mail.aronno@gmail.com
১.
একটা চটের ব্যাগ, যা আমি সাথে নিয়ে ঘুরি, তাতে দুটো জিনিস সবসময়ই থাকে। এক. র্যাবোর ‘নরকে এক ঋতু’, দুই. ধুসর রঙয়ের একটি নোটবুক। র্যাবো, পারতপক্ষে পড়ি না; কেবল বইটির ছেচল্লিশ নম্বর পাতায় লেখা একটি চিঠির বিভিন্ন অংশ পড়ি মাঝে মাঝে। যেমন আজ সকালে পড়া অংশটুকু এমন, ‘পিরামিড দেখার ইচ্ছে আমার মরে গেছে, ঠিক সেভাবেই, যেভাবে একদিন লোমপোষাকে মাথা ঢেকে তাড়া করতে চেয়েছিলাম মেরুভাল্লুক। ‘স্লেজ চালানোর বিদ্যে আমার জানা ছিল না, যে মৃত কুকুরেরা টেনে নিয়ে গিয়েছিল আমায় ‘স্নেহ-ধূসর বরফ-নৈরাজ্যে, তাদের আত্মা আজও পাহারা দেয় আমার ঘুম-দরজা’।
আর নোটবুকটা এতটাই জরুরী যে, মাঝে মধ্যেই তা বের করতে হয়; কখনওবা নিতান্তই কাটাকুটির প্রয়োজনে, আবার কখনও নতুন কিছু লাইন যোগ করতে। কখন কোন চরিত্রটি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল, কোন প্রেমিকার নাম মোছা দরকার, নতুন কাকে এ সপ্তাহে বা মাসে প্রাধান্য দেয়া জরুরী, কিংবা কোন পতিতা এ সপ্তাহে রেট বেশি নিয়েছে অথবা অসম্মতি জানিয়েছে, সব টুকে রাখতে হয় নির্ভুলভাবে। প্রায় তিনশ’ পাতার নোটবুকটির দুশ’ দশ পাতা জুড়ে শুধু কাটাকাটি আর কাটাকাটি, কেবল একানব্বই পাতায় কোনো কাটাকুটি বা বাড়তি দাগ অব্দি নেই। যেভাবে লেখা হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই রয়ে গেছে এতগুলো বছর। আমি পাতাটি বের করে রোজ ভাবি, একদিন অন্যান্য পাতার মতো এ পাতার সব কেটে দিয়ে লিখে রাখব নিজের লেখা কবিতার দুটো লাইন, তারপর নিজেকে বলব, ‘সমস্ত দেনা-পাওনা পরিশোধ হলে মানুষ নিতান্তই এক ভিখেরি’।
পারিনি, বরং যতবার সেখানে কলম ধরেছি বা ধরতে চেয়েছি, ততবারই হাত কেঁপেছে, এবং প্রতিবারই বাধ্য হয়েছি সেখানে কিছু লেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে। যদিও পরে মনে হয়েছে, এ আমার নিজেরই তৈরী অক্ষমতা, যা নিজের অজান্তেই লালন করে চলেছি বছরের পর বছর সমস্ত সততা ও হৃদয় দিয়ে। অথচ আমার ক্ষেত্রে এমনটি না ঘটাই ছিল স্বাভাবিক। তারপরও যখন দেখি এত বছরেও পারিনি সেখানে কলম চালাতে, তখন হাসি পায়, এবং নিজের প্রতি ছুঁড়ে দেয়া নিজেরই করুণাগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা লিখে রাখি নোটবুকের অন্যান্য পাতা জুড়ে, যেখানে প্রায়শঃ কাটাকুটি হয়, যার নিচে প্রতিবারই চাপা পড়ে যায় আমার অক্ষম হাসির যাবতীয় প্রতিধ্বনি।
‘আমার বন্ধু নেই’, কথাটি রোজ একবার করে লিখি নোটবুকে, আর লেখার পরপর-ই ইচ্ছে হয়, ‘নরকে এক ঋতু’ পড়ে ফেলতে।
