নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) বোমা বিশেষজ্ঞ হলেন জাহিদুল ইসলাম সুমন ওরফে বোমারু মিজান, সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন এবং রকিব হাসান ওরফে রাসেল ওরফে হাফেজ মাহমুদ। তিনজনই জেএমবির শূরা সদস্য। বিদেশি জঙ্গি সংগঠন থেকে বোমা তৈরি, বোমা হামলা ও ছোট-বড় অস্ত্র চালনায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। এ ছাড়াও তারা তৈরি করতে পারেন বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন ভূমি মাইন ও এন্টি পার্সোনাল মাইন। হ্যান্ড গ্রেনেড, বেল্ট বোমাও টিফিন ক্যারিয়ার বোমা তৈরি হয় এদের হাতেই। জেএমবির জঙ্গি সদস্যরা এদের কাছ থেকে অস্ত্র ও বোমা তৈরি ও হামলার প্রশিক্ষণ নিয়েছে। দেশের আইন আদালতে হামলার পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম হলেন এই তিন জঙ্গি নেতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খাতায় এরা দুর্ধর্ষ অপরাধী। এদের দুজনের মৃত্যুদণ্ড এবং একজনের যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। গতকাল ফিল্মি কায়দায় ময়মনসিংহের ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকায় প্রিজনভ্যানে গুলি ও বোমা হামলা চালিয়ে জেএমবির এ তিন শীর্ষ বোমা বিশেষজ্ঞকেই ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। এ ঘটনার ছয় ঘণ্টা পর টাঙ্গাইল থেকে পুলিশ রকিব হাসানকে আটক করতে সমর্থ হলেও লাপাত্তা রয়েছেন অপর দুই জঙ্গি নেতা। এই দুই জঙ্গি নেতা এখনো ধরা না পড়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ভাবিয়ে তুলেছে। আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে দেশজুড়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এদের ধরা না গেলে জেএমবির বোমা হামলা বাড়ার আশঙ্কা থাকবে। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশ কাঁপানো সিরিজ বোমা হামলায় ব্যবহৃত বোমার প্রধান কারিগর ছিলেন জেএমবির শূরা সদস্য বোমারু মিজান। সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিনের পরিকল্পনায় নেত্রকোনায় উদীচী অফিসের সামনে বোমা হামলা চালানো হয়। ওই ঘটনায় ৯ জন নিহত এবং আরও অনেকেই হন আহত। ১৭ আগস্ট ময়মনসিংহে বিস্ফোরিত সব বোমাই ছিল রকিবের হাতে তৈরি। একাধিক দেশ ভ্রমণ করা এই তিন জঙ্গি নেতার নেতৃত্বে সারা দেশে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া সর্বহারা নিধন কমিটিরও ছিলেন তারা হর্তাকর্তা।
কে এই বোমারু মিজান : পুরো নাম জাহিদুল ইসলাম সুমন। জেএমবিতে তিনি মিজান নামেই পরিচিত ছিলেন। তার প্রস্তুত করা বোমা ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সফলভাবে বিস্ফোরিত হওয়ায় তার নামের আগে বোমারু শব্দটি ব্যবহার হয়। তিনি হয়ে ওঠেন বোমারু মিজান। তার পরিকল্পনা ছিল ১০০ জন বোমার কারিগর তৈরি করবেন। বিভিন্ন প্রযুক্তি বোমা, ল্যান্ড মাইন ইত্যাদি তৈরি করে উত্তরবঙ্গের যে কোনো একটি জেলাকে পাকিস্তানের সোয়াতের মতো জেএমবির নিয়ন্ত্রণে নেবে। জামালপুর সদরের শেখেরভিটা এলাকার সুজা মিয়ার ছেলে মিজান। তার বিরুদ্ধে হয় ২৬টি মামলা। এর মধ্যে সাজা হয়েছে ৫টি মামলায় ৬৩ বছর, একটিতে যাবজ্জীবন সাজা রয়েছে। বাকিগুলোর বিচার চলছে। ২০০৯ সালের ১৪ মে রাজধানীর পীরেরবাগের বাসা থেকে তিনি গ্রেফতার হন। গতকাল থেকে তিনি আবারও লাপাত্তা। