বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর আমাদের প্রাণে আজো আলোড়ন তুলে। অকস্মাৎ ধূমকেতুর মত বাংলা সাহিত্য গগনে উদিত হয়ে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সমস্ত অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে। নজরুল জানতেন ভারতবর্ষকে দানবমুক্ত হবার জন্য সুসংগঠিত শক্তির প্রয়োজন। আবেদন করেছেন বিপ্লবী শক্তিকে । চেয়েছেন রক্তস্বর পরিহিতা কালচিতাকে বরণ করে নেবার দুঃসাহস।
এ জন্য রক্তাপ্লুতা মাকে আহ্বান করেন। শান্তির শ্বেত বসন পরিহার করে তরবারী হাতে অসুরনাশিনী দুর্গার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বলেন। কেননা দেশ তখন অসুরের কবলে নির্যাতিতা। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের বিরাট ভূমিকা ছিল। তিনি তার লেখনী শক্তির মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের অন্তরে বিদ্রোহী সত্ত্বাকে জাগিয়ে দিয়েছেন।
তার প্রতিটি রচনায় বিদ্রোহের অগ্নিশিখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এখানকার অনিশ্চিত পরিবেশকে তিনি দিতে চেয়েছেন নিশ্চয়তা, শাসন কাঠামোর বিশৃঙ্খলায় তিনি আনতে চেয়েছিলেন শৃঙ্খলা; সমাজের প্রতিস্তরের নিপীড়িত জনগণের মুক্তির জন্যে তিনি দিয়েছিলেন শক্ত হাতিয়ার। দেশের জন্য, মানুষের জন্য তিনি জেল পর্যন্ত খেটেছেন। দেশকে মুক্ত করতে, অত্যাচারীকে উৎখাত করতে তার ছিল এক যুগান্তকারী ভূমিকা।
ভুমিকা: স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ আত্মবিশ্বাস, নিজের শক্তির প্রতি বিশ্বাস।
যার নিজের প্রতি বিশ্বাস থাকে না সে নিজের শক্তিকে, নিজের উপর নির্ভর করতে ভয় পায়। আর মানুষ যখনই নিজের উপর নির্ভর করতে ভয় পায় তখন সে পরের উপর নির্ভর করে। আর পরের উপর নির্ভর করলেই মানুষ স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে। প্রকৃত স্বাধীনতা তাই বাইরে থেকে ইংরেজ তাড়ানোর শ্লোগান নয়, প্রকৃত স্বাধীনতা আত্মশক্তি অর্জন বা আত্মচৈতন্য লাভ। কেবল স্বদেশের মুক্তিই যে স্বাধীনতা নয়, সেই শিক্ষাও নজরুলের কাব্য আমাদের প্রথম দান করে।
নজরুল জানতেন কেবল বিদেশি শোষক নয় স্বদেশি শোষকরাও বিদেশিদের মত মানুষের শত্রু; সেই শোষণ থেকে মুক্তিই প্রকৃত মুক্তি। এই মুক্তির নাম সাম্যবাদ, এই মুক্তির নাম স্বাধীনতা। তাই তিনি কেবল ইংরেজদের বিরুদ্ধেই কলম ধরেন নি, দেশি বিদেশি শোষকদের বিরুদ্ধেও কলম ধরেছিলেন। কবি ভালভাবেই জানতেন যে মানুষ বাইরে থেকে স্বাধীন না হলে সত্যিকার স্বাধীন হয় না, মানুষকে সত্যিকারভাবে স্বাধীন হতে হয় ভিতর থেকে। স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রতকরণে মুক্তিপাগল নজরুলের ভুমিকা নিম্নে বর্ণনা করা হলো।
অচেতনদেরকে জাগার নির্দেশ: কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, “জাগো অচেতন জাগো আত্মাকে চেন। ” যে চেতনা লাভ করেছে, চিনেছে আত্মাকে সেই নিজেকে চিনেছে, চিনেছে স্বাধীনতা। আত্মশক্তি কবিতায় কবি এই জীবন দর্শনটিকে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন-
এস বিদ্রোহী মিথ্যা-সূদন আত্মশক্তি বুদ্ধ বীর
আনো উলঙ্গ সত্য কৃপাণ, বিজলী ঝলক ন্যায়-অসির।
তুরীয়ানন্দে ঘেষে যে আজ
আমি আছি বাণী বিশ্ব মাঝ
পুরুষ রাজ?