অথচ হয় না! কিছু কিছু বই হয়ত সেভাবেই লেখা, যা পড়ার জন্য এক জীবন যথেষ্ট নয়। যদিও কাব্য নিয়ে মহোত্তর কোনো উপলব্ধি কখনোই আমরা ছিলনা, এবং নির্বিকার এক অনুভূতি থেকে কবিতা লেখার যেসব ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছিলাম কয়েক বছর, তা ম্লান হয়ে গেছে ছেচল্লিশ নম্বর পাতার কাছে। তাই নোটবুক লিখি, যেখানে আমার জীবনে ঢুকে পড়া চরিত্রগুলো প্রতিনিয়ত হারিয়ে যায়, আর সেখানে ফিরে আসে নতুন আরেকটি চরিত্র, নাম কিংবা কেবলই অস্তিত্ব। লক্ষ্য করেছি, হারিয়ে যাওয়া চরিত্রগুলোর প্রতি আমার কোনো মায়া নেই, এবং যখন তাদের সম্পর্কে লিখতে বসি, তখন কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া হয় না, কেমন যেন নিস্পৃহভাবে নিয়ে লিখে যাই। অনেকটাই গাছের মতো, দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই, কে এল, কে গেল, হুশ নেই!
২.
গতরাতে মিলি নামটা কেটে তার নীচে লিখেছি তনু নামের পতিতার নাম।
এই প্রথম এত অল্প সময়ে কোনো নাম কাটা পড়ল নোটবুক থেকে। মাত্র চারদিনের মাথায় ওর নামা কেটে তনু নামটি লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম, কেননা অন্যান্য প্রেমিকাদের মতো সেও ব্যর্থ হয়েছিল আমাকে এ বোধে উন্নীত করতে, যে ওর পরিছন্ন একটা মুখ আছে, যেখানে তাকালে মনে হয়, সুপ্রাচীন, শান্ত, বিশাল এক দীঘির সামনে দাঁড়িয়ে। ফলে নোটবুকের বাকি পাতাগুলো আমি খুব সহজেই বরাদ্দ করতে পারি যে কোনো নামের পতিতাকে।
অবিশ্বাস ক্রমশঃ প্রলম্বিত হতে থাকা যন্ত্রণার মতো, অথচ আমার কাছে তা শান্তির। যেসব রাত আমি বাইরে কাটাই না, সেসব রাতে ঘরের মধ্যে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে, আলো নিভিয়ে সারা রাত বসে থাকি।
কোনো এক অজানা অপেক্ষার প্রহর রাতভর আমাকে গান শুনিয়ে যায়, আর চারপাশে ভেসে থাকা সেই সুরের তালে চেয়ারের হাতলে আঙুল ঠুকি। অদ্ভুত ভাললাগা সারারাত আচ্ছন্ন করে রাখে, আর ভোরবেলা দিনের প্রথম আলোয় সেই ভাললাগাটুকু সাথে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ দিকভ্রান্তের মতো হাঁটার পর মনে হয় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না! নিজের ওপর রাগ হয়, মনে হয় আঙুল দিয়ে গেলে বের করে আনি চোখের মণি, তারপর সেগুলো দিয়ে দিই সেই সব শিশুদের, যারা এই সাত-সকালে বেরিয়ে পড়েছে ঘর ছেড়ে। অথচ ভয় হয়, হয়ত ওরা তাচ্ছিল্যভরে সেগুলো ছুঁড়ে ফেলবে নর্দমায়, আর তা দেখে আমি নির্লজ্জের মত ছুটে যাব, তন্ন তন্ন করে খুঁজব, অথচ পাব না, আর অসহায়ের মত পুনরায় ফিরে আসব ঘরে রোজকার সেই একই অন্ধত্ব নিয়ে, যা কিনা আমি নিজেই গ্রহণ করেছিলাম, আক্রোশে!