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জামালপুরের এক মেস সদসস্যের অনুপ্রেরণায় ২০০১ সালে যোগ দেন জেএমবিতে। স্থানীয় চরশী মাদ্রাসায় তিনি ট্রেনিং নেন। ওই বছরই জেএমবির অপর সদস্য রকিব হাসানের সঙ্গে রাজধানীর পাটুয়াটুলীতে একটি নিকেল কারখানায় কাজ নেন। সেখানেই মেশিন চালাতে চালাতে ক্ষুদ্র অস্ত্র তৈরি করতে থাকেন গোপনে। ২০০২ সালে তিনি শায়খ আবদুর রহমান, বাংলাভাইদের সঙ্গে দিনাজপুর যান। সেখানে গঠিত অ্যাকশন কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন। ওই বছরই জামালপুরে ব্র্যাক অফিসে তারা ডাকাতি করেন। সেখান থেকে তারা কম্পিউটার জেনারেটর লুট করেন। এভাবে তারা বিভিন্ন জেলার ব্র্যাক অফিসে ডাকাতি করতে থাকেন। একই বছর সাতক্ষীরায় রঙ্ িসিনেমা হলে দুটি টাইমবোমা, ময়মনসিংহ জেলার ৪টি সিনেমা হলে বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। ডিসেম্বরে বাংলাভাই ও অন্যদের সঙ্গে করে নাইক্ষ্যংছড়ি যান। তারা আরাকান আরএস ও ব্যাম্পে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এম-১৬, একে-৪৭ এবং রকেট লাঞ্চারের ব্যবহারও সেখানে তারা শিখে নেন। ইতোমধ্যে তিনি বোমা তৈরিতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। সূত্র জানায়, জেএমবির প্রধান বোমার প্রস্তুতকারক হিসেবে তিনি আলোচিত হয়ে ওঠেন। তার ফর্মুলায় তৈরি করা বোমা দিয়েই ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তবে ওইদিন তার দায়িত্ব ছিল কঙ্বাজার জেলায়। এরপর তিনি চলে যান ভারতের মুর্শিদাবাদে। সেখানে জেএমবির ভারতীয় সদস্য আরিফের কাছে আশ্রয় নেন। আরিফ নিয়মিত তার কাছে বোমা তৈরির পাওয়ার জেল, ডেটোনেটর সরবরাহ করতেন। মিজান এ সময় নিয়মিতভাবে পাশর্্ববর্তী দেশ থেকে অস্ত্র নিয়ে আসতেন। ২০০৬ সালে টাঙ্গাইলে তিনি বিয়ে করেন। এরপর চারটি বিভাগীয় শহরে বাসাভাড়া তরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলেন। সেখানে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিতেন মিজান। এরপর মিজান রাজধানীর মিরপুর মনিপুর ও পীরেরবাগে আলাদা দুটি বাসাভাড়া নেন। একটিতে তিনি বোমা তৈরির কারখানা স্থাপন করেন।
যেভাবে গ্রেফতার : ২০০৯ সালের ১৪ মে। রাতে শেওড়াপাড়ার উত্তর পীরেরবাগে জেএমবির আস্তানায় পৌনে চার ঘণ্টা শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান চালায় পুলিশ ও র্যাব। রাত সোয়া ২টার দিকে জেএমবি সদস্য বোমারু মিজানের স্ত্রী শারমীন হক লতাকে আটক করে র্যাব। অভিযানের সময় বোমার বিস্ফোরণে লতার ডান হাতের কব্জি উড়ে যায়। এ সময় রক্তমাখা অবস্থায় তার দুই শিশুসন্তান এবং দুটি গ্রেনেড, একটি অবিস্ফোরিত বোমা ও দুটি ম্যাগাজিনসহ একটি পিস্তল উদ্ধার করে র্যাব। পরে তার পূর্ব মনিপুরের ৬৭৬/২ ভবনের চারতলায় অভিযান চালিয়ে বোমার আস্তানার সন্ধান পায় র্যাব। বাড়িটির একটি কক্ষ থেকে বোমা তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম গ্রেনেড বডি (ধাতব আবরণ), ফিউজ, ডেটোনেটর, গ্রেনেড তৈরির প্লাস্টিক এঙ্প্লোসিভ, রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি উদ্ধার করা হয়। র্যাব এ আস্তানাকে গবেষণাগার বলে উল্লেখ করে। এমন কিছু সরঞ্জাম পাওয়া গেছে তা দিয়ে ব্যাপক বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন ভূমি মাইন ও এন্টি পার্সোনাল মাইন তৈরি করা সম্ভব। র্যাব জানায়, মিজান তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করেছেন। তিন কক্ষের তার বাড়িতে একটি কক্ষ থেকে রসায়নের বেশ কিছু বই এবং দুটি বিদেশি পিস্তল (নাইন এমএম ও সেভেন পয়েন্ট ৬৫) উদ্ধার করা হয়।
