কর্পোরেট কালচার আধুনিক শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক আলোচিত। উৎপাদন ও উন্নয়ন উদ্যোগে ভূমি, শ্রম, পুঁজি, মালিক-শ্রমিকদের সমন্বিত ও পরিশীলিত প্রচেষ্টা সাফল্যের চাবিকাঠি। মানব সম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রমের দ্বারা দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতিগত উন্নয়ন হয়। বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টিতে সকলের সুচিন্তিত মতামত প্রকাশের সুযোগ, কর্তব্য পালনে দৃঢ়চিত্ত মনোভাব পোষণ, উদ্দেশ্য অর্জন তথা অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর ঐকান্তিক প্রয়াস, স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস জরুরি। জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগে থাকা চাই প্রতিটি নাগরিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবদান।
অপচয়-অপব্যয় রোধ, লাগসই প্রযুক্তি ও কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বনের দ্বারা সীমিত সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিতকরণে সকলের মধ্যে অভ্যাস, আগ্রহ ও একাগ্রতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা দরকার। নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে ত্যাগ স্বীকার ও দায় দায়িত্ব পালন ছাড়া স্বাধীনতার সুফল ভোগের দাবি অযৌক্তিক।
যদি বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে পরিণত করা না যায়, উপযুক্ত কর্মক্ষমতা অর্জন ও প্রয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করা না যায়, তাহলে উন্নয়ন কর্মসূচিতে বড় বড় বিনিয়োগও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। চাকরি যখন সোনার হরিণ তখন চাকরি পাওয়া এবং রাখার জন্য অস্বাভাবিক দেনদরবার চলাই স্বাভাবিক। স্বনির্ভর হওয়ার আগ্রহতেও অনীহা মানব সম্পদ অপচয়ের বড় কারণ।
সকলের কঠোর পরিশ্রম, কৃচ্ছতা সাধন ও আত্মত্যাগ দেশের উন্নয়নের জন্যে যেখানে আবশ্যক সেখানে সহজে ও বিনা ক্লেশে কিভাবে অর্থ উপার্জন সম্ভব সেদিকেই ঝোঁক বেশি হওয়াটা সুস্থতার লক্ষণ নয়। সমাজে অস্থিরতা ও নাশকতার অন্যতম কারণ হচ্ছে, অবৈধ সম্পদ অর্জন, অধিকার বর্জন এবং আত্মত্যাগ স্বীকারে অস্বীকৃতি মুখ্য।
শিল্পায়নের ক্ষেত্রে দেশাত্মবোধ বিবেচনা না করলে বিদেশি সামগ্রীর প্রতি আগ্রহ ও আসক্তির কারণে দেশি শিল্পপণ্যের বাজার সংকুচিত হয়। খুব মনোযোগ ছাড়া সফট স্কিল তৈরি হয় না, ব্যক্তির ইমোশন, কালচার চর্চা, কাজের প্রতি কমিটমেন্ট, ব্যবহার, সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করার বিদ্যা, লিডারশিপ, কমিউনিকেশন স্কিল দরকার হয়। রাগ হলে, চাপ পড়লে, পাঁচটা কাজ একসঙ্গে ঘাড়ে চাপলে, কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয় সব কিছুই নির্ভর করে সফট স্কিলে কতটা দক্ষ তার উপর।
বিহেভরিয়াল সায়েন্স বা অর্গানাইজেশনাল বিহেভিয়ার সংক্রান্ত নলেজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা অর্গানাইজেশন কীভাবে কাজ করে, তার সিস্টেম, প্রসেস ইত্যাদি ‘স্টাডি’ করা, অর্গানাইজেশনে কী ধরনের কাজের সুযোগ আছে এবং কী কাজ করা হচ্ছে তা বুঝা, একটি অর্গানাইজেশনে লোকদের মধ্যে সম্পর্ক, তারা একসঙ্গে কোনও কাজ কীভাবে করছে সেটা বুজতে পারাটা সফ্ট স্কিল। যে এ সফ্ট স্কিল যত তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করতে পারবে, কাজের জগতে সফল হওয়ায় ততটাই এগিয়ে থাকবে।
