ভেঙে পড়ছে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা। সর্বশেষ হিসাবে দেশের ৬২ হাজার কিলোমিটার সড়কের অবস্থা নাজুক। এর মধ্যে সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন ১২ হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক এবং এলজিইডি-নিয়ন্ত্রিত ৫০ হাজার কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এসব পাকা সড়কের বেশ কিছু অংশ এতটাই নাজুক যে নতুন করে নির্মাণ না করলে যানবাহন চলতেই পারবে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অবস্থাও ভালো নয়।
অধিক খানাখন্দের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
এসব রাস্তা ভাঙাচোরা, বিপজ্জনক খানাখন্দে ভরপুর। কোথাও সংস্কারের বালাই নেই। এলজিইডির আওতায় জেলা সংযোগসহ উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামীণ পর্যায়ে পাকা সড়ক রয়েছে ৮০ হাজার ৪৪৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৫০ হাজার কিলোমিটার সড়কের অবস্থা লেজেগোবরে।
নির্মাণের পর থেকে আর এসব সড়কে সামান্য বিটুমিনের প্রলেপও পড়েনি। বরং এমপি-মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গিয়ে বর্তমান সরকারের গত সাড়ে তিন বছরে প্রায় ১৩ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ কাঁচা সড়ককে পাকা করা হয়েছে। কিন্তু বিপরীতে সামান্য সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে কোটি কোটি টাকায় নির্মিত ৫০ হাজার কিলোমিটার সড়ক পেঁৗছেছে ধ্বংসের পর্যায়ে।
অন্যদিকে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) আওতাধীন সড়ক-মহাসড়কের অবস্থাও বেহাল। গত বর্ষা মৌসুমে বানের পানি ও ঢলে ভাঙনের শিকার সড়ক-মহাসড়কগুলো মেরামত পর্যন্ত করা হয়নি।
সেসব স্থান দিয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় যানবাহন চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে। সারা দেশে সওজের অধীন ১৮ হাজার ২১০ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক রয়েছে। প্রতিবছর কী পরিমাণ সড়ক খারাপ হচ্ছে, কীভাবে তা মেরামত করা হবে এবং কত টাকা খরচ হবে, সে বিষয়ে চাহিদা প্রতিবেদন তৈরি করে সওজের মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ। এ বিভাগের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১২ হাজার ৪২৮ কিলোমিটার সড়ক ভাঙাচোরা। এগুলো জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করতে হবে।
প্রতিবেদনে সড়কগুলোকে ভালো, চলনসই, নিম্নমানের, খারাপ ও অত্যধিক খারাপ- এই পাঁচ শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার সড়ক অত্যধিক খারাপ। সওজের কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত সড়কে বড় বড় গর্ত হলে এবং সেগুলো নতুন করে মেরামত করতে হলে অত্যধিক খারাপ বলা হয়। এ ছাড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ৮৫০ কিলোমিটার সড়ক বেশি খারাপ পর্যায়ের এবং শুধু খারাপ রাস্তার পরিমাণ দেড় হাজার কিলোমিটার। এ ছাড়া যেসব সড়ককে ভালো ও মোটামুটি ভালো বলা হয়েছে, সেগুলোও মেরামতের দরকার বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সওজের আওতাধীন অত্যন্ত ব্যস্ততম সড়ক হচ্ছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক। ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে অন্তত ৫০টি পয়েন্টে রাস্তার বেহাল চিত্র। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও কলকারখানার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে কৃত্রিম জলাবদ্ধতার। ডুবছে রাস্তা। মহাসড়কের ১০ পয়েন্টে হাঁটুপানি।
কোথাও কোথাও মহাসড়ক ধারণ করেছে ডোবা ও খালের আকৃতি। বাড়ছে দুর্ঘটনা। সংস্কার নেই ১০ বছরেও। নেই ড্রেনেজ সিস্টেম। রাস্তায় রাস্তায় অবৈধ টার্মিনাল, বাজার।
