লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই,তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। (http://www.ishakkhan.blogspot.com)
উঠবে, নাকি নাকের ফুটো দিয়ে চা ঢেলে দেবো?
আমি চোখ মুছতে মুছতে ধড়মড় করে উঠে বসি। বলি, কি কুৎসিত কথা! তুমি না টিচার? এসব অশিষ্ট বাক্য তোমার মুখে মানায়?
রাণী মোটেও বিব্রত হয় না, চায়ের মগে চুমুক দিতে দিতে বলে, টিচার বলেই তো জানি সবাইকে কীভাবে কন্ট্রোল করতে হয়।
ছেলেমেয়েদের পড়াতে পড়াতে অভ্যেস হয়ে গেছে।
আবার তাড়া দেয় সে, এবার ঝটপট ওঠো। নাস্তা করতে হবে, বেরুতে হবে। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।
আমার আর আরাম করে প্রাতঃকৃত্য করা হয় না।
কোনমতে সব সারতে হয়, ঝড়ের গতিতে। বাথরুমে থাকতে থাকতেই বারকয়েক সে ডাকাডাকি করে।
বেরিয়ে এসে দেখি, আমার জন্যও এক কাপ চা নাস্তার পাশেই পিরিচে ঢাকা অবস্থায় অপেক্ষা করছে।
পাউরুটি-মাখনের পর চায়ের কাপে চুমুক দিই, এবং বলি, কেমন পানসে পানসে। চিনি কম হয়েছে।
রাণী ঠকাস করে নামিয়ে রাখে ওর চায়ের মগ। কড়া চোখে তাকিয়ে থাকে।
আমি আরেক চুমুক দিলাম, বললাম, মজা করলাম। এত রেগে যাও কেন?
সে বলে, চা বানানো আমার কাছে একটা প্রেস্টিজ ইস্যু। এটা নিয়ে আমার সাথে মজা করবে না।
আচ্ছা। সরি। আর করবো না।
রোজ একইভাবে ওকে রাগ করিয়ে দিতে আমার ভালো লাগে। তার চেয়েও ভালো লাগে, সরি বলে ওর রাগ ভাঙাতে।
সে দ্রুত রেগে যায়, আবার দ্রুতই ভুলে যায়।
একসাথে বেরুলাম আমরা। রোজই বেরুই। ওকে ড্রপ করে দিয়ে অফিসে যাই।
গান ছাড়তেই সে অভিযোগ করে, এসব মাথা ধরে যাওয়া, তারছেঁড়া গান শুনতে ভালো লাগে? বন্ধ কর তো।
আমাকে বন্ধ করতে হয় না, সে নিজেই বন্ধ করে। বলে, তার চেয়ে আমার সাথে কথা বল।
আমি বলি, আমার রুচি তারছেঁড়া? অথচ বিয়ের আগে এসবই তোমার পছন্দ ছিল।
সে সাথে সাথে জবাব দেয়, আগে ছিল, এখন থাকবে এমন তো কোন কথা নেই। এখন এগুলো সব তারছেঁড়া।
আসলে আমার সাথে দ্বিমত করতে তোমার খুব ভালো লাগে। আসলে তোমারও এই গানগুলোই পছন্দ, আমাকে খেপিয়ে দিতে হবে, তাই ঝগড়া করা।
এই তো আমার বর খুব বুঝতে পেরেছে। গুটুগুটু। জিব বের করে সে ভেংচি কেটে দেয় আমাকে।
আমি হাসি। এখনো ছেলেমানুষি যায় নি। কে বলবে, সে কলেজের ছেলেমেয়েদেরকে পড়ায়?
দশ মিনিটের পথ আধঘণ্টা লাগলো। ওর কলেজের সামনে এসে থামলাম। আজ কপাল ভালো।
এমনিতে এক ঘণ্টা লাগে।
সে বেরিয়ে যাবার আগে আমার গাল টেনে দিলো। বলল, যাই।
কিছুদূর গিয়েছে, আমি ডাকলাম, রাণী, শোন।
সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, কী?
যেন আমার ডাকের জন্যই অপেক্ষা করছিল।
বললাম, আজ তো বৃহস্পতিবার।
সে ঠোঁটে একটা বিচিত্র ভঙ্গী করে বলে, হ্যাঁ। তো?