সেই স্বরাজ
জাগ্রত কর নারায়ণ নর নিদ্রিত বুকে মরু বাসরি
আত্ম-ভীত এ অচেতন চিতে জাগো “আমি” স্বামী নাঙ্গা শীর।
অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুলের নিরবচ্ছিন্ন লড়াই : সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই। আর এসব লড়াইয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান হচ্ছে বড় প্রেরণা এবং শানিত তরবারি। তার রচিত কবিতা ও গান সে আমলে সাধারণ মানুষকে যেভাবে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শরীক হতে উৎসাহিত করেছিল, ‘ঠিক একইভাবে পাকিস্তান ঔপনিবেশবাদের আমলেও নজরুলের কবিতা ও গান পূর্ববাংলার আপসের জনগোষ্ঠীকে পাকিস্তানের শোষক ও শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও একটার পর একটা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিলো। সামাজিক অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন লড়াই-এ যুগে নজরুল সাহিত্য হচ্ছে মোক্ষম হাতিয়ার। তিনি শিকল ভাঙ্গার গান গেয়েছেন।
“কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট
রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী। ”
স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত নজরুল: ১৯২০ সালের মার্চ মাসে বাঙ্গালীদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এ বছরের মার্চ এপ্রিলের দিকে কাজী নজরুল ইসলাম করাচি থেকে কলকাতায় এপ্রিলের দিকে চলে আসেন। যুদ্ধ ফেরত যুবক নজরুল ইসলাম দেখলেন সারাদেশে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রবল জোয়ার। দেখলেন সমগ্র ভারতবাসী মুক্তির নেশায় উন্মাতাল।
তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন পরাধীন দেশের মানুষের জীবন যন্ত্রণা। পরাধীনতার গ্লানি তাকে মুহ্যমান করেন নি বরং তাকে প্রচণ্ডভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল মুক্তির নেশায়। আর স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত নজরুল এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং এমন করে আর কোনো বাঙ্গালী কবি বা সাহিত্যিক ঝাঁপিয়ে পড়েন নি। এককথায় এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিপ্লবীদের স্বপক্ষে লেখনী ধারণ: নজরুল ইসলাম ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যের ‘প্রলয়োল্লাস’ ‘আগমনী’ ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ ‘ধূমকেতু’, ‘রণভেরী’ ইত্যাদি কবিতার মাধ্যমে দেশের তরুণদের ইংরেজ বিরোধী শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন।
এই সব কবিতার মাধ্যমে নজরুল ইসলাম ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আগ্রাসী চেহারাটি তরুণ সমাজের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ বেনিয়াদের কবল থেকে মুক্তির জন্য যে প্রবল শক্তিমত্তার প্রয়োজন ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যে নজরুল প্রগলভ, উদ্দামতা ও সাহসিকতার সাথে উপস্থাপন করেছেন। বিদ্রোহী কবিতায় নিজের রণোন্মুত্ততার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন।
আমি উপাড়ি, অধীন বিশ্ব অবহেলে নবসৃষ্টির মহানন্দে মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত।
ভীরুতা ও কাপুরুষতাকে ত্যাগ করার আহ্বান: ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা বেশ কঠিন কাজ।
এই কঠিনকে সম্ভব করতে পারে একমাত্র যুবশক্তি। তাই কবি স্বাধীনতার জন্য দেশের যুবকদের ভীরুতা ও কাপুরুষতাকে ত্যাগ করে রক্তচক্ষু ও দুঃশাসনকে চ্যালেঞ্জ করার উদাত্ত আহ্বান জানান। নজরুল ইসলাম ভীরুতা দোদুল্যমানতা, কাপুরুষতাকে আত্মশক্তির বলে বাতিল করে দেন। ইংরেজদের আপোষ কিংবা অহিংসার মাধ্যমে ভারতবাসীর মুক্তি সম্ভব নয়। সকলকে অস্ত্র হাতে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
বিষের বাঁশীতে তিনি লিখেন,
সত্যকে হায় হত্যা করে অত্যাচারীর খাড়ায়
নেই কিরে কেউ সত্য সাধক বুক খুলে আজ দাঁড়ায়
শিকলগুলো বিকল করে পায়ের গুলায় মাড়ায়
বজ্র হাতে জিন্দানের ঐ ভিত্তিটাকে নাড়ায়?