বাংলাদেশের মূলধারার কর্পোরেট মিডিয়ার সাংবাদকিতার কর্মসূচিগুলো হলো: ১. নিজ নিজ বিজনেস-গ্রুপের পুঁজি-মুনাফা-ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করা; ২. প্রাইভেট সেক্টরের সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষা করা; ৩. দেশী-বিদেশী কর্পোরেট পুঁজির অনুকূল সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ গঠন করা, একটা ভোগবাদী সমাজ গঠন করা; ৪. ব্যবসার অনুকূল রাজনৈতিক ‘স্থিতিশীলতা’ বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করা ৫. সামাজিক-সাংস্কৃতিক-বেসরকারী পরিসরের এলিটদের নিয়ে রাজনৈতিক দলের পাল্টা সামাজিক শক্তি হিসাবে ব্যবসায়ীদের পরিচালনাধীন একটা সুশীল সমাজ গঠন করা এবং তার নেতৃত্ব ঐ ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি হিসাবে সংবাদপত্রের বা মিডিয়ার হাতে রাখা।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) নবুয়ত প্রাপ্তির আগে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যর প্রসারে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।
খোলাফায়ে রাশেদিনের চার খলিফাও ব্যবসা-বাণিজ্য করায় সহযোগিতা করেছেন। কোরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সচ্ছল ও সুখী কাপড়ের ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ইসলাম গ্রহণের সময় প্রায় ৪০ হাজার দিনারের মালিক ছিলেন। জাহেলিয়া যুগে তিনি অনেকবার মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে আর ইসলাম গ্রহণের পরও ব্যবসার উদ্দেশে দূরদূরান্তে সফর করেছেন। তবে মদিনাকেন্দ্রিক ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি খেলাফতের গুরুদায়িত্ব যথাযথভাবে পালনার্থে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন।
হজরত ওমর ফারুক (রা.) ইসলাম গ্রহণের আগে ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশে বহু অঞ্চল সফর করেন।
খেলাফতের মহান দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি নিজের পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণ চালিয়ে নিতে তিনি ব্যবসা করতেন। খলিফা হজরত ওমর ফারুক (রা.) যখন শাহাদতবরণ করেন তখন তাঁর কাছে বায়তুল মালের ৮০ হাজার দিরহাম পাওনা ছিল। তিনি ওই অর্থ নিজের ব্যবসায় বিনিয়োগ করার জন্য বায়তুল মাল থেকে ধার হিসেবে নিয়েছিলেন। খলিফা হজরত ওমরের ফারুক (রা.)-এর পুত্র আবদুল্লাহ বিন ওমর ও ওবায়দুল্লাহ বিন ওমর ইরাক থেকে পণ্যদ্রব্য কিনে মদিনায় বিক্রি করতেন। ওই সময়ে শুধু খলিফা বা রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরাই নন, সাধারণ মানুষও, এমনকি নারীরাও ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন।
অন্যতম ব্যবসায়িক নারী হিনদা বিনতে উতবা বনু কেলাবের শহরগুলোতে গমন করে পণ্যদ্রব্য বেচাকেনা করতেন। খলিফা হজরত ওমর (রা.) ছাড়াও তাঁর প্রাদেশিক শাসনকর্তারাও ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ওই সব প্রাদেশিক শাসনকর্তার মধ্যে বসরার গভর্নর হযরত আবু মুসা আশাআরি ছিলেন অন্যতম।
হজরত উসমান গনি (রা.) যৌবনের শুরুতেই নিজেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত করেন। সততা, বিশ্বস্ততা, সত্যনিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি অল্প সময়ে বিপুল অর্থ-সম্পদের অধিকারী হন।
তৎকালীন আরবে তাঁর চেয়ে বিত্তশালী ব্যবসায়ী আর কেউ ছিলেন না। হজরত আলী (রা.) হিজরতের পর হজরত ফাতেমা (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহ হলে পৃথক গৃহে বসবাস করতে শুরু করেন এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য কাঠ বিক্রি করতেন। যুদ্ধ অভিযান থেকে প্রাপ্ত গনিমতের অর্থও তাঁর সংসারের খরচে ব্যয় হতো।
উদ্যোক্তা হওয়ার প্রেরণা: ইসলাম মানুষকে উত্পাদনশীল কাজে যুক্ত হয়ে হালাল উপার্জনে উত্সাহ দেয়; তা নিজের জন্য কাজ করাই হোক, অন্য কারো জন্য হোক কিংবা অপরের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেই হোক। তাছাড়া ইসলাম নির্দিষ্ট বেতনের বিনিময়ে অন্যের হয়ে কাজ করাও সমর্থন করে।
