ভালো আছি
নীল সমুদ্র, নীল আকাশ, নীল বাতাস, নীলে রঞ্জিত প্রকৃতির কোলে অতি সন্তর্পণে হেঁটে চলেছি আমরা। আমরা দশজন। দশ বন্ধু। পায়ের তলায় মর্মর ধ্বনী। শোকেসে সাজানো ঝিনুকগুলো কী যে নিদারুণ নিষ্পেষণে ভেঙে যাচ্ছে, ভাবলে মনে ব্যাথা লাগে।
অথচ এখানে পড়ে আছে অজস্র; এতো বেশি যে, আমরা দশজন তো ভালো, দশ হাজার পায়ের আঘাতে গুড়িয়ে কুলানো যাবে না। তখন আবার হাসি পায়।
-‘ভাঙ্- কতো আর ভাঙবি। পারলে বস্তা ভরে বাড়ি নিয়ে গিয়ে আরো ভাঙিস। ’
কে বলল কথাটা? দেহটা একটা অশরীরি স্পর্শে কেঁপে উঠলো যেন।
পাশে তো কেউ নেই; শুধু অথৈ সমুদ্র। সমুদ্রের নোনাজল আর কলজে কাঁপানো উত্তাল তরঙ্গ। নিরস বাতাসের দাপট পরিধেয় কাপড়খানা ছিঁড়ে ফুঁড়ে আদিম মানব বানাতে চায়।
আবার সহসা ঝলকে এলো রিনরিনে হাসির গহীন সুর। মনটা এবার আরো বেশি সংকুচিত- সত্যিই পরীটরী আছে নাকি এখানে!
অবশেষে মগ্নতার কুয়াশা কাটলো সাব্বিরের কৌতূহলেÑ শাহপরীর দ্বীপ মানে কী? কোন পরীর বাদশার দ্বীপ এটা?
এই কৌতূহল এখানকার চাছাছোলা মানুষ ছাড়া আর সবার আছে।
যাকেই ধরি, বলি, ভাই, মানে কী? বলে, আসলে এটা সাগরের মধ্যকার একটা দ্বীপ ছিলো। পরে বালিয়াড়ির পর বালিয়াড়ি জড়ো হতে হতে সৈকতের সাথে মিলে গেছে।
-ধুর মিঞা, কী কথার কী জবাব। এটা কেমনে দ্বীপ থেকে বিচ হলো, তাতো গুগল সার্চ দিলেই পাবো। আপনে বলেন, নামটা শাহপরীর নামে হলো কেন?
-তেইলেওটাও সার্চ দিয়ে নেন।
এই হলো উলুখাগড়া মার্কা জবাব। এবার বুঝলেন তো চাছাছোলা বলছি কেন।
পাক্কা দু’মাসের সফর আমাদের। নাইক্ষংছড়ির অরণ্যঘেরা পাহাড়ের চুড়া ফেটে নাফ নদী বয়ে চলছে যেই অববাহিকা থেকে, আমাদের পদযাত্রার শুরুটা সেখান থেকেই। জায়গাটার নাম উখিয়া।
এখান থেকে নাফ ও সাগরের সঙ্গমক্ষেত্রের দূরত্ব ৮৬ কিলোমিটার। পুরোটা পথ পায়ে হাঁটবো আমরা। ভারতের একটা পাহাড়ি এলাকার নাম রিখিয়া- উখিয়ার সাথে বেশ ছন্দমিল। চট করে মনে পড়ে গেলো শীর্ষেন্দুর ‘যাও পাখি’ কাহিনীটা; নায়িকার নাম রিখিয়া। তাও আবার তার ছোট কাকু এলাকার নাম শুনেই রেখে দিয়েছেন।
এ নিয়ে অবশ্য নায়িকার উন্নাসিক ভাবের বেশ জম্পেশ বর্ণনাও আছে সেখানে। রিখিয়া নাম নাকি মোটেও পছন্দ নয় তার। সে চায় তার নাম হবে অপরাজিতা। স্কুলেও এ নামে ডাকে তার বান্ধবীরা। ...
-আহ্ হা, নকীব ভাই, আবার ভাবালুতা।
আপনি যে সাহিত্যের একজন মধুকুমার কেউকেটা- সেটাতো জানি। কাহিনীটা বলবেন না? নাকি অপরাজিতার কাছে পরাজিত হবেন?
-কোন কাহিনী? যাও পাখি?