নষ্ট হচ্ছে জোড়াতালির সংস্কার। নিম্নমানের ইট দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে গর্ত। সব মিলিয়ে এই রুটে ৫০ কিলোমিটারের বেশি রাস্তা পরিবহন চলাচলের উপযোগিতা হারিয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। দেশের বেশ কয়েকটি সড়ক-মহাসড়কেই এমন বেহাল পরিস্থিতি বিরাজমান।
সওজ ১২ হাজার ৪২৮ কিলোমিটার রাস্তা মেরামতের জন্য তিন হাজার ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছর মাত্র ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। বরাদ্দ বাড়ানোর আবেদন করেও লাভ হয়নি। পরে সড়ক মেরামতের জন্য এক হাজার ৪১০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয় সওজ। কিন্তু এটি এখনো অনুমোদন পায়নি।
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বেশ কিছু রাস্তা খুবই খারাপ আকার ধারণ করেছে। এসব সড়কে হেঁটে চলাও যেখানে কষ্টকর, সেখানে চলছে বাস, ট্রাক, প্রাইভেট, রিকশা-ভ্যান সব কিছু। চাহিদামাফিক পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। তবে সীমিত অর্থেই সব কিছু চলনসই রাখতে হবে বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে বিশেষভাবে এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার নতুন একটি প্রকল্প নিয়েছি।
এর আওতায় সওজের নয়টি অঞ্চল থেকে মেরামত কাজের দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছে। ' ছয় মাসের মধ্যে ভাঙা রাস্তা মেরামত হয়ে যাবে বলেও আশাবাদ প্রকাশ করেন যোগাযোগমন্ত্রী। দেশের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা এখন খুবই শোচনীয়। সওজ ও এলজিইডির হিসাবে ৬১ দশমিক ১১ ভাগ সড়ক খানাখন্দে ভরা। এলজিইডির বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছর প্রায় ৪৩ হাজার কিলোমিটার সড়কে খানাখন্দ আছে এবং কিছু স্থানে রয়েছে গভীর গর্ত।
এর মধ্যে তিন হাজার কিলোমিটার এতই খারাপ যে, এগুলো নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। সারাতে হবে ১৮ হাজার কিলোমিটার সড়কে ছোট-বড় গর্ত। সাধারণ মেরামত করতে হবে অন্তত ২২ হাজার কিলোমিটার সড়ক। কুমিল্লার লাকসাম-নাথেরপটুয়া সড়কের পুরোটাই যেন মরণফাঁদ। স্থানে স্থানে বিপজ্জনক ভাঙাচোরা, খানাখন্দে ভরা।
অনেক জায়গা ধসে গভীর খাদে পরিণত হয়েছে। সীমাহীন ঝুঁকি নিয়ে ওই সড়কে নিত্য যাতায়াতকারী লোকজন বলেন, 'হাঁটতে গেলে হোঁচট খাই, গাড়িতে যেতে ভয় পাই। ' এ রাস্তায় অহরহ রিকশা-ভ্যান, ইজিবাইক গর্তে পড়ে উল্টে যাচ্ছে। সিএনজি-টেম্পো দুর্ঘটনায় পড়ছে। প্রতিদিনই আহত হচ্ছে দু-চারজন যাত্রী।
এলজিইডির বেহাল সড়কটি এখন সবার গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের আওতায় নির্মিত ১০ কিলোমিটার পাকা সড়কটি দীর্ঘদিনেও সংস্কার না হওয়ায় এখন তা এলাকাবাসীর জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে। রাজধানীর অদূরে গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তা থেকে শ্রীপুর উপজেলা সদর পর্যন্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ সড়কটিরও করুণ হাল। লাখ লাখ মানুষের যাতায়াত করা সড়কটির করুণ পরিণতি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার উপায় নেই। এবড়োখেবড়ো, ভাঙাচোরা গভীর খাদে ভরা সড়কটিতে হেঁটে চলাটাই যেখানে কষ্টকর, সেখানে চলছে দ্রুত গতির বাস-মিনিবাস, পণ্যবোঝাই ট্রাক, লরি।
সড়কটি মেরামতের দাবিতে আন্দোলন, মিছিল, ধর্মঘট, অবরোধ করেও কোনো সুফল মেলেনি। নাথেরপটুয়া-লাকসাম রোডের মতো প্রায় দুই হাজার সড়কের বেহাল অবস্থা দূর করা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। সীমিত অর্থ বরাদ্দ দিয়ে খানাখন্দ, গর্ত ভরাট করাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