কাজেই ... ... আমি থেমে যাই। বাকিটা নিশ্চয়ই সে বলবে।
কিন্তু সে বলে না।
আমাকে অনুকরণ করেই বলে, কাজেই ... ... ?
আমি হাল ছেড়ে দিই। বলি, কাজেই আজ আমাদের বাইরে খাবার কথা।
এবার ওর মুখে হাসি ফোটে। বলে, মনে রেখেছ, তাই মাফ করে দিলাম। নইলে আজ তোমাকে ... ...
আমিও কম যাই না।
ফোনটা বের করে নাড়তে নাড়তে বললাম, আমি এখন আর কিছু ভুলে যাই না। এখানে সব নোট করা থাকে।
ভালো। যাই। ঠিক তিনটার সময় অপেক্ষা করবো।
দেরী হলে খবর আছে।
আচ্ছা। বাই।
আমি গাড়ি ঘোরাতে স্টার্ট দিই, রাণী বিল্ডিঙয়ের ভেতর ঢুকে যায়।
কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ড এবার এগিয়ে আসে।
সে কিছু বলার আগেই আমি বলি, দু’মিনিট গাড়ি দাঁড় করিয়েছি মাত্র, তাতে এমন কী সমস্যা হয়েছে? এখুনি চলে যাচ্ছি।
গার্ড আর কিছু বলে না। প্রতিদিন রাণী ভেতরে চলে যাবার পর এই পেটমোটা গার্ড কটমট চেহারা করে এগিয়ে আসে, এবং কিছু বলার আগেই আমি পিছলে বেরিয়ে যাই।
অফিসে পৌঁছে একটু বসতে না বসতেই ফোন। রাণী।
হ্যালো।
পৌঁছেছ?
হ্যাঁ। আরে, মাত্র বিশ মিনিট আগেই তো তোমার সাথে কথা হল।
তারপরও আমার চিন্তা হয়।
উফ! জ্বালিয়ে মারছ।
রাণী এবার রেগে যায়, আমি ছাড়া তোমার খবর আর কে নেয়? কার এত ঠেকা পড়েছে? বেশী বাড়াবাড়ি করলে আমি ফোন বন্ধ করে রাখবো, বাসায় ফিরব না। একদম খুঁজে পাবে না। তখন টের পাবে।
আমাকে অগত্যা আবার সরি বলতে হয়। আচ্ছা, ওকে।
সরি। ঠিকঠাক পৌঁছেছি, পথে কোন অসুবিধা হয় নি। অ্যাক্সিডেন্ট করে কোথাও মরে পড়ে থাকলে এতক্ষণে খবর পেয়ে যেতে।
সে ধমকে ওঠে, বাজে কথা বলছ আবার!
আমি আবার বলি, সরি!
রাণীর কাজ হল কথায় কথায় ক্ষেপে যাওয়া। রাগ ভাঙানোর একটা উপায়ই আমি জানি, সরি বলা! নিশ্চয়ই নানারকম রোম্যান্টিক উপায় আছে রাগ ভাঙানোর, তবে ওসব জানি না বলে সরি বলি সব ক্ষেত্রে।
কখনো হালকা গলায়, কখনো ভারী গলায়, কখনো মিহি গলায়, কখনো খসখসে গলায় সরি বলে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করি! এবং খেয়াল করেছি, সবক্ষেত্রেই কাজ হয়। হয়তো রাণী তৈরিই হয়ে থাকে আবার আমার ওপর খুশি হয়ে ওঠার জন্য।
আমি জানি, সে ক্লাসের গ্যাপে আরও বারদুয়েক ফোন করবে এবং চেক করবে আমি ঠিকঠাক বেঁচে আছি কীনা।
মুখে অনেক অনুযোগ করি ব্যাপারটা নিয়ে। বলি, কলিগরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, বউ এতবার খোঁজ নেয় বলে।
তবে রাণী শোনে না। সে বারবার আমার খোঁজ নেবে। কী খেয়েছ? কী করছ? ঠাণ্ডা পানি খাও নি তো? – এসব ব্যাপার।
মুখে যতই বলি না কেন, এই ছোট্ট ফোন কলগুলোর জন্য ওর কাছে আমি খুব কৃতজ্ঞ। কারণ, ও যেমন জানে, আমিও জানি, ও ছাড়া এতবার আমার খোঁজ করার কেউ নেই।
আমি ওকে ডাকি রাণী বলে। আমার মোবাইল ফোনে ওর নম্বর সেভ করা আছে ‘রাণী’ নামেই। তবে রাণী ওর আসল নাম নয়, এবং আমি ছাড়া ওকে আর কেউ এ নামে ডাকে না।
ওর লম্বাচওড়া একটা প্রাতিষ্ঠানিক নাম আছে। এবং সে নামটি খুব খারাপ নয়।
কিন্তু বিয়ের পর পরই ওকে বলেছিলাম, আমি তোমাকে ডাকবো রাণী বলে।
সে জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন?