বিশ্বগ্রাসীর এসে নাশি, আজ আসবে কে বীর এসো
ঝুট শাসনে করতে শাসন, শ্বাস যদি হয় শেষেও
কে আছ বীর এসো।
“বন্দী থাকা হীন অপমান’ হাঁকবে যে বীর তরুণ,
শির-দাঁড়া যার শক্ত আজ, রক্ত যাহার অরুণ
সত্য-মুক্তি স্বাধীন জীবন লক্ষ শুধু যাদের
খোদার রাহে জান দিতে আজ ডাক পড়েছে তাদের
সত্য মুক্তি স্বাধীন জীবন লক্ষ শুধু যাদের। “
স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম ও যুদ্ধের আহ্বান: নজরুলের মনে স্বাধীনতার জন্য তীব্র আকাঙ্খা ছিল। তিনি অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। ফাঁসির মঞ্চের জয়গান গেয়েছেন।
তার স্বাধীনতার আকাঙ্খা স্বদেশ স্বজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়-বরং তা নিখিল মানবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। নজরুলের কবিতায় গানে যে স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব-মানবতার সুর উচ্চারিত হয়েছে তা জাতি-ধর্ম-দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে প্রভাবিত করেছে। তিরিশ-চল্লিশ-দশকের রাজনৈতিক চেতনায়, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে, সাহিত্যিক প্রয়াসে নজরুলের বিদ্রোহ ও সাম্যের প্রভাব সক্রিয় ছিল। শাসন শোষনের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল নজরুল ছিলেন তার নিবেদিত কর্মী-একনিষ্ঠ সৈনিক। বিদ্রোহী তিনি অবশ্যই।
তার বিদ্রোহ ছিল সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে, তার বিদ্রোহ ছিল সামাজিক অসাম্য- বৈষম্যের বিরুদ্ধে, তার বিদ্রোহ ছিল সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের বিরুদ্ধে। ২৭টি কবিতা ও গানের সংকলন বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থের প্রায় সব কটি কবিতা ও গানের মাধ্যমে নজরুল ইসলাম পরাধীন ও শৃঙ্খলিত ভারতবাসীকে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম ও যুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সাধারণ জনগণকে বিভিন্নভাবে সংগ্রাম করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন।
তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করা: ১৯৪৭ এর পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক চেতনায় একটা পরিবর্তন দেখা গেল। বাংলা ভাষার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এখানে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ভাবধারা গড়ে উঠতে লাগল।
এই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল-বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্ররা তরুণেরা। এদের সবার মধ্যেই নজরুল অনুরাগ বর্তমান ছিল। নজরুলের সংস্কারমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি-অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকরার সংকল্প-সম অধিকারের ভিত্তিতে সমাজ গঠন করার আদর্শে যুব সমাজের আকর্ষণ সন্দেহাতীত। যুব আন্দোলন ছাত্র আন্দোলনে নজরুলের বিদ্রোহাত্মক কবিতা ও গানের প্রেরণা ও প্রভাব ছিল অনিবার্য। সেই প্রভাবের ফলে বিদ্রোহের পথে চললো বাঙ্গালী জাতি।
সেই বিদ্রোহ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলো ১৯৭১ সালে। বিদ্রোহী ছেলেরা মুক্তির নেশায় তাদের তাজা রক্ত ঢেলে দিল। নজরুল বিজয়ের প্রত্যাশা নিয়ে উদাত্তকণ্ঠে আহ্বান জানিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বলেছেন-
কাণ্ডারী তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর
বাঙ্গালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হয়ে, ভারতের দিবকের
উদিবে সে রবি আমাদেরই খুনে রাঙ্গিয়া পুনর্বার
লৌহ কপাট ভাঙ্গার সাহস জুগিয়েছেন নজরুল: নজরুলই তরুণদেরকে কারার লৌহ কপাট ভাঙ্গার সাহস জুগিয়েছেন বহুদিন ধরে। তার প্রেরণায় ধূলায় তাজমহল গড়ার স্বপ্ন দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। নজরুলের কবিতা গান তরুণদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানের প্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছে।
বিষের বাঁশী গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘শিকল পড়ার গান’ বন্দী জীবনে কারাবাসী বিপ্লবীদের মানসিক শক্তি অর্জনের বাণী। বিপ্লবী নজরুলকে শাসক বিরোধী ভূমিকার জন্য জেলে যেতে হয়েছে। বিচারের নামে প্রহসনে বহু যুবককে আন্দামানে ধুকে ধুকে মরতে হচ্ছে। লাঞ্ছিতের লাঞ্ছনাই অত্যাচারীর সমাধি রচনা করবে বলে নজরুল বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন-
এই শিকল পড়া ছল মোদের এ শিকল পড়া ছল
এই শিকল পড়েই শিকল তোদের করবরে বিকল
ওরে ক্রন্দন নয বন্ধন এই শিকল-ঝঞ্ঝনা,
এযে মুক্তিপথের অগ্রদূতের চরণ বন্দনা!