গত মাসে দেড়শ’ টাকা দিয়ে একটা লাঠি কিনেছি, ঠিক অন্ধরা যেমন লাঠির সাহয্যে চলাফেরা করে। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, একটানা অন্ধকারের মধ্যে শুধুমাত্র একটি লাঠির অস্তিত্ব কীভাবে হয়ে ওঠে প্রবল ও সংশয়হীন।
আমার এই ইচ্ছেটা জেগেছিল মনিকার সাথে ছয়দিন থেকে। আমার জানা সেই একমাত্র পতিতা যাকে দেখেছি নিয়মমাফিক ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে। যত রাতই হোক না কেন ঘুমাতে, প্রতিদিন ভোর বেলা উঠে যেত বিছানা ছেড়ে। তারপর স্নান করে পূঁজা-অর্চনা শেষে, ভেজা চুলে একহাতে প্রসাদ, অন্যহাতে চায়ের কাপ নিয়ে এসে দাঁড়াত সামনে। সেই ছয়দিন রোজ আমি ওর পূঁজা-অর্চনা শুনতাম, আর যখন ওভাবে এসে ও সামনে দাঁড়াত, তখন মনে হত, এরপর মার্কেটে গেলে অবশ্যই একটা লাটি কিনব যা অন্ধরা ব্যবহার করে।
সাধারণত নোটবুকের নামগুলো আমি এমনভাবে কাটি, যেন সেগুলো আর কোনভাবেই পড়া না যায়। শুধু মনিকার নামটা কেটেছিলাম একটানে, কারণ আমি জানতাম, কোনো না কোনো দিন সত্যি সত্যিই আমাকে কিনতে হবে অন্ধদের লাঠি। হয়ত এত বছর ধরে জমা হওয়া অজস্র প্রশ্নেগুলোর কোনো একটার উত্তর পেয়ে যাব, এই আশায়।
না, কোন প্রশ্নেরই উত্তর পাইনি। বরং উত্তর খুঁজতে গেলেই সাতবছর আগে দেখা যবুকটির মুখ মনে পড়ে।
একদিন সকালে অফিস যাবার পথে, লম্বা, ছিপছিপে, প্রায় আমারই সমবয়সি এক যুবক হাত পেতে বলেছিল, ‘ভাই দুটো টাকা কিংবা একটা সিগারেট দেবেন? প্রশ্ন শুনে চমকে উঠেছিলাম, এবং ওকে আপাদ-মস্তক দেখতে দেখতে প্রতিউত্তর না করেই পাঁচটাকার নোট বাড়িয়ে ধরেছিলাম। ও টাকাটা নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতেই পেছন থেকে ডেকেছিলাম, ‘আচ্ছা, আপনার পা খালি কেন’? প্রশ্ন শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে এমনভাবে হেসেছিল যে, আমার ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল, আর যাবার সময় তাচ্ছিল্যভরে ছোট্ট করে বলেছিল, ‘হাঁটার চেষ্টা করছি’। আজ এত বছর পরেও কখনও কখনও রাস্তায় হাঁটার সময় যুবকটির নগ্ন পা জোড়া চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তখন জুতোসহ নিজের পা দুটো নিয়ে আর এগুতে পারি না, মনে হয় ভারী একটা শেকল কেউ যেন পরিয়ে রেখেছে বছরের পর বছর!
৩.