আমি ওকে গম্ভীরভাবে ব্যাখ্যা করেছিলাম, হার্টস খেলতে পারো?
সে বলল, না। কখনো কার্ড খেলি নি।
আমি বললাম, তারপরও ব্যাখ্যাটা শোন। হার্টস খেলা হয় মোট ছাব্বিশ পয়েন্টে।
তেরোটা কার্ডের এক পয়েন্ট এক পয়েন্ট করে মোট তেরো পয়েন্ট।
সে জিজ্ঞাসা করলো, আর বাকি তেরো পয়েন্ট?
বাকি তেরো পয়েন্ট হল স্পেডের কুইনের। ইস্কাপনের রাণীর।
একাই?
হ্যাঁ। একাই তেরো পয়েন্ট।
সবাই মিলে তেরো, আর সে একাই তেরো।
একটু দম নিয়ে বললাম, তাই এখন থেকে তোমাকে রাণী বলে ডাকবো। তুমি হলে আমার ইস্কাপনের রাণী।
সে ঠোঁট কামড়ে ব্যাপারটা কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বেশ রেগে গেলো, সামান্য একটা কার্ডের সাথে ওর তুলনা হচ্ছে বলে।
কিন্তু তারপরই আবার বলল, বেশ, ঐ নামে আমার কোন আপত্তি নেই।
নিজেকে ‘রাণী’ ভেবে সে নিশ্চয়ই খুশি আছে! আর নামটি তো শুনতে খারাপ লাগে না। কেমন আদুরে আদুরে নাম। তবে রাণী না বলে “ইস্কাপনের রাণী” বললে খুব ক্ষেপে যায়। বারকয়েক চেষ্টা করে ধমক খেয়েছি।
ঠিক তিনটার মধ্যে পৌঁছনোর প্রাণপণ চেষ্টা করলাম, তবে শেষ রক্ষা হল না। দেড় মিনিট দেরীতে পৌঁছলাম।
সে গাড়িতে ঢুকে বসলো, এবং ধমকে উঠলো, এত দেরী হয় কেন? কার সাথে প্রেম করছিলে? তোমার অফিসের সুন্দরী মিস মোনা ছাড়ছিল না?
আমি হাসলাম। বলতে চেষ্টা করলাম, জ্যাম ... ...
সে ভেংচি কেটে বলল, জ্যাম! আমি যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামছিলাম?
আমি বলি, রোজ এখানে দাঁড়াবার দরকার কী? একটু ছায়ায় গিয়ে বসলে তো পারো।
কেন বসবো? আমি রোদে পুড়বো, তারপর তোমাকে এটা নিয়ে কথা শোনাবো।
দু’জনই হেসে ফেলি।
আজ ওর পছন্দের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি। শুধু আজ নয়, নব্বই ভাগ সময়েই ওর পছন্দের জায়গায় যাওয়া হয়। সে হল “রাণী”, ও যেখানে বলবে, যেভাবে বলবে, সেখানে এবং সেভাবেই তো যেতে হবে। ঢাকার অলিগলিতে লুকিয়ে থাকা কোন রেস্টুরেন্টে কোন আইটেম খুব মজার, এসব মূল্যবান তথ্য সে যখন ভার্সিটিতে পড়ত, তখন বন্ধুদের সাথে ঘুরে ঘুরে জোগাড় করেছে।
সব ক্ষেত্রে যে তার রুচি খারাপ তা নয়, বরং কিছু রেস্তোরাঁয় দুর্লভ কিছু খাবার পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে।
দুপুরে একসাথে খাওয়া হল, বিকেলে কিছুক্ষণ ঘুরলাম। সর্বক্ষণ সে আমাকে ধরে রাখে। আমি বলি, ওরকম করছ কেন? আমি কি বাচ্চা ছেলে, ছেলেধরা নিয়ে যাবে?
