রতি আসক্ত যে, ২০০৮ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তার আরেক দফা হার্ট অ্যাটাকে বারডেম হাসপাতালে প্রায় মাসখানেক সংজ্ঞাহীন ও লাইফ সাপোর্টে থাকার সময় তারা হাসপাতালের বারান্দায় এসে রাতযাপন করে। আল্লাহর রহমত ও মানুষের দোয়ায় তিনি বোনাস লাইফ নিয়ে ফিরে আসেন। তার কাছে অনুরোধ, যদি এবার মানুষকে উৎসাহিত করতে ধূমপানের অভ্যাসটি ছাড়েন তাহলে আরও বেশি আনন্দিত হই।

৫. '৯৭ সালে কাউন্সিলরদের ভোটে মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আরেক গণমানুষের নেতা আজিজুর রহমানকে চার ভোটে হারিয়ে সভাপতি নির্বাচিত হন সৈয়দ মহসীন আলী। দলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন বলেই সর্বশেষ জেলা সম্মেলনে মাত্র সাত ভোটে সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদের কাছে তিনি সভাপতির পদ হারান। আদর্শের প্রতি অবিচল সাধারণ মানুষের জন্য দয়ার শরীর সৈয়দ মহসীন আলীকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপযুক্ত মন্ত্রণালয়ই দিয়েছেন। আমরা আশা করব তিনি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আরও বেশি সজাগ-সতর্ক থাকবেন বলনে, চলনে। জীবনের পড়ন্ত বেলার বাকি দিনটুকুও সুনামের সঙ্গে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাবেন। ভুল মানুষেরই হয়, তিনি মানুষ। ভুল করেছেন, ক্ষমা চেয়েছেন। মানুষ নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু বার বার ভুল যেমন হতে নেই, তেমনি ক্ষমাও নয়। নিশ্চয়ই তিনি এবং তার সতীর্থরা মনে রাখবেন।

৬. পিতা রফিক উল্লাহ চৌধুরী পঞ্চাশ দশকের শেষ লগ্নে ছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি। এদেশের ছাত্র রাজনীতির গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছিল তাদের হাতে। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী রফিক উল্লাহ চৌধুরীর কন্যা ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী আবারও স্পিকারের দায়িত্ব পাচ্ছেন। বিগত সংসদের শেষ দিনগুলোতে স্পিকারের আসনে বসে তিনি মানুষের আস্থা ও সম্মান অর্জন করেছেন তার মেধা, প্রজ্ঞা ও সংসদ পরিচালনার মাধ্যমে। এই উচ্চ শিক্ষিত নারী আবার স্পিকার নির্বাচিত হওয়া ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। ডেপুটি স্পিকার হচ্ছেন অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া। সংসদে তিনি তার পারফরমেন্সে বার বার দেশবাসীর নজর কেড়েছেন। এরশাদের মন্ত্রী ছিলেন, নিশ্চয়ই ডেপুটি স্পিকার পদে দশম সংসদে দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করবেন।

৭. ষাটের ছাত্রলীগের রাজনীতিতে অভিষিক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা আদর্শের প্রতি অবিচল আ স ম ফিরোজ বার বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে দীর্ঘ অপেক্ষার পর হুইপের দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এবার চিফ হুইপ হয়েছেন। তার সঙ্গে হুইপ যারা হয়েছেন তারা আগেও সংসদে নির্বাচিত হয়েছেন। একটি নতুন টিম নিয়ে সংসদ পরিচালনায় নিশ্চয়ই দক্ষতার পরিচয় দেবেন। হুইপদের মধ্যে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দিনাজপুরের রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান ইকবালুর রহিম একজন নম্র, ভদ্র, বিনয়ী মানুষ হিসেবে নিশ্চয়ই তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়তে এই দায়িত্বকে কাজে লাগাতে পারবেন। বিরোধী দলের চিফ হুইপও হয়েছেন বার বার সংসদে আসা তাজুল ইসলাম চৌধুরী। এরশাদের মন্ত্রী ছিলেন।

৮. এরশাদের জাতীয় পার্টি শুরুতেই বিরোধী দলের আসন নিলেও সরকারের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে গেছে। এ জায়গা থেকে সরকারের সমালোচনা করে কার্যকর বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন কঠিন ও কষ্টসাধ্য হবে। সরকার ও বিরোধী দলকে বুঝতে হবে সরকারবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি সংসদের বাইরে রাজপথে রয়ে গেছে। সেখানে সংসদকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করতে এবারের সংসদের ট্রেজারি বেঞ্চ ও বিরোধী দলের জন্য অগি্নপরীক্ষার শামিল। নির্বাচন যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, সংসদে বিরোধী দলের আসনে যেখানে শাসকের অংশীদার সেখানে সংসদকে কতটা জনগণের আকাঙ্ক্ষার জায়গায় বিতর্ক ও আলোচনার পথে নিয়ে আস্থায় আনা যায় সেই চ্যালেঞ্জটি সরকারের জন্যই বড়। এক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি থেকে যেসব সংসদ সদস্য কণ্ঠ ছেড়ে কথা বলতে পারবেন তাদের সময় দিতে যেন কার্পণ্য হয় না। সরকারি দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের অনেককেও জাতীয় ইস্যুতে মুক্তমনে চিন্তার স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতে দিতে হবে। আমরা আশাবাদী সংসদের যাত্রা শুভ হবে এবং আগামী দিনে সংসদের বাইরেও বিএনপির সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে বিদ্যমান সংকট এবং অস্থিরতা নিরসনের পথ বের হবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.