এলজিইডি সূত্রগুলো জানিয়েছে, কোনো প্রকল্পের অধীনেই এসব সড়ক সংস্কার হয় না। মূলত সরকারের রাজস্ব বাজেটের টাকা থেকেই এগুলো সংস্কার করতে হয়।
এ ছাড়া সড়ক সংস্কারের ক্ষেত্রে বরাদ্দ চাহিদার তুলনায় খুবই কম থাকায় গ্রামীণ সড়কগুলোতে অতি প্রয়োজনীয় সংস্কারও করা যাচ্ছে না। সড়ক সংস্কার খাতে নূ্যনতম সরকারি বরাদ্দের টাকায় বড়জোর রাস্তার দুই পাশে খানিকটা মাটি ভরাট ও গাছের পরিচর্যা করা সম্ভব হয়, রাস্তার গর্ত ভরাট করারও উপায় থাকে না। এলজিইডির বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪৩ হাজার কিলোমিটার সড়কের পিচ উঠে খানাখন্দে ভরে গেছে। প্রায় ৩০ হাজার কিলোমিটার সড়কে নষ্ট হয়ে গেছে স্লোব বা শোল্ডার। চার হাজার কিলোমিটার রাস্তা এতই খারাপ যে, এগুলো নতুন করে নির্মাণ করতে হবে।
এ ছাড়া ১৮ হাজার কিলোমিটার সড়কে বড় বড় গর্ত ও বিপজ্জনক খানাখন্দ সারাতে হবে। অন্তত আড়াই হাজার কিলোমিটার সড়ক এ মুহূর্তেই মেরামত না হলে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কাও করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এলজিইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আঞ্চলিক, আন্তঃজেলা ও জেলা পর্যায়ের প্রধান প্রধান সড়ক ছাড়া শুধু উপজেলা ও ইউনিয়ন কানেকটিং সড়ক সংস্কার করতেই প্রয়োজন দুই হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চলতি অর্থবছর প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছিল এলজিইডি। কিন্তু পাওয়া গেছে মাত্র ৫৭০ কোটি টাকা।
রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রওশন কবির বলেন, এ বরাদ্দ দিয়ে তাদের ৩০ শতাংশ রাস্তা মেরামত করা সম্ভব। অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে তারা মেরামত শুরু করছেন। জেলা-উপজেলা পেরিয়ে ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ের রাস্তাগুলোর অবস্থা আরও করুণ। ২০ হাজার কিলোমিটার জরাজীর্ণ গ্রামীণ পাকা রাস্তায় এলজিইডি ৮-১০ বছরেও কোনো সংস্কারকাজ করতে পারেনি। এসব বিষয়ে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমান বলেন, গ্রামীণ সড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ সরকারিভাবে তারা আলাদা কোনো বরাদ্দ পান না।
বিশেষ ব্যবস্থায় জরুরি প্রয়োজনে কিছু সড়ক এলজিইডি নিজস্ব উদ্যোগে মেরামত করলেও এর পরিমাণ খুবই সীমিত। এ ছাড়া কয়েক বছর ধরে এলজিইডির কর্মকর্তারাও কাজের মান রক্ষার ব্যাপারে তেমন কোনো গুরুত্ব দেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। নতুন সড়ক নির্মাণের এক বছর না পেরোতেই বহু সড়কের কার্পেটিং, সিলকোট উঠে গভীর গর্ত সৃষ্টি হয়, ধসে যায় দুই পাশের সাইড গার্ড। প্রতিবছর সংস্কারকাজের নামে নিম্নমানের ইট, খোয়ার প্রলেপ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন তারা। এর ফলে অধিকাংশ রাস্তা নির্মাণের এক-দেড় বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়, ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
এ পরিস্থিতিতে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী গ্রামে নতুন সড়ক না করে পুরনো সড়কগুলো সংস্কারের ওপর জোর দিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন। এতেও সংস্কার-সংরক্ষণ ও মেরামতের কাজের বিষয়টি ততটা গুরুত্ব পায়নি। এদিকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-এমপির কাছের লোকজন নতুন রাস্তা নির্মাণ ও পাকাকরণের ঠিকাদারি পেয়ে থাকেন। এ জন্য এলজিইডি রাস্তাগুলো নির্মাণের মানদণ্ডও যাচাই করতে পারে না। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা অনেকটা বাধ্য হয়েই ঠিকাদারকে ছাড়পত্র দেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।