মুসাফির। হাঁটছি পৃথিবীর পথে পথে, অনিশ্চিত গন্তব্যে। কাগজের নৌকা দিয়ে সাগর পাড়ি দেবার দুরন্ত প্রয়াস।
রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে বহু কথাই থাকতে পারে। কিন্তু বর্তমান রাজনীতি এখন এক কথায় দুর্বৃত্তদের খপ্পড়ে; চরমভাবে দূষিত ও কলুষিত।
একদিকে সমাজ-রাষ্ট্রের সবকিছুকে রাজনীতিকায়ন; অন্যদিকে স্বয়ং রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়ন, কলুষিতকরণ, রাজনীতিতে প্রকাশ্য মিথ্যাচার ও নির্লজ্জতার অনুশীলন, হিংসা-প্রতিহিংসা চরিতার্থকরণ অতঃপর সগর্ব আস্ফালন সহ্যের চূড়ান্ত সীমায় উপনীত। সমাজ-রাষ্ট্রে এখন যত অন্যায় অত্যাচার হচ্ছে- ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন, গুম-হত্যা-লুণ্ঠন, দুর্নীতি, মারামারি-হানাহানি-কাটাকাটি, জেল-জরিমানা- সবই রাজনৈতিকভাবে। নবপ্রজন্ম দেখছে মানবতার এক বীভৎস রূপ। তারা আমাদের কাছ থেকে কি শিখবে, কি শিখছে? এতদিন যেসব অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবা-মানবতা রাজনীতির আওতার বাইরে ছিল তাও আজ গ্রাসাচ্ছাদিত। এমনকি বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবার আজ গৃহাভ্যন্তরে সরকারি দল, বিরোধী দল ও তৃতীয়শক্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়-পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সর্বপ্রকার শান্তি-শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে। শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সম্পর্ক সব তছনছ করে দিয়েছে অপরাজনীতির রক্তাক্ত হাত। সামনের সময়টা আরো ভয়াবহ!
প্রধানমন্ত্রী যেমন সংসদে দাঁড়িয়ে অথবা জাতির উদ্দেশে ভাষণে নিজেদের সাফল্য প্রমাণে বিরোধী দলের অতীত ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও কথিত মৌলবাদের ঘাড়ে দোষ চাপান, ব্যাপক মিথ্যাচারের আশ্রয় নেন, বিরোধী দলীয় নেত্রীও ঠিক একই পন্থা অবলম্বন করেন। বড় দুটি দলের ভেতরের পুরুষরা যেমন দুই নেত্রীর স্বৈরাচার ও জাতির সঙ্গে খামখেয়ালীপনা থামানোর যোগ্যতা রাখেন না, এর বাইরের ছোট দলগুলোও ‘দুই মহিলার’ মোকাবেলায় নিজেদের দাঁড় করাতে পারছেন না। এমনকি রাজনীতির বাইরের সুশীল ও বুদ্ধিজীবী নামক ‘পুরুষরাও’ দুই মহিলাকে নমঃ নমঃ করা ছাড়া- আদেশ করার কোনো সাহস ও ক্ষমতা রাখেন না।
ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। সংলাপ নিয়ে নাটক, টালবাহানা, শর্ত-পাল্টা শর্ত, হরতাল-ভাংচুর-খুনোখুনি, হালে ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ফাঁকা মাঠে বিজয়ী মন্ত্রী-এমপিদের লাগামহীন প্রলাপ জাতির জন্য এক অশনি সংকেত। তবে কি আবার আসছে এ জাতির কপালে বিদেশি শাসন?