এই লাঞ্ছিতেরাই অত্যাচারকে হানছে লাঞ্ছনা
মোদের অস্থি দিয়েই জ্বলবে দেশে আবার ব্রজানল ॥
স্বাধীনতাকামীদের কণ্ঠে ঝংকৃত হয়েছে নজরুলের গীত: যে বিপ্লবী তরুণরা দেশের নামে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গিত করছে, কারাবরণে আত্মাহুতি দিচ্ছে, মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হচ্ছে সেই সাহসী নির্যাতন ভোগকারী বীরদের নিয়ে রচিত এই গান। এই গীত ঝংকৃত হয়েছে স্বাধীনতাকামী যুবকদের কণ্ঠে কারাগারের অন্তরালে-
ও ভাই মুক্তি সেবক দল
তোদের কোনো ভায়ের আজ বিদায়-ব্যথায় নয়ন ছল-ছল?
এ কারা ঘর তো নয় হারা ধর,
হোথাই মেলে মার দেওয়া বর রে।
....... ............. .........
আজ কারায় যারা, তাদের ওরে
গৌরবে বুক উঠুক ভরে রে।
মোরা ওদের মতই বেদনা ব্যথা মৃত্যু আঘাত হেসে
বরণ যেন করতে পারি মাকে ভালবেসে।
ওরে স্বাধীনকে কে বাঁধতে পারে বল?
ও ভাই মুক্তি সেবক দল।
স্বদেশের মুক্তির জন্য দৃঢ় প্রত্যয় : অনেক কবিতা ও গানেই মুক্তি পাগল নজরুল ইসলামের স্বদেশের মুক্তির জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। এইসব কবিতা ও গানে নজরুল তৎকালীন তরুণদের মনের কথারই প্রতিধ্বনি তুলেছিলেন।
দেশের শৃঙ্খল মুক্তির জন্য এইসব তরুণের মৃত্যুবরণ কোনোরূপ দ্বিধা সংশয় ছিল না। তাই নজরুলের কবিতায় তাদের কণ্ঠস্বর- “ মোরা ফাঁসি পরে আনব হাসি মৃত্যু জয়ের ফল“ অথবা “ মোদের অহি দিয়েই জ্বলবে আবার বজ্রানল“ শুনতে পাই।
হিন্দু ও মুসলমানদের সম্প্রীতি কামনা: নজরুল ভালভাবেই এই দুই শক্তির সম্মিলন ঘটলেই ব্রিটিশ বেনিয়াদের এদেশ থেকে তাড়ানো সম্ভব। হিন্দু মুসলিমের অনৈক্যে তিনি মারাত্মকভাবে ব্যথিত হয়েছেন। হয়েছেন রক্তাক্ত।
তার একাধিক কবিতা ও গানে তার স্বাক্ষর মেলে। তার প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে বহুদিনের তীক্ত বিরোধ ভুলে হিন্দু মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে-তাতেও রয়েছে নজরুলের শিক্ষা। সেই যুদ্ধে কে হিন্দু কে মুসলমান সে জিজ্ঞাসা করার কথা বাংলাদেশের মানুষ ভুলে গিয়েছিল।
সক্রিয় তৎপরতা: নজরুল ইসলাম শুধুমাত্র তার রচনার মাধ্যমে মানুষকে সংগ্রামী হতে বলেই ক্ষ্যান্ত হননি বরং তিনি মানুষকে সংগ্রামী করে তোলার সাথে নিজেও সংগ্রামী জনতার দলে যোগ দিয়েছেন। আত্মবল লাভ করার জন্য আত্মিক যুদ্ধে নজরুল ইসলাম সরাসরি সাধন মন্ত্রে দীক্ষিতও হননি, তিনি রাজনৈতিক মারণমন্ত্রও লাভ করেছিলেন এবং বাহ্যিকভাবে স্বদেশকে স্বাধীন করার জন্য ধারণাকে কার্যে পরিণত করতে সৈনিকের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
খোলাখুলিভাবে তিনি দেশবাসীকে স্বাধীনতার জন্য অস্ত্রধারণ করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। সশস্ত্র বিপ্লব ভিন্ন যে স্বাধীনতা আসতে পারে না, নজরুল ইসলাম দৃঢ়ভাবে তা বিশ্বাস করতেন। নজরুল ইসলাম একজন দেশপ্রেমিক সৈনিক ছিলেন। তিনি দেশকে মুক্তি করতে নানারূপ কষ্টের সম্মুখীন হন। এমনকি তিনি দেশের জন্য জেল পর্যন্ত খেটেছেন।