সে বলে, বাচ্চা ছেলে নও, তবে কেউ যাতে নিয়ে যেতে না পারে, সেজন্যই ধরে রাখি। ঐ দ্যাখো, ঐ মেয়েটা কেমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে এদিকে।
আমি হেসে বলি, পাগল!
তার জবাব যেন তৈরিই ছিল। বলে, যখন থাকবো না, তখন এই পাগলামিগুলোর জন্যই কান্নাকাটি করবে।
দেখা যাবে। আর আমি তোমার আগে মরলে?
আবার বাজে কথা? নিমেষেই ওর চোখ দুটো কড়া হয়ে ওঠে।
বাহ, তুমি বললে কিছু হয় না, আমি বললেই বাজে কথা?
সে এবার নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে।
ঝাঁঝের সাথে বলে, একটাও কথা না, একদম চুপ!
আমি চুপ হয়ে যাই। সে আবার আমাকে বগলদাবা করে হাঁটতে থাকে।
তুমি তো কোন চ্যানেলেই দাঁড়াচ্ছ না। এত দ্রুত পাল্টালে কী হচ্ছে তাই তো বুঝবে না।
দাঁড়াও, রাণী গম্ভীর মুখে বলে।
আগে সবক’টা চ্যানেল ঘুরে আসি, তারপর একটা দেখবো। ডিস্টার্ব কোরো না তো।
আমি সোফার পেছনে হেলান দিয়ে বসি। রিমোটের দখল একবার ওর হাতে গেলে আর পাবার আশা নেই।
তারপরও একবার শেষ চেষ্টা করি, লিভারপুলের খেলা হচ্ছে ... ...
আহ, রেজাল্ট কাল পেপারে দেখে নিও।
খালি ছোটাছুটি দেখার কী আছে?
আমার শেষ আশাও শেষ হয়ে যায়। রাণী বসে বসে জমিয়ে টিভি দেখছে। একটা নাটক। দেখার কিছু নেই, কিন্তু তার সে কি আগ্রহ। ওর যুক্তি হল, যতটুকু বিনোদন করা হয়, মন দিয়ে করা উচিৎ!
অগত্যা আমি মনোযোগ দিয়ে ওর টিভি দেখা দেখি!
এই!
কী?
ঘুমিয়েছ?
না।
ঘুমিয়ে পড়লে জবাব দিচ্ছি কী করে?
রাতদুপুরে আবার তর্ক শুরু করলে?
তুমি একজন টিচার হয়ে অযৌক্তিক প্রশ্ন করবে, আর আমি সেটা বলতে পারবো না?
আমি টিচার, তোমার খুব হিংসে হয়, না? হিংসুট!
খুব। এই দ্যাখো, হিংসের চোটে শরীর জ্বালাপোড়া করছে।
দেখো, ঘুমোবার আগে রাগাবে না বলছি।
আচ্ছা, সরি। ভুল হয়ে গেছে।
একটু পর আবারঃ
এই!
কী?
একটা গল্প বল না? ঘুম আসছে না তো।
কীসের গল্প শুনবে? ভূতের?
আমি কি বাচ্চা মেয়ে? ভূতের গল্প শুনবো কেন?
