আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।
“ লাকড়িগুলা টোকাইয়া আনতে কইছিলাম তরে , কান দিয়া কথা বাইর কইরা দিয়া কিচ্ছু আনলিনা । কই নবাবের বেডি খালি বইয়া বইয়া প্যাডে ভাত জুটাইবি আর এত্তো এত্তো কইরা হাগবি ? বুড়া হইতাছোস আক্কল যদি হইছে । “ আত্নজার উপরে গজগজ করতে করতে শেফালী নিজেই লাকড়িগুলো আনতে যায় ।
যার উদ্দেশ্যে উপরের খিস্তি – খেউড়গুলো করা সেগুলো শুনে যে কেউ মনে করতেই পারে তার বয়স অন্ততপক্ষে যা হয়েছে নিঃসন্দেহে সেই গালি সহ্য করনেওয়ালাকে যুবতী বলা যায় ।
কিন্তু বছর চৌদ্দোর আকলিমাকে তার উপর ধেয়ে আসা কদর্য বাক্যবাণের কিছুই স্পর্শ করলোনা । সে নিজের মনে চক দিয়ে তৈরী করা বৃত্তের উপর দিব্যি চক্রাকারে ঘুরতে লাগলো । নিজের আবিষ্কার করা এই খেলা তার বড্ড মনে ধরেছে দিন বিশেক হলো । ক্ষুধা থেকে শুরু করে অনেক মানসিক যাতনাই ভুলে থাকতে পারে । সেখানে জননীর হতাশামিশ্রিত গালাগাল হজম করা কোন বিষয়ই না তার কাছে ।
হ্যা মাত্র বছর চৌদ্দই বটে আকলিমার । যা গালাগাল সহ্য করে তার সবই মলমূত্রের মধ্যে বেড়ে উঠা পরিবারে জন্মেছে বলে করে । এ এক ভারি মজার খেলা । আকলিমাদের সম্বল করেই দেশ , জাতি , সংসার , সমাজ ইত্যাদি নিয়ে চাপাবাজি চলে । বিদেশ থেকে মোটা মোটা ফান্ড আসে ।
সেমিনার – সিম্পোজিয়াম হয় । বিভিন্ন এনজিও মলমের দোকান খোলা হয় । নগরীতে আনন্দ-উৎসব সহকারে বাচনিক বেশ্যাবৃত্তি চলে । শীতকাল আসলে পীঠা নিয়ে রসের আলাপ শুরু হয় । গ্রামবাংলার সৌন্দর্য নিয়ে মাখোমাখো সাহিত্য রচনার প্রতিযোগীতার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় ।
অধ্যাপক থেকে শুরু করে অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল , আমলা প্রত্যেকেই গালে হাত দেওয়া ভাবুক ছবি পত্রিকায় পাঠিয়ে দেয় । এলিট নাগরিকেরা নিজেদের মধে বলাবলি করে “ দেখেছিস দেশের প্রতি কেমন ডেডিকেটেড একজন মানুষ ? ছবিটা থেকেই ইন্টেলিজেন্স , ইন্টেগ্রিটি একেবারে ফুটে বেরুচ্ছে । “
এই বর্ণনা আরো দীর্ঘায়িত করা যেতো । কিন্তু এখানেই থামিয়ে দিয়ে বিপর্যস্ত জীবনের ধাক্কায় পর্যুদস্ত শেফালীর দিকে মনোযোগ দেওয়া যাক । নিজেই লাকড়িগুলো কুড়িয়ে এনে রেখে তার মনে হলো একটু জিরিয়ে নেওয়া দরকার ।