নজরুল দেশের জাতীয় আন্দোলনের সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। মুক্তি সংগ্রামে তার সক্রিয় ভূমিকার কথা সবাই জানে। এইসব ব্যাপারে তাকে অনেক পীড়ন-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে।
বুকের রক্ত দিয়ে লিখে জাগিয়েছে প্রাণ স্পন্দন: কলকাতার আলবার্ট হলে এক সর্ম্বধনা অনুষ্ঠানে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বললেন- আজ আমি এই ভেবে আনন্দ অনুভব করছি যে, নজরুল ইসলাম শুধু মুসলমানের কবি নন, তিনি বাঙালির কবি-বাঙালির কবি। কবি মাইকেল মধুসূদন খ্রিস্টান ছিলেন।
কিন্তু বাঙালি জাতি তাকে শুধু বাঙালি রূপেই পেয়েছিল। আজ নজরুল ইসলামকেও জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। কবিরা সাধারণত কোমল ও ভীরু; কিন্তু নজরুল তা নন। কারাগারের শৃঙ্খল পড়ে বুকের রক্ত দিয়ে তিনি যা লিখেছেন, তা বাঙালির প্রাণে এক নতুন স্পন্দন জাগিয়ে তুলেছে।
সাহিত্যের মধ্যে জেল জীবনের প্রভাব: এস ওয়াজেদ আলী বলেন- ধুলার আসনে বসিয়া মাটি মানুষের গান গাহিয়াছ তুমি।
সে গান অনাগত ভবিষ্যতের। তোমার নয়ন সায়রে তাহার ছায়াপাত হইয়াছে। মানুষের ব্যথা বিষে নীল হইয়া সে তোমার কণ্ঠে দেখা দিয়েছে। ভবিষ্যতের ঋষি তুমি, চিরঞ্জীব মনীষী তুমি তোমাকে আজ আমাদের স্বাকার মানুষের নমস্কার। নেতাজী সুবাসচন্দ্র বসু বলেন- কারাগারে আমরা অনেকেই যাই, কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে সেই জেল জীবনের প্রভাব খুব কমই দেখতে পাই।
তার কারণ অনুভূতি কম। কিন্তু নজরুল যে জেলে গিয়েছিলেন তার প্রমাণ তার লেখার মধ্যে অনেক স্থানে পাওয়া যায়। এতেও বোঝা যায় যে, তিনি একজন প্রাণবন্ত মানুষ। তার লেখার প্রভাব অসাধারণ। তার গান পড়ে আমার মত বেরসিক লোকেরও গাইবার ইচ্ছে হত।
আমরা এমন প্রাণময় কবিতা লিখতে পারি না। নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়-এটা সত্য কথা। তার বিদ্রোহীতা স্পষ্টই বোঝা যায়। আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব-তখন সেখানে নজরুলের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে, তখনও তার গান গাইব।
আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সর্বদাই ঘুরে বেড়াই। বিভিন্ন প্রদেশের সঙ্গীত শুনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু নজরুলের দুর্গম গিরি কান্তার মরুর মত প্রাণমাতানো গান শুনেছি-বলে মনে হয় না। কবি নজরুল যে স্বপ্ন দেখেছেন, সেটা শুধু তার নিজের স্বপ্ন নয়-সমগ্র বাঙালি জাতির।
শৃঙ্খলমুক্ত করতে চেয়েছেন আমূল পরিবর্তন:আব্দুল কাদির বলেছেন- নজরুলের দেশপ্রেমমূলক কবিতাগুলির অন্তর্নিহিত কথা এই-বিপ্লবের জন্য বিপ্লব নয়, নবসৃষ্টির জন্য মহৎ মানবকল্যাণের জন্য চাই আমূল পরিবর্তন।