আমি কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসি। ওর দিকে তাকিয়ে বলি, ভূতের গল্প মানেই যে বাচ্চাদের গল্প তা নয়। অনেক ভূতের গল্পে যথেষ্ট অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট আছে, এবং শুনে ছেলেবুড়ো সবারই হাত-পা পেটের মধ্যে ঢুকে যায়।
সারাদিনে আমার চার-পাঁচটা লেকচার দিতে হয়।
তুমি এখন প্লিজ লেকচার দেবে না। বলার মত গল্প থাকলে বল। আচ্ছা, ভূতের গল্পই বল, দেখি ভয় পাই কীনা। তোমার বলার যা স্টাইল, আমি নিশ্চিত, ভয় পাবার বদলে কয়েকবার হেসে ফেলব।
আমি ভূতের গল্প শুরু করি।
রাণী আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। আমি জানি, সে খুব ভয় পাচ্ছে, কিন্তু মোটেই স্বীকার করবে না।
*****
রাত সাড়ে বারোটা। আমি বিছানায় বসে আছি, পা নামিয়ে। একই সাথে ঘুমোতে চাইছি, আবার জোরে জোরে মুখ ঘষে ঘুম তাড়াতে চাইছি।
চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছে।
দেয়ালের ছবি থেকে চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে আছে রাণী।
আমি বড্ড ক্লান্ত।
হ্যাঁ, সকাল থেকে রাত অবধি ডাবল পার্ট প্লে করতে করতে আমি ক্লান্ত।
মিছেই দু’কাপ চা বানাতে বানাতে আমি ক্লান্ত।
এক কাপ চা খাওয়া হয়, আর রাণীর চায়ের মগে সর পড়ে যায়। কেউ ছুঁয়েও দেখে না।
রোজ সকালে রাণীর কলেজের সামনে কিছুক্ষণের জন্য গাড়ির প্যাসেঞ্জার সীটের দরজাটা খুলে দিতে দিতে ক্লান্ত।
অফিসে বারতিনেক ওর ফোন পাবার অভিনয় করতে করতে আমি ক্লান্ত। যে নম্বরটি চিরকালের জন্য “আর ব্যবহৃত হচ্ছে না” এর খাতায় চলে গেছে, সেটি সেভ করে রেখেছি আজও।
সামান্য একটি এগারো ডিজিটের নম্বর, অথচ কি বিপুল ভার নিয়ে আমার ওপর চেপে বসে আছে!
সে আমাকে অষ্টপ্রহর গভীর মমতায় জড়িয়ে রেখেছে, আমার জন্য উৎকণ্ঠায় ভুগছে, এই ভাবতে ভাবতে আমি ক্লান্ত।
রেস্টুরেন্টে আমি যাই একা, কিন্তু সবসময় দু’জনের খাবার অর্ডার দিতে দিতে আমি ক্লান্ত।
বিকেলে কেউ আমার হাত ধরে হাঁটে না, তবুও তার সাথে কথোপকথন চালাতে চালাতে আমি ক্লান্ত।
রাতে কারো কাছ থেকে রিমোট পেতে সাধ্যসাধনা করতে হয় না। লিভারপুলের সবগুলো খেলা আমি চাইলেই দেখতে পারি, তবুও বৃথাই সবগুলো চ্যানেলে ঘুরতে ঘুরতে আমি ক্লান্ত।
রাণী আমাকে জড়িয়ে ধরে রোজ রাতে ভূতের গল্প শুনছে, আর মাঝপথে এসে বলছে, “খুব ভয় লাগছে, আর বোলো না প্লিজ” – এই ভেবে আমি ক্লান্ত।
আমি কাঁদতে পারি না। হাসপাতালের বেডে অসহনীয় যন্ত্রণায় আমার এক হাত জড়িয়ে ধরে সে যখন ছটফট করতে করতে মারা যাচ্ছিল, তখন আমি কাঁদি নি। অন্য দিকে চোখ ফিরিয়েও রাখি নি। ওর মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম, আর দেখছিলাম, প্রাণপণে সে চাইছে আমার কাছে থাকতে, পারছে না, প্রতি মুহূর্তে কেউ একজন টেনেহিঁচড়ে ওকে নিয়ে যাচ্ছে, আমার কাছ থেকে অনেক দূরে।
যখন শক্ত করে আমার হাত জড়িয়ে রাখা ওর হাতটা শিথিল হয়ে এলো, আমার কব্জিতে দাগ ফেলে দেয়া ওর হাতটা যখন হার মেনে লুটিয়ে পড়ল, যখন ওর চোখের আলো নিভে গেলো, যখন ওর শরীর হল নিথর, ঠাণ্ডা, নিস্পন্দ – তখনো আমি কাঁদি নি।