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার পূর্ণমেয়াদ ক্ষমতা ভোগ করার পরও ইতিবাচক রাজনীতির প্রবর্তন, দলীয় বিবেচনার বাইরে প্রাজ্ঞ ও আদর্শিক ব্যক্তিত্বদের মূল্যায়ন, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন, শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটি চিহ্নিতকরণ ও সংস্কার, প্রশ্ন ও সমালোচনায় বিরোধী দলকে স্বাগত জানানো এমনকি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ক্ষমতার পুনর্বণ্টন, সংসদকে ঢেলে সাজানো, রাষ্ট্র পরিচালনায় বিরোধী দল ও বিরোধী শক্তিগুলোর কার্যকর সহযোগিতা নেয়া- এসব ক্ষেত্রে কী করেছে? আজ আওয়ামী লীগ যা করছে, সেদিন কি বিএনপি-জামায়াত তা করেনি? এবং ভবিষ্যতে অন্য কেউ ঠিক তাই বা এরচেয়ে বেশি করবে না? কেন করবে না? এর বাইরে তাদের রাজনৈতিক-সামাজিক-মানবিক দর্শন কি? সেই দর্শনের বাস্তবতার প্রমাণ কি? এমনতরো অসংখ্য প্রশ্ন; অগুণতি জিজ্ঞাসা! ‘রাজনীতিকে’ জনসাধারণের মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষা রাখে। ব্যাপক পর্যালোচনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ অপরিহার্য। আর এক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা-সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধা-ভালোবাসার বিকল্প নেই।
অজ্ঞরা যেকোনো আন্দোলন-বিপ্লবের জন্য একেবারে জান-প্রাণ দিয়ে দিতে প্রস্তুত। কেউ কেউ এটাকে জেহাদও বলে; মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী। অথচ জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র। আসলে বিপ্লব খুবই সহজ। কিন্তু বিপ্লবোত্তর সরকার গঠন ও পরিচালনা, টেকসই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা জাতি গঠন- খুবই কঠিন।
পর্যাপ্ত পূর্ব-প্রস্তুতির অপেক্ষা রাখে। আন্দোলন-সংগ্রামের অনেক প্রকার আছে। একমাত্র জ্ঞানগত বিপ্লবই আমাদের কাম্য। এ বিপ্লব টেকসই, মানবসমাজের সত্যিকার উন্নয়ন, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় মাইলফলক। এ বিপ্লব বা আন্দোলন কেউ ঠেকাতে পারে না।
ক্ষমতা ও অস্ত্রের শক্তি দিয়ে দমন করা যায় না। বাংলাদেশি বা বাঙ্গালি জাতির গঠন অতি দুর্বল। যেকোনো মুহূর্তে ভেঙ্গে পড়তে পারে। তাই কিছু মৌলিক প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান জরুরি। আর এটা কাউকে ‘মাইনাস’ করে সম্ভব নয়।
তবে হ্যাঁ, অতীত অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার, সাজা, ক্ষমা, মানবতা- এসবের সমন্বয়েই জাতি এগিয়ে যাবে। বর্তমান সরকার চাইলে এ সুযোগটি লুফে নিতে পারে। শুধু আন্তরিকতাই যথেষ্ট নয়, সঠিক পথ-পদ্ধতিও আবশ্যক। প্রয়োজনে এ সম্পর্কে ‘জাতীয় সংলাপের’ আয়োজন করা যেতে পারে। ব্যাপক ভিত্তিতে আলোচনা-পর্যালোচনা, প্রশ্নোত্তর ও জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে যেকোনো মতভেদ বা জাতীয় অনৈক্য দূর হতে বাধ্য বলে আমাদের বিশ্বাস।
জ্ঞানের মৌলিক সূত্রও তাই বলে। তরুণ চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী সমাজ, শিক্ষক সমাজ, সাংবাদিক মহল, ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক সবাই উৎকণ্ঠিত; আবার না কখন রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, অথবা আরো বড় কোনো আঘাত দেশ-জাতির ওপর নেমে আসে। চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার নিরসন না ঘটলে একটা না একটা সমস্যা হবেই।
সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ এ মুহূর্তে নেই। পরিবেশ কোনো সরকারই করেনি, এখন হঠাৎ করেই সম্ভব নয়।
তাছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের অর্থনীতির উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। এখন জনগণ কোনো জোট-মহাজোটকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই অনেকেই মনে মনে কথিত গণতান্ত্রিক সরকার চান না। চান আগামী দশ বছরের জন্য একটি জাতীয় সরকার। এ সময়ে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থান একটা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে যাবে বলে তাদের বিশ্বাস।
একটা শিশু-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতি পাঁচবছর পরপর নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাত-সহিংসতা জনগণ আর দেখতে চায় না। তার ওপর প্রতিটি সরকার গঠনের পরদিন থেকেই বিরোধী দল মাঠে নামে ‘সরকার পতনের’ টার্গেট নিয়ে। অপরদিকে সরকারও ‘শক্ত হাতে’ দমনের নামে গণহত্যা ও ব্যাপক ধরপাকড় চালায়। এতে আর যাই হোক, শান্তি-শৃঙ্খলার উন্নয়ন কস্মিনকালেও সম্ভব নয়।
১৮ দলীয় জোট দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি এবং নবগঠিত সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি বলে উপজেলা নির্বাচনেও তাদের অংশ নেয়া ঠিক হচ্ছে না অথবা সরকার বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে বলে শেখ হাসিনা ও কতিপয় মন্ত্রী-এমপি যে বাক-বিতণ্ডায় মেতেছেন তা সম্পূর্ণ ভুল।