সমগ্র শরীর ইতোমধ্যেই ঘর্মাক্ত । হাতের চেটো দিয়ে কেবল কপালের ঘামটুকু মুছতে পারলো । এদিকে চারিদিকের তীব্র গরমের উত্তপ্ত যেই ভাপ সেটা শেফালীকে তৃষ্ণার্ত করে তুললো । অন্যদিকে বসে বসে একটু জিরাচ্ছে বলে পানি খাবার জন্য উঠতেও ইচ্ছা করছেনা । কিছু দূরে ছোট কিন্তু ছিমছাম ঘরের মধ্যে নিত্য – নৈমিত্তিকভাবে তার অসুস্থ স্বামী কাশেম কোঁ কোঁ করছে ।
এখন আর এসব ভালো লাগেনা । নেহায়েত পঙ্গু বলে কষে গাল দেবে সেই ইচ্ছাটাও হয়না । নিজের ভাগ্যের প্রতি অভিশম্পাত করবে সেই ইচ্ছাটাও ক্রমশ গ্রামের নদীগুলোর মতোই শুকিয়ে আসছে । শেফালীর পাগল পাগল লাগে ইদানিং । শৈশবে গ্রামে এক হাসু পাগলাকে দেখেছিলো মনে পড়ে ।
আশেপাশে মানুষজন দেখলেই খেঁকিয়ে উঠে বিড়বিড় করে কি কি যেন বলতো । তারা গ্রামের কেউই সেসব কথাবার্তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতোনা ।
কনামাত্র বুঝতে পারেনা এমন কথাবার্তাকে বড্ড ভয় পায় শেফালী । এটা শুরু হয়েছে ছেলে বুটলা মরে যাওয়ার পর থেকে । তার এক বছর আগের থেকে হঠাৎ জোয়ান ছেলের মধ্যে কি পরিবর্তন চলে আসলো বুঝতে পারেনি ।
মাঝেমাঝেই ছেলে কি সব ইংরিজি শব্দ আওড়াতো আর মাকে পিড়িতে বসে বসে বোঝানোর চেষ্টা করতো । স্টেট , সোসাইটি , পোভার্টি , প্রোলিতারিয়েত , বুর্জোয়া , প্রাইভেট প্রোপার্টি , পাবলিক প্রোপার্টি এইসব বিদ্ঘুটে সব শব্দ যার ধারেকাছে তাদের চৌদ্দপুরুষের কেউ কখনো যায়নি । শেফালী নিজের মাতৃস্নেহ দিয়ে বুঝতো ছেলে তার বিপদে পড়তে যাচ্ছে । সেই ভবিষ্যতবাণী মাস চারেকের মধ্যেই খাপে খাপ মিলে গেলো । গ্রামের রুইপ্যা বিলের পাশে গুলিতে বুক , পেট ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার ছেলের লাশ দেখে নিজেকেই অভিশম্পাত করেছিলো ।
কেন সে মুখ বন্ধ করেছিলো ? কেন ছেলেকে নিজের আশঙ্কার কথা এতোদিন ধরে বলেনি ? তার এতো বড় জোয়ান ছেলে কথা নাই বার্তা নাই দুম করে মরে পড়ে থাকলো একদিন আর সে চুপচাপ তামাশা দেখে গেলো । এই ঘটনারই আট মাস পর ......... সেই স্মৃতি মনে হলেই এই তীব্র গরমে মুখটা কষা হয়ে আসে শেফালীর । অন্যদিকে মনটা ঘুরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে প্রাণপণে । দেখতে চেষ্টা করে কিভাবে নাওয়া-খাওয়া সব নিমেষে ভুলে গিয়ে ছোট মেয়ে আকলিমা নিজের মনে একই বৃত্তে বারবার ঘুরে ঘুরে একটু থেমে আবারো ঘুরতে শুরু করলো । এখনো তার আবার ছোট মেয়ে কি ? ধুর বাল , আবারো সেই একই কেচ্ছার কথা মনে চলে আসে ।