আজকাল মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ছি। শেষবার ডাক্তারখানা গিয়েছিলাম মায়ের সাথে। মা ডাক্তারের সামনে বসে আমাকে দেখিয়ে বেশ গর্ব সহকারেই বলেছিল, ‘দেখুন ডাক্তার সাহেব, আমার এই ছেলেটির কী যেন হয়েছে।
কখনও ওকে নিয়ে আসতে হয়নি আপনাদের কাছে, কারণ ওর অসুখ করে না’। মায়ের সেদিনের সেই গর্বিত মুখের একটা কাল্পনিক ছবি আমি নোটবুকের প্রথম পাতায় এঁকে রেখেছি আর প্রতিবার খোলার সময় সেটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলি, ‘মা, তুমি কোথায়, দ্যাখো তোমার ছেলের এখন কত অসুখ। কোথায় তুমি, এসো, এসে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও!’ জানিনা মা শুনতে পায় কিনা, তবে মাঝে মাঝে আমি তার চলা-ফেরা, খুব নীচুস্বরে কথা বলার শব্দ শুনতে পাই। যেসব রাতে ঘুম আসেনা, বিছানায় শুয়ে ছটফট করি, মা এসে পাশে বসে, আর চুপচাপ মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আমার ইচ্ছে করে, মায়ের সেই হাত ছুঁয়ে দেখতে, নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকতে, অথচ পারিনা, ভয় করে, পাছে চোখ খুললেই দেখি সেখানে কেউ নেই।
তাই চোখ প্রাণপণ বন্ধ করে রাখি! মায়ের হাত বুলিয়ে দেয়ার একটানা ছন্দে আমি ডুবে যেতে থাকি ঘুমের অতলে, আর পরদিন সকালে জেগে দেখি চিবুক চটচটে হয়ে আছে।
পারভীনের নামটা যেদিন কেটেছিলাম, সেদিনই লিখেছিলাম মুনমুনের নাম, আর সেটা আমার নোটবুকের কয়েকটি ব্যতিক্রমী ঘটনার একটি। সাধারণত কোনো নাম কাটার পরপরই আমি অন্য কোনো নাম লিখিনা। অপেক্ষা করি, যতক্ষণ না মনে হয় পূর্বের নামটি আর প্রয়োজন নেই। অথচ পারভীনের নামটা যেদিন কেটেছিলাম, সেদিনই মুনমুন নামেটি লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম, কারণ, সেই বৃষ্টির রাতে আমাকে ওর দাম মেটাতে বিক্রি করতে হয়েছিল জীবনের প্রথম ও শেষ ঘড়িটাকে, যা উপহার পেয়েছিলাম কোনো এক ভুল জন্মদিনে, ভুল মানুষের কাছ থেকে।
যদিও পারভীনের শর্ত মেনে নিলে আমাকে সেটা বিক্রি করতে হতনা, কিন্তু, আমি চেয়েছিলাম ওর পুরো রাতটাই কিনে নিতে, আর সেজন্যই বাধ্য হয়েছিলাম ঘড়িটা বিক্রি করতে। সেই প্রথম আমার পতিতালয়ে যাওয়া আর কোনো রকম সাবধানতা ছাড়াই ওর সাথে মিলিত হবার সময় মনে হয়েছিল, নতুন এক অসুখ গ্রহণ করতে যাচ্ছি আমি, যার নাম হয়ত কোনদিনও জানা হবে না। ফলে, ভোর রাতে যখন ও ঘুমিয়েছিল, তখন পারভীনের নামটা কেটে, বড় বড় অক্ষরে লিখেছিলাম ওর নাম।
আজকাল প্রায় দেখি পেচ্ছাবের রঙ হলুদ হচ্ছে। ব্যাপারটা ভাল লাগে।
ফলে একটা সাদা কাচের গ্লাসে পেচ্ছাব করে রেখে দিই টেবিলের উপর। প্রথম দিকে সেটা হালকা হলুদ থাকে, এরপর ক্রমশঃ গাঢ় হতে হতে, দু’তিন দিন পর কেমন জানি অদ্ভুত রকমের কড়কড়ে হলুদ রঙ ধারণ করে। প্রথম দিকের হালকা রঙ ভাল লাগলেও, পরে কড়কড়ে রঙ দেখে রাগ হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় ঢক ঢক করে নামিয়ে দিই গলা দিয়ে। আমি জানি, আমার নিজস্ব কোনো উল্লেখযোগ্য রঙ নেই, তাই যত রাগই হোকনা কেন, পেচ্ছাবের ঐ রঙটুকুর মায়া কাটাতে পারি না, ফলে ওভাবেই রেখে দিই, যতদিন পর্যন্ত না মায়া কাটে, এবং নতুন হলুদ পেচ্ছাবে গ্লাস পূর্ণ করার ইচ্ছে জাগে।
৪.