শুধু চোখ জ্বালা করেছিল। চোখ জ্বালা করাই আমার কান্না।
আমি ছাড়া বাকি সবাই - আমার বাবা-মা, ওর বাবা-মা, সবাই কেঁদেছিলেন। রাণী মরে যাচ্ছে, যার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল সবাইকে হাসিখুশি আর মমতায় ভরিয়ে রাখার, সেই উচ্ছল তরুণীটি আর থাকছে না – এই ভেবে সবাই কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন।
আমি ছাড়া।
আমি কাঁদি নি। নিজেকে অভয় দিয়েছি, রাণী চলে যাচ্ছে না, ও আমার সাথেই থাকছে। আমি কল্পনা করে নিলেই হবে যে সে আমার সাথেই আছে।
সেই থেকে আজ দু’বছর, প্রায় সাতশো তিরিশ দিন আমি ডাবল পার্ট প্লে করে চলেছি।
দ্বৈত চরিত্রে অভিনয়। আর এই করতে করতে বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি।
আমি পাকা অভিনেতা নিশ্চয়ই। একবারও ভুল হয় না, কোথাও খেই হারিয়ে বসি না। রোজ সকালেই দু’কাপ চা বানানো হচ্ছে, রাণীকে ওর কলেজে ড্রপ করে দিয়ে আসা হচ্ছে, ওকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া হচ্ছে, বিকেলে বেড়ানো হচ্ছে, ভূতের গল্প শোনানো হচ্ছে।
না হয় একাই সব করে যাচ্ছি, তাতে কী?
কিন্তু গভীর রাতে সব এলোমেলো হয়ে যায়। আবিষ্কার করি, বিছানায় আমি একা, এবং দেয়ালে ঝোলানো ছবি থেকে একই ভঙ্গিতে, স্থিরদৃষ্টিতে রাণী আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নিষ্ঠুর সত্যটা কয়েকশো গুণ কুৎসিত হয়ে সামনে দাঁড়ায়, রাণী আর নেই। আমার সামনে প্রেতের মত বিলাপ করে, রাণী নেই। তুমি মিথ্যে কল্পনা করছ।
ভীষণ চোখ জ্বালা করে। কাঁদতে পারি না বলে ধরে নিই চশমায় সমস্যা হয়েছে।
আমার আপনজনদের কাছে আমি খুব কৃতজ্ঞ। দু’বছর ধরে তাঁরা সব লক্ষ করছেন, কিন্তু কিছু বলছেন না। একবারও বলেন নি যে আমার সামলে ওঠা উচিৎ, জীবন নতুন করে শুরু করা উচিৎ, এসব নিতান্তই ছেলেমানুষি কিংবা পাগলামি হচ্ছে ইত্যাদি।
আমার জন্য কোন মানসিক রোগের ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্টও নেন নি। হয়তো এখনো নগ্ন হয়ে রাস্তায় নেমে গাড়ি ভাঙচুর শুরু করিনি, এতেই তাঁরা কৃতজ্ঞ।
আমি কৃতজ্ঞ যে আমার রাণীর সাথেই আমাকে তাঁরা বাস করতে দিচ্ছেন। কৃতজ্ঞ রাণীর কলেজের সেই সিকিউরিটি গার্ডের কাছেও, যে আমার দিকে এগিয়ে আসে রোজ সকালে, গাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই দেখেও কিছু বলে না।
ভীষণ ক্লান্ত বোধ করি।
সবকিছুই দু’জনের পক্ষ থেকে করতে হয় তো। আমার এবং রাণীর কাজ আমাকেই করতে হয়। এমনকি আমার কথার জবাবগুলোও আমাকেই দিতে হয়, যেহেতু আমার ইস্কাপনের রাণী নেই। আর কতদিন এভাবে চালিয়ে যেতে পারবো জানি না।
একটু সময়ের জন্য হলেও যদি আমার রাণী এসে আমাকে এই দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় থেকে মুক্তি দিত, একবার সকালে ঘুম ভাঙাত, একটু গল্প শুনতে চাইত, একটু মান-অভিমান করত, একটু রেগে যেত, আরেকবার আমাকে ‘সরি’ বলতে দিত, আরেকবার ফোন করে কী করছি জিজ্ঞাসা করত, পরিচিত ভঙ্গিতে ঠোঁট টিপে হাসতো, তাহলে সত্যিই ভারমুক্ত হতাম।
(১৯ অক্টোবর, ২০১৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।