ক্রমশ চারপাশের ভাপ বাড়তে থাকে । আকলিমা তার ছোট্ট শরীরে একসময় আর বৃত্তাকারে ঘুরতে পারেনা । সে জিরাতে শুরু করে । শেফালী নিস্পলক কিন্তু উদাস দৃষ্টিতে সব দেখে । গ্রামের ইয়াসিন মৌলবীকে তাদের দিকে আসতে দেখে ঘেমো শরীরেই মাথায় কাপড় দেয় ।
কি কারণে মৌলবী সাহেবের শেফালীর কাছে আসা সে বুঝে করে উঠতে পারেনা । নিরাসক্ত মনেই শেফালী উঠে দাঁড়ায় । বলা ভালো তাকে উঠে দাঁড়াতে হয় ।
“ শেফালী খোঁজ – খবর কিছু রাখছোনি দ্যাশের ? “ মৌলবী ইয়াসিন নরম সুরে বলে উঠে । লোকটাকে শেফালীর পছন্দ ।
একেবারে সদালাপী ভদ্রমানুষ । প্রায়ই মানুষজনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবার খোঁজ়খবর নেয় । কিন্তু এসেই দেশের কথাবার্তা জিজ্ঞেস করার অর্থ খুঁজে পায়না । সে প্রশ্নটায় বিস্ময় সামলেই উত্তরে না বলে । তার কি ঠেকা পড়ছে দেশের খবর রাখবে ?
“ মানে ট্যামরা বাজারের খোঁজ কিছু শোনোনাই ? “ অত্যন্ত নিচুস্বরে মৌলবী প্রশ্ন করে ।
জায়গাটার নাম শুনেই চোখ-মুখ শক্ত হয়ে যায় শেফালীর । অন্য কেউ হলে এই প্রশ্ন শুনে ঝাঁঝালো ভাষায় কথা বলতে দ্বিতীয়বার ভাবতোনা । তবে মৌলবী সাহেবের সাথে রুঢ় ভঙ্গিতে কথা বলা যায়না । ভালো মানুষ লোকটা । মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর জানিয়ে দেয় ।
“ আইজ দুপুরে ট্যামরা বাজার পুড়াইয়া দিছে গা সেই গ্যারামের হুজুরেরা । অনেকেই পুইড়া গেছে গা , তুমি খোঁজখবর লইতে পারো । “
শেফালী শান্তমুখে মৌলবীর সব কথা শোনে । শুনে কোন জবাব দেয়না । মৌলবী ইয়াসিন উঠান থেকে ধীর পায়ে চলে যেতে যেতে অদৃশ্য হয়ে গেলে শেফালী কিছুই হয়নি এমন ভাব করে ঘরে ঢোকে ।
তার অসুস্থ স্বামীর কোঁ কোঁ ততক্ষণে থেমে গেছে । কিছুক্ষণ পর একটা ছোট্ট কাপড়ের পুটলা ধরে শেফালীর তীক্ষ্ণ স্বরের কান্না শুরু হলে তা শুনতে পেয়ে বিস্মিত হয় আকলিমা । মাকে এভাবে কাঁদতে দেখেছে বলে মনে করতে পারেনা । খুব সম্ভবত সেই কারণেই এই তীক্ষ্ণ শব্দের কান্নার উৎস জানতে ইচ্ছা করে তার । কিন্তু তার বেশ্যা বড় বোন আগুনে পুড়ে যাবার ভিকটিম বনে গেছে এই কথা তাকে বলার কেউ নেই ।
বলার অর্থও হয়না ।
এদিকে অসুস্থ কাশেম স্ত্রীর ক্রমবর্ধমান কান্নার শব্দ শুনে আঁচ করতে পারে তার উৎস কোথায় । তার কিছু মুহূর্ত পরে মাগরীবের আজানের ধ্বনির সাথে শেফালীর কান্নার শব্দ মিলেমিশে এক অভিশপ্ত পরিবেশের সঙ্গীত শোনাতে থাকে । আজানের ধ্বনি ক্রমশ স্তিমিত হতে থাকে , শেফালীর কান্নার শব্দ ক্রমশ বাড়তে থাকে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।