মিনুর নামটা যে খুব শ্রীঘই কাটা পড়বে, জানতাম। শহুরে মেয়েদের আমি কখনোই সহ্য করতে পারিনি। কেন জানি দেখলেই প্লাস্টিক প্লাস্টিক মনে হয়। তাছাড়া আমি যে ওর সাথে প্রেম করছি না তা সে ভাল করেই জানত, তারপরও সপ্তাহে দু’তিনবার আসত । হয়ত পরকীয়ার প্রথম স্বাদ আমার কাছে পেয়েছে বলেই আলাদা এক ধরনের মায়া ও আকর্ষণ কাজ করত আমার প্রতি।
কিন্তু, ততদিনে আমার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দেরও একটা আলাদা ব্যাপার গড়ে উঠেছে, ফলে পরকীয়ায় নতুন নারীর চেয়ে, অভিজ্ঞ নারীকেই প্রাধান্য দিতাম। তাছাড়া মিলনের সময় ওর অরগ্যাজম্ হয়ে গেলে, কিছুতেই আর থাকতে দিতনা শরীরে। হাত-পা এমনভাবে ছুঁড়ত, যে আমাকে অনেকবার সহ্য করতে হয়েছে ওর লাথির ব্যথা। বেশিদিন নয়, মাস দু’য়েক ছিল ওর নামটা নোটবুকে, তারপর নিয়মমাফিক ওর নামের নিচেই ক্রমশঃ যোগ হতে থাকল নতুন সব নাম।
আমার প্রতিবেশীরা কখনোই আমার খোঁজ-খবর নেয় না,এমনকী আমি যে তাদের পরিচিত পরিবেশের একজন সদস্য, এ ব্যাপারটিও তারা গুরুত্ব দেয় না।
শুধু আয়েশা তাদের ব্যতিক্রম। সপ্তাহে একদিন হলেও সে খোঁজ-খবর নেয়, কেমন আছি, কী করছি, কীভাবে কাটছে দিনকাল, এসব জানতে চায়। আমার নোটবুকের এই একটিমাত্র নারীর সাথে আমার কোনো শারীরীক সম্পর্ক হয়নি, তবু ওর নামটা লিখেছিলাম, এবং পরবর্তীতে কাটার সময় মনে হয়েছিল, থাকনা। অথচ কিছুক্ষণ পর মনে হয়েছিল, আমার এই নোটবুক যখন আমাকেই উৎসর্গ করা পিছুটানহীন একটা জীবনের বেহিসেবি খরচ, তখন সেখানে কিছু জমা না থাকাই ভাল। তাই ওর নাম কেটে লিখেছিলাম পৌঢ়া এক রমণীর নাম, যে ছিল আমার থেকে পনের বছরের বড়।
জীবনের এতগুলো নারীর মধ্যে এই একটিমাত্র নারীর জন্য আমার বিশেষ দুর্বলতা গড়ে উঠেছিল, এবং দেড়বছর পর যখন ওর নামটা নোটবুক থেকে কেটে দিই, সেদিন সারাদিন নরকে এক ঋতুর ছেচল্লিশ নম্বর পাতা খুলে বসেছিলাম, আর অনেকদিন পর চেয়েছিলাম কবিতা লিখতে, ঠিক র্যা বোর মতই, ‘বেত্রাহতের সাত্বনা নিয়ে কী হবে? এখনো ভাবতে রাজী নই যে যাত্রা করেছি কোনো বিবাহ উৎসবে ধর্মপিতা যীশুখ্রীস্টকে সঙ্গে নিয়ে’।
৫.