সালেহীন সালাউদ্দিন : নাম তার সালেহীন সালাউদ্দিন। কিন্তু সংগঠনে বিভিন্ন জেলায় তিনি সোহেল, সজিব, তাহীদ নামে পরিচিত। সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানিকে ২০১০ সালে কাশিমপুর কারাগারে নেওয়া হয়। সানি জেএমবির শূরা সদস্য। তার বিরুদ্ধে ৪০টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি মামলায় তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছে। ১৩ মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। ২৪টি মামলা এখনো বিচারাধীন। সালাউদ্দিন সালেহীন নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার ৫৮ সেন রোড এলাকার রফিকুল ইসলামের ছেলে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ১৯৯৮ সালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে একটি মাদ্রাসায় তিনি জানতে পারেন শায়খ আবদুর রহমান সম্পর্কে। পরের বছর তিনি শূরা সদস্য হন। ঢাকার বাসাবোতে তিনি সংগঠনের সদস্যদের অস্ত্র চালনা ও বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দেন। ধীরে ধীরে তিনি দেশের বিভিন্ন জেলায় বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। ২০০২ সালে জামালপুরে এক ব্যক্তিকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন। ময়মনসিংহের সিনেমা হলে বোমা হামলার ঘটনায়ও ছিলেন সালেহীন। মুক্তাগাছার ব্র্যাক অফিসে তার নেতৃত্বে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। রাজশাহী অঞ্চলে সর্বহারা নিধন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন সালাউদ্দিন। ময়মনসিংহে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয় সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে। এ ছাড়া দেশব্যাপী বিচারকদের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন মান্যব্যক্তিদের ওপর হামলার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে ছিলেন তিনি অন্যতম। সূত্র জানায়, ২০০৫ সালের শেষ দিকে এ বাড়ি থেকে ওই বাড়িতে পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। ২০০৬ সালের ২২ এপ্রিল চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতার হন এই জঙ্গি নেতা।
রাকিব হাসান : কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের হাজতি ছিলেন জঙ্গি নেতা রাকিবুল হাসান। তার বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ২৯টি বিচারাধীন। একটি মামলায় তার মৃত্যুদণ্ড, তিনটিতে যাবজ্জীবনসহ ৭৪ বছরের সাজা হয়। তিনি জামালপুরের মেলান্দহ থানার বংশীবাড়ি গ্রামের আবদুস সোবহানের ছেলে। ১৯৯৫ সালে যাত্রাবাড়ী মোহাম্মদিয়া মাদ্রাসা থেকে পাস করা রাকিবের দেখা হয় শায়খ আবদুর রহমানের সঙ্গে ঢাকার খিলগাঁওয়ে। তার পরিচয় হয় লস্কর-ই-তৈয়েবার সদস্য টুন্ডা করিমের সঙ্গে। টুন্ডা করিমের অনুপ্রেরণায় ১৯৯৮ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বর্ডার দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় যান। সেখানে পলাশী মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ওই বছরই তিনি দেশে ফিরে আসেন। শায়খ আবদুর রহমানের নির্দেশে তিনি ঢাকা, বগুড়া, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারীতে আহলে হাদিস মসজিদ সফর করেন। জঙ্গি প্রচারণা চালান। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পর রাকিবের নেতৃত্বে মার্কিনিদের বিরুদ্ধে মিছিল করেন ঢাকার রাস্তায়। ২০০২ সালে নেত্রকোনায় সিনেমা হল ও সার্কাসে বোমা হামলা, ২০০৪ সালের টাঙ্গাইলে একজনকে হত্যা, ২০০৪ সালে রাজশাহীতে সর্বহারা নিধন কমিটির হয়ে হত্যাযজ্ঞ, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট তার তৈরি করা ৫৩টি বোমা খুলনায় একযোগে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ ছাড়া ঝিনাইদহে ৩৫টি বোমাও তার হাতে তৈরি। তিনি বিভিন্ন জেলায় গিয়ে বোমা বিস্ফোণের কৌশল শিখিয়ে দেন। অবশেষে ২০০৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি যশোর থেকে তিনি ঢাকায় নেমে বায়তুল মোকাররম মসজিদের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরিতে যান। সেখান থেকেই তাকে গ্রেফতার করা হয়।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।