প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জানতেন, আওয়ামী লীগ একবার ক্ষমতায় গেলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের আর শোষণ করতে পারবে না। তাই কোন অবস্থাতেই যাতে বাঙালিপন্থী কোন দল যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে সে ব্যাপারে তিনি সতর্ক রইলেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষায় হাত মেলালেন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে। ভুট্টোর প্ররোচনায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করে দিলেন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান।
কিন্তু এরপর? এরপর কিভাবে বাঙালিদের ক্ষমতা বঞ্চিত রাখবেন তিনি?
পাকিস্তান পিপলস পার্টিসহ আরও কয়েকটি পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক দল এগিয়ে এল স্বপ্রণোদিতভাবে।
তারা মার্চে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানালেন।
আরেকটি অজুহাত পেলেন ইয়াহিয়া খান।
১ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলেন তিনি।
ইয়াহিয়া খানের এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করল বাঙালিরা।
১৯৭০ এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ থেকে টানা ৫ দিনের হরতাল শেষে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার ঘোষণা করলেন।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ৬ মার্চ পর্যন্ত হরতাল পালিত হল পূর্ব বাংলায়।
টানা হরতাল শেষে নতুন সূর্য উদয়ের সাথে সাথে বাংলায় শুরু হলো নতুন দিন।
৭ মার্চ।
সকাল থেকেই মানুষের মিছিল শুরু হলো রেসকোর্স অভিমুখে। দুপুরের মধ্যে রেসকোর্স পরিনত হলো জনসমুদ্রে।
চারিদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। সকলের মধ্যেই ‘বাঁধা দিলে বাঁধবে লড়াই’ মনোভাব। মুখে তাঁদের গগনবিদারী স্লোগান। থেকে থেকেই আওয়াজ উঠছে ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, ‘ইয়াহিয়ার ঘোষনা, মানিনা মানবো না’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’।
দূর দূরান্ত থেকে সভায় যোগ দিতে এসেছেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।
ঝাড়ু হাতে অসংখ্য মহিলা এসেছেন। বহু লোক এসেছেন বিভিন্ন রকম ব্যানার, বাঁশের লাঠি, তীর-ধনুক হাতে নিয়ে। একটা যুদ্ধের জন্য যেন প্রস্তুত সকলে। হঠাৎ একটা বিমান উড়ে গেল সভাস্থলের বেশ ওপর দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে উঠল জনতা।
বিমানটিতে শত্রু সৈন্য আছে ভেবে সজোরে ঢিল ছুঁড়ে দিল কেউ। কেউ হাতের লাঠি নিক্ষেপ করল ওপরে।
সভাস্থলে উপস্থিত অনেকের হাতে বাংলাদেশের সোনালি মানচিত্রখচিত লাল-সবুজ পতাকা। ছোট আকারের সেই পতাকা নাড়ছেন তাঁরা সগৌরবে। বিশাল আকারের একটি পতাকা শোভা পাচ্ছে বক্তৃতামঞ্চের সামনে।
সেখানে দাঁড়িয়েই ভাষণ দেবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বিকেল তিনটায় ভাষণ দেবার কথা থাকলেও পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর বঙ্গবন্ধু মঞ্চে এলেন। পরনে তাঁর ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, কালো মুজিবকোট। হাতে পাইপ, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। ধীরে ধীরে তিনি এসে দাঁড়ালেন নির্ধারিত স্থানে।
তাঁকে দেখেই তীব্র জোয়ারে উত্তাল হয়ে উঠল জনসমুদ্র। লক্ষ জনতার উল্লাসধ্বনিতে কান পাতা দায় হলো। তিনি হাত নেড়ে মানুষের আবেগের জবাব দিলেন। শান্ত ভঙ্গীতে চশমাটা খুললেন। রাখলেন ডায়াসের ঢালু অংশে।
তারপর স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীরকণ্ঠে শুরু করলেন এক ঐতিহাসিক বক্তৃতা। শুধুই কি বক্তৃতা সেটি? না, উনিশ মিনিট দীর্ঘ এক কবিতা পড়লেন যেন! তিনি আবেগতাড়িত স্বরে বললেন,
“আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি- আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর ও যশোরের রাজপথ আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়- তারা বাঁচতে চায়।
তারা অধিকার পেতে চায়। ...”
“...ভাইয়েরা, আমার ওপর বিশ্বাস আছে? আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাইনা, মানুষের অধিকার চাই। ... আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত। আমি বলে দেবার চাই, আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট, অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।
কোন কর্মচারী অফিস যাবেন না। এ আমার নির্দেশ। ...”
“...যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা তাদের ভাতে মারবো- পানিতে মারবো।
আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, আমার সহকর্মীরা না থাকে, আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। ...”
“...গুলি চালালে আর ভাল হবে না, সাতকোটি মানুষকে আর দাবায়া রাখতে পারবা না। বাঙালী মরতে শিখেছে, তাদের কেউ দাবাতে পারবে না...”
“...আমার অনুরোধ প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায় ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো।
এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। ”।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।