মুনমুনের গোটা একটা রাতের দাম মেটানোর পর থেকেই আমি ঘড়িহীন। ব্যাপারটা আমার কাছে মাঝে মাঝে ধরা দেয় এভাবে, ঘড়ি নয়, বরং সেই থেকে আমি সময়হীন, আর তখন স্টেশনের বাইরে বসে থাকা পাগলটির কথা মনে পড়ে, যে স্টেশনের মাথায় লাগানো বড় ঘড়িটির যে কোনো ঘন্টা বাজলেই চিল্লিয়ে ওঠে, ‘ঐ দ্যাখ, বারোটা বাজল, জলদি যা, ট্রেন ছেড়ে দেবে’! পাগলটির ওভাবে চিল্লিয়ে উঠায় প্রতিবারই হতভম্ব হয়ে পড়ি, আর যখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসি, তখন সত্যি সত্যিই মনে হয়, ট্রেন ছেড়ে গেছে! খুব অস্থির লাগে সে সময়, কোনো কিছু ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারি না! মাথা ঘুরে পড়ে যাবার ভয়ে, আশেপাশে বসার জায়গা দেখে সেখানেই বসে পড়ি। অনেকক্ষণ উঠি না, আর তখন মনের ভেতরে কিছু ভাবনা গুছিয়ে নেবার তাগিদ অনুভব করি। অথচ র্যা বোর সেই লাইনগুলো মনে পড়ে যায়, ‘স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে পেলে গৃহী হব কি?-না, তা পারব না।
বড় ক্লান্ত আমি, বড় দুর্বল’! নিজের উপর রাগ হয়, উঠে দাঁড়াই, আর তখুনি কয়েকটা আধুলির ঝনঝনিয়ে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ার শব্দে ঘোর কাটে!
জানিনা কেন রূপা এখনও আমাকে ফোন করে। যদিও আমার ঘরে টেলিফোন কখনই ছিল না, কিন্তু ওকে যে নম্বরটা দিয়েছিলাম, সেটা ছিল শফি ভাইয়ের। মাঝে মধ্যে উনার সাথে দেখা হয়ে গেলে, কথা প্রসঙ্গে জানিয়ে দেয় ওর ফোন করার কথা, কেমন আছি সহ টুকরো-টাকরা খবরাদি জানতে চাওয়ার কথা। শফি ভাই হয়ত মজা পায়, কিংবা ভাবে, আমার গোপন কোন দুর্বলতায় খোঁচা দিলেই হয়ত বেজে উঠব আগের মতো, আর এক এক উগড়ে দেব যাবতীয় ব্যাথা। অথচ শফি ভাই জানেনা, কয়েক বছর আগেই আমি ওয়াং কার ওয়াইয়ের ‘ইন দ্য মুড অব লাভ’ মুভিটি ফেলেছি, এবং নায়কের মতোই একটা প্রাচীন মন্দিরের দেয়ালের ফোঁকরে মুখ রেখে আমার যাবতীয় গোপন কথা বলে সেটা কাদা দিয়ে বন্ধ করে এসেছি।
রূপার ফোন করার খবর তাই আমাকে কিছুমাত্র উদ্বিগ্ন করেনা, বরং শফি ভাইকে বিদায় জানিয়ে নিশ্চিন্ত মনেই এগিয়ে গিয়ে দর-দাম করতে পারি নতুন কোনো চরিত্রের সাথে, যার নাম হয়ত কয়েক দিনের মধ্যেই ঢুকে যাবে নোটবুকে।
বৃষ্টি সহ্য করতে পারিনা একদম। স্মৃতিহীন যে জীবনের জন্য এখনও বেঁচে আছি, বৃষ্টি সেই জীবনের কাছে পৌঁছে যাবার সমস্ত আশাকে নসাৎ করে দেয়। বৃষ্টির শব্দ কানে আসা মাত্রই খুব কাছে টের পাই ভেজা নারী শরীরের অস্তিত্ব, যে তার ভেজা চুলের পানি হাতের তালুতে নিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে আমার চোখ-মুখে, আর কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলে যাচ্ছে কী সব। আমি কাঁপতে শুরু করি এবং কোনো কারণ ছাড়াই ছোটবেলার মতো, নায়কের মহত্বে নয়, বরং ভিলেনের নিষ্ঠুরতায় মোহাবিষ্ঠ হয়ে কলাগাছের সামনে দাঁড়িয়ে মেকি অট্টহাসিতে তার শরীরে একের পর এক ঢুকিয়ে দিতে থাকি নিজেরই বানানো নকল ছোরা।
একসময় শান্ত হই, প্রশান্তি নিয়ে ফিরে আসি, অথচ কলাগাছটি সত্যি সত্যিই মারা যায় একসময়!