-না, শাহপরীর দ্বীপ।
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ অঞ্চল টেকনাফ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অবস্থিত শাহপরীর দ্বীপ। এটি মূলত সাবরাং ইউনিয়নের একটি গ্রাম। একসময় দ্বীপ থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কিছুকাল আগে এটি মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে।
টেকনাফ উপজেলা শহর থেকে শাহপরীর দ্বীপের দূরত্ব প্রায় পনের কিলোমিটার। লোকে বলে, এই জনপদের সাথে মোঘল সম্রাট শাহজাহানের মেয়ে পরী বানু ও পুত্র শাহ সুজার নাম জড়িয়ে রয়েছে। শাহপরীর দ্বীপের নামকরণ হয়েছে শাহ সুজা ও পরী বানুর নাম থেকেই। জনশ্রুতি আছে, মোঘল সম্রট শাহজাহানের পুত্র-কন্যাদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত শাহ সুজা ও মেয়ে পরী বানু পালানোর এক পর্যায়ে শাহপরীর দ্বীপে কিছুকাল যাপন করেছিলেন। আবার অন্য একটি মতে শাহ ফরিদ আউলিয়ার নামেই এ দ্বীপের নামকরণ।
অপরদিকে অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি সাবারিদ খাঁর ‘হানিফা ও কয়রাপরী’ কাব্য গ্রন্থের অন্যতম চরিত্র এই শাহপরী। রোখাম রাজ্যের রাণী কয়রাপরীর মেয়ে শাহপরীর নামেই দ্বীপের নামকরণ হয়েছে বলেও অনেকে বলেন। শাহপরীর দ্বীপের নামকরণের এরকম আরো অনেক ইতিহাস প্রচলিত আছে স্থানীয়দের কাছে।
নারকেল, সুপারি, পান আর লবণ উৎপাদনের প্রসিদ্ধ এ এলাকায় প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বসবাস। প্রতি বছর কয়েক শ’ কোটি টাকার সামুদ্রিক মাছ এই দ্বীপ থেকে সারা দেশে জোগান দেওয়া হয়।
এখান থেকে জীবনানন্দের ‘দারুচিনি দ্বীপ’ সেন্ট মার্টিনের দূরত্ব মাত্র ১০ মাইল। আকাশের মন ভালো থাকলে নাফ নদীর দীর্ঘকায় জেটিতে দাঁড়িয়ে খালি চোখেই ধরা যায় নারিকেল জিঞ্জিরার ভাসমান প্রতিচ্ছবি।
সুবে সাদিকের ক্ষণে আলোর যাত্রা আর আমাদের পদযাত্রায় সামান্যও কালক্ষেপন হয়নি আজ। যে করেই হোক আজই নদী-সাগরের মিলনটা দেখে নেবো। বুকে মূসার মতো আরাধ্য বিজয়ের আতীব্র তৃষ্ণা।
সেই যে ভোর বিহানে হাঁটতে নেমেছি, তারপর সকাল আটটায় সৈকতে এসে তবেই কেক-বিস্কিট আর কোমল পানীয়র নাস্তা পেয়েছি।
সহসা দূরের স্বচ্ছ নীল আকাশ আর সুনীল সমুদ্রের দিগন্তজোড়া একাকার রূপে বিমুগ্ধ হয়ে গেলাম আমরা। সুগভীর আচ্ছন্নতায় অবসন্ন যেন সারাটা অস্তিত্ব। এ কেমন সম্মোহন! আচ্ছা, প্রকৃতিই কবিতা, নাকি কবিতার নান্দনিক অবয়ব এই প্রকৃতিÑ ‘পিগলী হুয়ি নিলাম সে বেহতর ইয়ে সমন্দর; না কাহিঁ হ্যায় যমীন, না কাহিঁ আসমান। নীলি, নীলি সে খামুশিয়াঁ।
কেহ রহী হ্যায়, ব্যস্, এক তু হ্যায়; ম্যাঁয় হো, মেরে সাঁসে হ্যায়, আওর মেরে ধারকান। আপনে হোনে ভী মুঝকো একীন আ গায়া। ’