হালাল উপার্জনের লক্ষ্যে ইসলাম মানুষকে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রেরণা দেয়। মুসলিমদের নিজ চাহিদা মেটাতে পরিশ্রম ও হালাল উপার্জনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে ইসলাম। এর বাইরে সমাজ ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণেও কাজ করতে বলেছে। নিজের হালাল উপার্জন, অন্যকে এর সুযোগ করে দেয়া এবং কষ্টার্জিত উপার্জনের বিধানের মাধ্যমে ইসলাম মানুষকে কার্যত উদ্যোক্তা হওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। ইসলাম কিছু মানুষের হাতে অন্যকে শোষিত হতে দেয়া কিংবা সামষ্টিক সম্পদ মুষ্টিমেয় মানুষের ভোগে ব্যয় হওয়া যেমন সমর্থন করে না, তেমনি সক্ষম ও সমর্থ মানুষের রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হওয়ারও কোনো সুযোগ দেয় না।
রাষ্ট্রীয় সম্পদ মুসলিম উম্মাহর সম্পদ। তাই সামষ্টিক প্রয়োজন ও সমাজের স্বার্থেই এ সম্পদ ব্যবহার করতে হবে।
বাস্তবধর্মী সামষ্টিক কাঠামো: ইসলাম অর্থনৈতিক ও উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য একটি বাস্তবধর্মী সামষ্টিক কাঠামোর সুযোগ করে দিয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে, নামাজের পরে জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর রহমতের সন্ধান করো। হাদিসে আছে, স্রষ্টা এ পৃথিবীকে আমাদের জন্য উপযোগী করে দিয়েছেন এবং আমাদের এখান থেকে জীবিকা অন্বেষণের চেষ্টা করতে হবে।
জমিনে খাদ্য উত্পাদনের সুযোগ খোঁজা ও অন্যের জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার মধ্যে কঠোর পরিশ্রম ও ব্যবসায়ে উদ্যোগের নির্দেশনা রয়েছে। অন্বেষণের মাধ্যমে মানবজাতির কল্যাণে অজানাকে জানা, নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা ও নতুন সুযোগ খোঁজার কথা বলা হয়েছে। এ অনুসন্ধান চেষ্টায় ঝুঁকি নেয়া ও উদ্ভাবনী চিন্তা আবশ্যক। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, তোমাদের জন্য ব্যবসাকে হালাল করা হয়েছে আর সুদকে হারাম। হাদিসে আছে, সত্ ও বিশ্বাসী ব্যবসায়ীদের হাশর হবে শহীদ, সত্যবাদী ও নবীরাসুলগণের সঙ্গে।
হজরত মুহম্মদ (সা.) এবং তার অনেক সঙ্গীও সত্ ও সফল ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা ছিলেন। মুহম্মদ (সা.) বলেছিলেন, রিজিকের ৯০ শতাংশই আসে ব্যবসায়িক উদ্যোগ থেকে। উমর বিন খাত্তাব (রা.) বলেন, নিজের কষ্টার্জিত উপার্জনের সাহায্যে জীবিকা নির্বাহ করার চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না। এজন্য সামষ্টিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্বার্থে মুসলিমদের একটি অংশকে নিজের ইচ্ছায়ই উদ্যোক্তা হতে হবে।
ব্যবসায়িক নৈতিকতা গুরুত্বপূর্ণ : ইসলাম উদ্যোগ ও সম্পদের ব্যক্তিমালিকানাকে সমর্থন করে। ইসলামে ব্যবসায়িক নৈতিকতা খুব বেশি গুরুত্বপূণ। ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিযোগিতায় সক্ষমতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সততা ও সদ্বিশ্বাসের গুরুত্ব অনেক। এখন অনেক কর্পোরেট মুসলিমরা বলেন, এমন কথা ইসলামে নাই যে অমুসলিমরা বন্ধু হতে পারবেনা। অথচ পবিত্র কোরআনে আছে, হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রীষ্টানদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না।
তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদের (ইহুদি ও খ্রীষ্টানদের) অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ যালিমদের পথ দেখান না। সুরা আল-ইমরান এর ২৮ নং আয়াতে একবারে সকল ধর্মকেই বন্ধুত্বের জন্য বাতিল ঘোষণা করা হয় এই বলে,মুমিনগণ যেন মুমিন ব্যাতিরেকে অন্য কোনো অমুসলিমকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এমন করবে আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবেনা।
সুদ ও ঘষ পরিহার: অনেক ব্যবস্থাপকরা সব কাজ করিয়ে নেন অধ:স্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে। যেন ব্যবস্থাপকের কাজ করে দেয়ায় তাদের বেতন দেয়া হয়। মনে রাখতে হবে ইসলামী শব্দটা কোন ব্যাংক, কিন্ডার গার্ডেন, হাসপাতাল, মার্কেট, কলেজ,আধুনিক প্রকাশনী, লাইব্রেরীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামের সাথে লাগালেই তা ইসলামিক প্রতিষ্ঠান হয়ে যায় না। সুদের ব্যবসা নেক আমল ধ্বংস করে। হারাম সুদকে অনায়াসে গ্রহণ করলে সকল ইবাদত বন্দেগী, দান সাদকা বা আমলসমূহ ধ্বংস হয়।