অরবিন্দ পোদ্দার বলেছেন- নজরুলের কাব্য সাধনার আরম্ভ,বিকাশ ও পরিণতি যেমন একটা গলায় যখন বাংলার জীবন ছিল অস্বাভাবিক মাত্রায় চঞ্চল, রূপান্তরের ঘূর্ণাবর্তে নিস্পন্দ। চাই বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তী সময়ে কালপ্রবাহে যারা অবগাহন করেছেন। তারাই জানেন সেই কালের অভিব্যক্ত স্বরূপটি কি, এবং তার চঞ্চলতার বেগ কতটা তীব্র। নজরুল সেই চঞ্চলতার সঙ্গে আত্মিক সংযোগ স্থাপন করেছিলেন, এবং তিনি ছিলেন তাদেরই একজন যাদের চোখে স্বপ্ন ছিল, যে স্বপ্ন তাদের কালো বর্তমানকে নীল ভবিষ্যতে নিয়ে যেত। তারা ছিলেন দুঃসাহসে দুর্বার ত্যাগে মৃত্যুঞ্জয়ী।
সম্মুখে তাদের একটিই মাত্র আদর্শ-ভারতবর্ষকে শৃঙ্খলমুক্ত করা।
দেশের মুক্তির জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের আহ্বান: কাজী আব্দুল ওদুদ বলেছেন- বিদেশি আন্দোলনের সম বীর্য নিয়ে নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে আবির্ভুত হলেন। তবে অপূর্ব তারণ্য আর অপূর্ব স্বাধীনতা-প্রীতি দেখতে দেখতে তাকে প্রিয় করে তুললো বাংলার আবাল বৃদ্ধ বণিতার কাছে। নজরুল ইসলাম এ কালের বাঙালি যিনি বাংলার মুসলমান ও হিন্দু উভয়ের চিত্ত আন্দোলিত করতে সক্ষম হলেন। সুশীলকুমার গুপ্ত নজরুলের চরিত্র মানস গ্রন্থে লিখেছেন- দুঃশাসনের রক্তপান কবিতায় নজরুল দেশের মুক্তির জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের কথাই বলেছেন।
সন্ত্রাসবাদকে এখানে গভীর আবেগের সঙ্গে সমর্থন করা হয়েছে। কবি বন্য ও হিংস্রভাবাপন্ন বীর সৈনিকদের আহ্বান করেছেন দেশের দুশমন সাম্রাজ্যবাদী ও স্বাধীনতা হরণকারী দুঃশাসনের রক্তপান করবার জন্য।
উপসংহার: অসহায় বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা নজরুল তার রচনা দ্বারা জনসাধারণের মনে বিদ্রোহের অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত করে দিয়েছেন। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অবদান রয়েছে। নজরুল স্বাধীনতার কথা সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে সামান্যতম সুযোগকেও গ্রহণ করেছেন।
তিনি তার গান কবিতা দ্বারা মানুষকে উদীপ্ত করেছেন স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে। যখন সকলে তাদের সাহস হারিয়ে ফেলেছিলেন তখন নজরুল তার গান দ্বারা তাদের সাহসী করে তুলেছেন। স্বাধীনতা তার কাছে এতই সুমহান এত বড় মূল্যবান জিনিস ছিল যে আজাদীহীন মানুষকে তিনি অভিশপ্ত, বিকলাঙ্গ, পঙ্গু বলে মনে করতেন। পাক ভারতের তেত্রিশ কোটি মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে খাওয়া নির্মম শাসকের বিরুদ্ধে মসীর সাহায্যে সংগ্রাম পাক ভারতের আর কোনো কবি সাহিত্যিক তার মত করেন নি। সেদিনের স্বাধীনতা সংগ্রহের সর্বোত্তম বীরের মর্যাদা আজাদীর তুর্যবাদক বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকেই দেওয়া উচিত।
স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রতকরণে মুক্তিপাগল নজরুলের জীবন ও কর্ম যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।