এমন তীক্ষè অন্তর্ভেদী কাব্যের অনুবাদ আমার জানা নাই। অতএব, ক্ষমাই মহৎ গুণ- এই প্রবাদ বাক্য আগলে আঁকড়ে ধরে প্রকৃতি স্রষ্টা সমীপে ক্ষমা চেয়েছি বারবার। আর ভাষার দৈন্যতার সুফলে অনুবাদের হাত থেকে ফসকে বেরিয়ে যেতে পেরেছি, তাই নিজেকে সাধুবাদ জানালাম অজস্রবার।
এখন রাত নয়। মধ্যাহ্ন দুপুর। আকাশে এক চিলতে মেঘ নেই। ঝকঝকে রোদ্দুর। রাত নেই, তাই তারার মেলা নেই।
আলোর জোছনা নেই। কিন্তু এখানে, এই পরীর দ্বীপে নীলাভ প্রকৃতির মাঝে আদিগন্ত বালুকাবেলায় ছড়িয়ে আছে লক্ষকোটি ঝিনুকের কারুকাজ। গর্ভের খনিতে কি মুক্তোর নূড়িও আছে ওদের? না হলে তারার মতো মিটমিটিয়ে জ্বলছে কী করে। আকাশে দপদপে দিবাকর, মাটিতে মিটিমিটি তারা- পরীর দ্বীপের মাত্র এইটুকু সৌন্দর্য।
অনন্তর আমাদের চোখে ভেসে ওঠে মানচিত্রের সেই কাক্সিক্ষত ত্রিভূজের ছবি।
উত্তর হতে দক্ষিণমুখী সমুদ্র এসে মিলেছে পূব-পশ্চিম বাহিত নদিনীর নাভিমূলে। সেখানে সাগরের পৌরুষ পরম উল্লাসে আছড়ে পড়ে কল্লোলিত নাফের কোমল শরীরে। খুলে ফেলতে চায় তার অকৃত্রিম অবগুণ্ঠন, যেন চরিতার্থ করবে সে সহস্র বছরের অাপোষ্য বাসনা। এইভাবেই অক্লান্ত আকুলতায় ভরিয়ে দিতে চায় সে দর্শকের তনুমন, অশান্ত অস্থির হৃদয়।
তবে এতক্ষণে সত্যিকার অর্থেই আমরা ক্লান্ত এবং শ্রান্ত।
ফের পেছনের দীর্ঘ পথে ঘুরে যেতে চাইনা বলে নদীতে মাছ ধরতে আসা বেরসিক জেলেদের সঙ্গে সমঝোতা করে নিলাম। নাফের পানিটুকু পেরিয়ে ওপারে থকথকে কাদায় আমাদের পৌঁছে দেবে তারা। কিন্তু ওরা কেউ কথা রাখে নি। মাঝ নদীতে একরকম ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো আমাদেরকে। তবু ভয় নেই, সাঁতার জানি যে! আমরা তো নদীর দেশের সন্তান।
কিন্তু হায়, সাঁতরানোর সুযোগ পেলাম কই। মাঝ নদীতে হাঁটুজল!
তীরে উঠে দেখি অপূর্ব দৃশ্য। রঙিন কাঁকড়ার সুবিশাল সমাহার। এবার সচকিত সাব্বির। আমাকে ইশারা দিলো- বস, দেখেন, কাঁকড়াটা কত্ত বড়।
কাঁকড়া কই। আমি তো দেখছি, লতাপাতার পোচ দেয়া একমাথা আর্মি হেলমেট।
‘হোল্ট’। ও বাবা, এ তো দেখছি সত্যিই আর্মি। ভূবন মোহিনী হাসি ছড়িয়ে একজন সীমান্ত প্রহরী সৈনিক শুধালেন- ভয় পেয়েছেন নাকি? কোত্থেকে এলেন, বার্মা থেকে?
-না, মগের মুল্লুক থেকে।
মনে মনে বললাম। জানতাম, ইতিহাসের ‘মগের মুল্লুক’ এই অঞ্চলকেই বলা হয়। মুখে বললাম- আঙ্কেল, আপনার সাথে একটা ছবি তুলি?
বললাম বটে, তবে আগাগোড়া সন্দিহান ছিলাম আবেদনে তার মর্জি হবে কি না। ‘আঙ্কেল’ অবশ্য ভালো মানুষ। সব সন্দেহ জলে ফেলে ক্যামেরার সামনে পোজ দিলেন।
ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক। ক্যামেরার ঝলকানি দেখে দৌড়ে এলো বাদবাকি নয়জন। আর সারাপথ ধরে সযত্নে কুড়ানো অমূল্য সম্পদগুলো মুহূর্তেই পরিণত হলো মূল্যহীন ধূলোয়। ভেঙে গেলো খেলাঘর। কোষভর্তি, পকেটভর্তি, আঁজলা ভর্তি সৈকতের সব নূড়ি, করি, শামুক ও ঝিনুক ছুড়ে ফেললো সবাই নাফ নদীর মোহনায়।
ওরাও মুক্তি পেলো, ঠাঁই পেলো আপন ঠিকানায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।