সুরা বাকারার-২৭৬ আয়াতে আছে, ব্যবসাকে হালাল করা হলো আর সুদকে হারাম করা হলো। কুরআনে এভাবে সাত এর অধিক আয়াত ও চল্লিশটির বেশি সহীহ হাদীসে সুদকে স্পষ্ট হারাম হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হারাম পথে উপার্জিত অর্থ-সম্পদ ভোগ করে ইবাদত-বন্দেগী করলে তা আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে না। কারণ ইবাদত কবুলের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হল হালাল উপার্জন।
হালাল পথে উপার্জন: কিয়ামতের ময়দানে বনু আদমকে পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে এবং এর যথাযথ উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত কোন মানুষ সামান্য পরিমাণ সামনে অগ্রসর হতে পারবে না।
তান্মধ্যে একটি হল সে কোন পথে অর্থ উপার্জন করেছে। অর্থ-সম্পদ হালাল পথে উপার্জন করতে হবে, অন্যথা ক্বিয়ামতের ভয়াবহ দিনে মুক্তির কোন পথ খোলা থাকবে না। আর হালাল পথে অর্থ-সম্পদ উপার্জনের একটি অন্যতম মাধ্যম হল সততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করা। রাসূলুল্লাহ (সা-কে সর্বোত্তম উপার্জন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, নিজ হাতে কাজ করা এবং হালাল পথে ব্যবসা করে যে উপার্জন করা হয় তাই সর্বোত্তম।
অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ: আল্লাহ বলেছেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।
কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ (নিসা ২৯)। আল্লাহ বলেন,যখন ছালাত শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ কর (জুমআ ১০)। ছালাতের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের পরই ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী ক্বিয়ামতের দিন নবী, ছিদ্দীক্ব এবং শহীদগণের সাথে থাকবে।
সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা করা: ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারী ইত্যাদির উপস্থিতি অতীব যরূরী।
আল্লাহ বলেন, আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সূদকে হারাম করেছেন (বাক্বারাহ ২৭৫)কাজেই অন্যায়, যুলুম, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, মুনাফাখোরী, কালোবাজারী, মওজুদদারী ইত্যাদি অবৈধ ও ইসলাম বিরোধী কার্যাবলী পরিহার করে সততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা বলেন, ক্বিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহা অপরাধী হিসাবে উত্থিত হবে। তবে যারা আল্লাহকে ভয় করবে, নেকভাবে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা করবে তারা ব্যতীত’।
মওজুদদারী ও মিথ্যা পরিহার: মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মওজুদ করে রেখে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে মুনাফা লাভের প্রবণতা থেকেও বেঁচে থাকতে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,যে মওজুদদারী করে সে পাপী।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করলে ব্যবসায়ী এবং ক্রেতা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যবসায়ীদেরকে মিথ্যা পরিহার করার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। বিশিষ্ট ছাহাবী ওয়াসিলা ইবনুল আকওয়া (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের কাছে আসতেন এবং বলতেন, হে বণিক দল! তোমরা মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কারবার থেকে অবশ্যই দূরে থাকবে’।
মিথ্যা কসম ও খোটা প্রদান নয়: পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের সময় সকল ব্যবসায়ীকে মিথ্যা কসম বর্জন করতে হবে। কারণ তা ইসলামে নিষিদ্ধ।