কেননা জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের মৌলিক তফাৎ আছে। উপজেলা নির্বাচনে দলীয় বিবেচনায় প্রার্থী দেয়া সংবিধান বিরোধী। ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ প্রশ্নে যে নির্বাচনব্যবস্থা, সেটা নিয়ে অমন রাজনৈতিক নোংরামী কাম্য নয়। তাছাড়াও, সন্তান ‘জারজ’ হলে দোষ পিতামাতার, সন্তানের নয়। নীতিগতভাবে সন্তান ভরণ-পোষণ ও সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার দাবি করতে পারে।
এতে করে পিতামাতার ‘আকাম’ বৈধ হয়ে যায় না। বৈধ-অবৈধ যে পন্থায়ই হোক, স্বাভাবিক সুস্থতা থাকলে নারী-পুরুষের মিলনে সন্তান আসবেই। তেমনি যখন যে সরকারই আসুক, বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনও আসবে। তাই আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে বর্তমান ১৯ দলীয় জোটের অংশগ্রহণে সরকার বৈধতা পাবার প্রশ্নই আসে না। বৈধতা পেতে চাইলে অন্য কোনো উপায়ে হতে পারে।
যাহোক, সরকারের বাচালতায় এখানে দুটি বিষয় স্পষ্ট। এক. জাতীয় নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনেও সরকার বিরোধী জোটকে দূরে রাখতে চাইছে। দুই. সরকার নিজেও নিজেকে বৈধ মনে করে স্বস্তি পাচ্ছে না।
তাই শেষ পর্যন্ত যদি বিরোধী জোটকে দূরে রাখা নাই যায়, তাহলে খেলবে অন্য খেলা। কোনো কারণ দেখিয়ে হয় তফসিল বাতিল করবে, নয়তো নিজেদের বৈধ বলে আরেক দফা নাচবে।
যেমনভাবে বিগত পাঁচ সিটি নির্বাচনে হেরে নির্বাচন কমিশনকে ‘নিরপেক্ষ’ হিসেবে প্রমাণ হাজির করেছিল। আওয়ামী লীগ সত্যিই অনন্য। তাদের থেকে শেখার আছে প্রচুর। এক চালে একাধিক অপশন রাখা, মাঠ ফাঁকা রাখার ব্যবস্থা করে মনের সুখে গোল দেয়া, তলে পড়েও আকাশ দেখে জয়ের আনন্দে নাচা- অনেক কিছুই। উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের ঘোষণায় সরকার বড্ড ভয় পেয়েছে।
কারণ দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন ঢেলে সাজাবার পরও বিএনপি কি বিপুল বিজয় অর্জন করতে পারে তা প্রকাশ হয়ে যাবে। জনগণ ব্যালটে জবাব দিতে উন্মুখ।
তো যা বলছিলাম, এই যে সর্বব্যাপী রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, রাজনীতি কর্তৃক সমস্ত পরিবার-প্রতিষ্ঠান গ্রাসকরণ, সর্বস্তরের ক্ষমতা কেন্দ্রিভূতকরণ, এর দায়ভার কার? শুধুই রাজনীতিকদের? শিক্ষক, চিন্তাশীল, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের নয়? দেশ ও মানুষের ‘সেবার’ কথা বলে রাজনৈতিক তস্কররা যেমন পেট পালার একটা পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে, ঠিক এ ব্যবস্থাটাই আরো সম্মানের সাথে করে সমাজের পরজীবী একটা শ্রেণি, যাদের আমরা সুশীল ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে চিনি। তাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে রাজনীতিকদের গালাগাল করা, সবদোষ তাদের ঘাড়ে চাপানো। টিভি টকশোয়, পত্র-পত্রিকায়, সভা-সেমিনারে।
কেউ চাইলে এই দ্বিতীয় পক্ষটিকে কেন্দ্র করে আরেকটি বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। এখানে কাজ হবে, রাজনীতিকদের তোষামুদি ও বুদ্ধিজীবীদের গালাগাল এবং দোষারোপ করা।
এভাবে কি পশু-সমাজের মতো মানবসমাজেও আমরা ‘খাদ্য-খাদক’ সম্পর্ক গড়ে তুলব? আসলে সুনির্দিষ্টভাবে কারও ঘাড়ে দায় চাপানো মুশকিল। তবে যিনি বা যারা বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করবেন তাদের যতবেশি সম্ভব নিজের কাধে দায়িত্ব তুলে নেয়া আবশ্যক। অন্যকে দোষারোপ করে কোনোই লাভ নেই।
দেখতে হবে আমি এবং আমরা কি করতে পারি। আমাদের মনে রাখতে হবে পরিস্থিতির যত অবনতিই হোক এবং দোষ যাদেরই হোক, প্রকৃত দায়িত্বশীলদের এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ হতে হবে, সবার প্রতি সমান উদার হওয়া লাগবে এবং অতীত ও উপস্থিত রাগ-ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা খুবই সহজ, কিন্তু অন্যায়ের বীজ উপড়ে ফেলা বড় কঠিন। কারণ বীজ যে আমাদের মধ্যেই লুকিয়ে। যেসব বুদ্ধিজীবী ও সুশীলগণ উন্নয়ন উন্নয়ন হাঁক ছাড়েন, তাদের জিজ্ঞেস করে দেখুন তারা নিজেদের ফর্মূলায় নিজেরা কতটুকু বিশ্বাস করেন।
অথবা তাদের ফর্মূলায় উন্নয়ন ও পরিবর্তনের বাস্তব রূপরেখাটা কী? এ প্রশ্নগুলো মৌলিক যে, আমরা কিভাবে কি করলে সহনশীলতা অর্জন করব, কি করে ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলব, ধর্মীয় সম্প্রীতি আরো মজবুত করব এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করব।
জাকির মাহদিন : ৫১তম সংখ্যা, সাপ্তাহিক লিখনী , ১৮ ফেব্রোয়ারী '১৪
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।