৬.
মৌমিতার যে চমৎকার গুণটি আমাকে মুগ্ধ করেছিল, তা ছিল যে কোনো পরিস্থিতিতে ওর প্রাণ খুলে হেসে ওঠার স্বাভাবিক ক্ষমতা। ওর হাসি দেখার পর আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো, মানুষ কাঁদে। মূলতঃ ওকে দেখার পরই আমার কষ্টগুলো আর কখনও তরল হয়ে উঠার সুযোগ পায়নি। অথচ সেই মৌমিতাও কেঁদেছিল, এবং আমাকে জীবনে দ্বিতীয়বারের জন্য এই দ্বন্দ্বে ফেলেছিল, হাসি নয়, বোধহয় কান্নাই পারে জীবনের প্রকৃত রঙ ঝরাতে। আমি সত্যিই চেয়েছিলাম সেদিন কাঁদতে, যেদিন ও আমার ঘরে সারাদিন ছিল, এবং অনুনয় করেছিল, আর কিছু না হোক, অন্তত ওর নামটা যেন রেখে দিই নোটবুকে।
অথচ নির্বিকারভাবে ওকে জানিয়েছিলাম, আমার মায়া শূন্যতা ও পাতা স্বল্পতার কথা। ও চলে গিয়েছিল, আর পরদিন ওর মৃত্যু সংবাদ শোনার পরও আর সব নামের মতোই খুব স্বাভাবিকভাবে কেটেছিলাম ওর নাম।
জানি মৃত্যু মানুষকে কিছুই দিতে পারে না, অথচ আমার জীবনের যা কিছু তা যেন মৃত্যু অথবা মৃত্যু চিন্তা ঘিরেই। এখন আর ভাবতে পারিনা, কোনো কিছু পারিনা ঠিকঠাক গুছিয়ে বলতে। নোটবুকের দুশ’ নিরানব্বই পাতায় এসে এখন আর নতুন কোনো নাম খুঁজে পাইনা, আর পেলেও দরদাম করার সময় কিছুতেই ঠিক করতে পারিনি, কাকে কত দেয়া যেতে পারে।
এখন সবাইকেই এক মনে হয়, যেমন করে প্রতিটি দিনকে মনে হয় একেকটি উৎসর্গের দিন। যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ আনন্দ-উল্লাসে বেরিয়ে এসেছে বাইওে, আর আমি ঘরের ভেতর দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থেকে কাঁপছি। কে যেন হঠাৎ উচ্চস্বরে পড়া শুরু করে ৪৬ নম্বর পাতা, ‘যে মৃত কুকুরেরা টেনে নিয়ে গিয়েছিল আমায় স্নেহ-ধূসর বরফ-নৈরাজ্যে, তাদের আত্মা আজও পাহারা দেয় আমার ঘুম-দরজা’, আর আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, উৎসর্গের জন্য হাতা-পা বাঁধা অগুণিত পশুর ভয়ার্ত মুখ। কেমন জানি কষ্ট বোধ হয়, অথচ নড়তে পারিনা। অনন্ত এক অর্থবতা আমাকে পাথরের মতো বসিয়ে রাখে, আর ধারাল ছোরা হাতে, বিভৎস এক পুরু সামনে এসে দাঁড়ায়, হেসে উঠে, তারপর কর্কশ স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘বলুন, কার নামে উৎসর্গ হবে’? আমার গলা দিয়ে স্বর বেরোয়না, অথচ গোঁঙানির মতো যে শব্দ উচ্চরণ করি, তা পড়ে থাকতে দেখি নরকে এক ঋতুর ছেচল্লিশ নম্বর পাতার নিচের দিকে, এক কোণে!
অরণ্য
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।