আবু কাতাদা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ব্যবসার মধ্যে অধিক কসম খাওয়া হতে বিরত থেকো। এর দ্বারা মাল বেশী বিক্রি হয়, কিন্তু বরকত বিনষ্ট হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তিন শ্রেণীর লোকের সাথে আল্লাহ কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না ও তাদের প্রতি দৃষ্টি দিবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আবূ যার বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কারা নিরাশ ও ক্ষতিগ্রস্ত? তিনি বললেন, টাখনুর নীচে কাপড় পরিধানকারী, উপকার করে খোটা প্রদানকারী এবং ঐ ব্যবসায়ী যে মিথ্যা শপথ করে তার পণ্য বিক্রি করে।
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, জনৈক বেদুঈন একটি ছাগী নিয়ে যাচ্ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি ছাগীটি তিন দিরহামে বিক্রি করবে? লোকটি বলল, আল্লাহ কসম! বিক্রি করব না। কিন্তু সে পরে সেই মূল্যেই ছাগীটি বিক্রি করে দিল। আমি এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহর (ছাঃ)-এর কাছে এসে উল্লে¬খ করলাম। তিনি আমার কথাগুলো শুনে বললেন, লোকটি দুনিয়ার বিনিময়ে তার পরকালকে বিক্রি করে দিয়েছে।
দ্রব্যের দোষ-ত্রুটি ক্রেতার সম্মুখে প্রকাশ: রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পণ্যে ভেজাল দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিতে নিষেধ করেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদা নবী করীম (সা কোন এক খাদ্যস্তূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্যস্তূপে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে দেখলেন তার হাত ভিজে গেছে। তিনি বললেন, হে খাদ্যের মালিক! ব্যাপার কি? উত্তরে খাদ্যের মালিক বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা! বৃষ্টিতে উহা ভিজে গেছে। রাসূলুল্লাহ (সা তাকে বললেন, তাহলে ভেজা অংশটা শস্যের উপরে রাখলে না কেন? যাতে ক্রেতারা তা দেখে ক্রয় করতে পারে।
নিশ্চয়ই যে প্রতারণা করে সে আমার উম্মত নয়। রাসূলুল্ল¬াহ (ছাঃ) আরো বলেন, ক্রেতা বিক্রেতা যতক্ষণ বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়, ততক্ষণ তাদের চুক্তি ভঙ্গ করার ঐচ্ছিকতা থাকবে। যদি তারা উভয়েই সততা অবলম্বন করে ও পণ্যের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে, তাহলে তাদের পারস্পরিক এ ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং পণ্যের দোষ গোপন করে তাহলে তাদের এ ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত শেষ হয়ে যাবে।
ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা নয়: প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমরা ক্রেতাকে ধোঁকা দেওয়ার লক্ষ্যে ক্রেতার মূল্যের উপর মূল্য বৃদ্ধি করে ক্রেতাকে ধোঁকা দিয়ো না। ধোঁকাবাজি ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। হাসান বিন ছালিহ একটি ক্রীতদাসী বিক্রয় করলেন। ক্রেতাকে বললেন, মেয়েটি একবার থুথুর সাথে রক্ত ফেলেছিল। তা ছিল মাত্র একবারের ঘটনা।
কিন্তু তা সত্ত্বেও তার ঈমানী হৃদয় তা উল্লে¬খ না করে চুপ থাকতে পারল না, যদিও তাতে মূল্য কম হওয়ার আশংকা ছিল। সুতরাং ক্রেতা বিক্রেতা উভয়কে ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
ওযনে কম দেয়া যাবেনা: ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নেওয়ার সময় বেশী নেওয়া এবং দেওয়ার সময় কম দেওয়া মারাত্মক অপরাধ। আল্লাহ বলেন,যারা ওযনে কম দেয় তাদের জন্য ধ্বংস। তারা যখন লোকদের কাছ থেকে কিছু মেপে নেয়, তখন পুরাপুরি নেয়।
আর যখন তাদের মেপে বা ওযন করে দেয় তখন কম করে দেয়। তারা কি ভেবে দেখে না যে, তারা সেই কঠিন দিনে পুনরুত্থিত হবে, যেদিন সকল মানুষ স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে দন্ডায়মান হবে (মুতাফ্ফিফীন ১-৫)। আল্লাহ আরো বলেন, তোমরা ন্যায্য ওযন কায়েম কর এবং ওযনে কম দিয়ো না (আর-রহমান ৯)। ওযনে কম-বেশী করা গুরুতর অপরাধ। এতে এক শ্রেণীর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আর এক শ্রেণীর মানুষ সাময়িকভাবে লাভবান হয়, যা ইসলামে কাম্য নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।