যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলের বিরুদ্ধে তিনজন অন্ধকে হত্যা করে বনভূমি দখল ও হান্টার ক্রাউন সেবন করিয়ে যুবসমাজকে বিপথগামী করার অভিযোগে তদন্ত চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, তদন্ত শেষে মদের লাইসেন্স বাতিল হতে পারে।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অন্ধ সংস্থা গাজীপুর জেলা শাখার দায়ের করা অভিযোগ তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) সেবাস্টিন রেমা ওই তদন্ত করেন। অভিযোগকারীদের বক্তব্য শুনে তিনি ন্যায়বিচারের আশ্বাস দেন।
তদন্ত কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দি প্রদানকারী জাতীয় অন্ধ সংস্থার গাজীপুর জেলার সভাপতি জয়নাল আবেদীন ও সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান ওই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন।
অভিযোগকারী ওই দুই অন্ধনেতা বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা তাদের বক্তব্য শুনেছেন। এ সময় তদন্ত কর্মকর্তা মানবিক কারণে তাদের দুপুরে ভাত খাওয়ার টাকা দিয়েছেন।
একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, তিন অন্ধকে হত্যা করে অন্ধেরটেককে মদেরটেক বানানোর লোমহর্ষক কাহিনী অন্ধনেতাদের কাছ থেকে মনোযোগ সহকারে শোনেন তদন্ত কর্মকর্তা। বক্তব্য গ্রহণকালে তদন্ত কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সহকারী ভূমি কমিশনারের সঙ্গেও কথা বলেছেন।
সূত্র জানায়, অন্ধেরটেকে হান্টার ও ক্রাউন উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণের মাধ্যমে যুব সমাজ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালক গাজীপুর সার্কেলকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেন।
সূত্র আরো জানায়, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দায়ের করা দুটি মামলার মধ্যে একটি বিচারাধীন রয়েছে। ওই মামলায় সাক্ষ্য প্রমাণ সম্পন্ন হয়েছে। অপর একটি মামলা স্থগিত রয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর গাজীপুর সার্কেলের পরিদর্শক দেওয়ান মো. জিল্লুর রহমান বলেছেন, পত্রিকার রিপোর্ট তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সত্যতা পেলে বিয়ারের লাইসেন্স বাতিল হতে পারে।
বাবুলের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:
যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলের বিরুদ্ধে গাজীপুরে সরকারি বনভূমি জবর দখল করে মদের কারখানা তৈরি করতে গিয়ে ৩ জন অন্ধকে হত্যা ও শ্রমিক আন্দোলন ঠেকাতে ২ জন শ্রমিককে হত্যাসহ ৫টি খুনের অভিযোগ নিয়ে মোট ৯টি অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরে সফিপুরে সরকারি বনভূমি জবরদখল করে মদের কারখানা তৈরি করার সময় ৪টি মামলা হয়। বনবিভাগ ২টি ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ২টি মামলা করে। এ সময় বনের জায়গায় বসবাসরত ৪০টি অন্ধ পরিবারকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে ৩ জন অন্ধকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একটি ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নিকট লিখিত অপর একটি অভিযোগের মাধ্যমে ৩জন অন্ধকে হত্যার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করা হয়।
জাতীয় অন্ধ সংস্থার ওই দুটি অভিযোগে বলা হয়, গাজীপুর জেলার সফিপুরে ৪০টি অন্ধ পরিবার বনবিভাগের সরকারি জমিতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করতেন। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৩ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুল তার গুন্ডা বাহিনী দিয়ে অন্ধেরটেক থেকে ৪০টি অন্ধ পরিবার উচ্ছেদ করে মদের কারখানা তৈরি করেন। উচ্ছেদের পর অন্ধরা পুনরায় অন্ধেরটেকের গেটে আসলে বাবুলের ক্যাডার বাহিনী অন্ধদের বেধড়ক পিটিয়ে এলাকাছাড়া করে। এক পর্যায়ে অন্ধদের সংগঠিত করে আন্দোলন-চেষ্টার অভিযোগে অন্ধদের নেতা আব্দুল বারেক ও মো. সেলিমকে মারপিট করে বিষাক্ত নেশা জাতীয় মাদকদ্রব্য খাইয়ে জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে তাদের লাশ উদ্ধার ও দাফন হয়।
প্রায় একই সময় পালিয়ে থাকা আরেক অন্ধনেতা সাফাজ উদ্দিনকে টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় রাস্তার পাশে ভিক্ষা করার সময় বাবুল নিজে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া ১৯৯০ সালে গাজীপুরের ভোগড়ায় শ্রমিক আন্দোলন ঠেকাতে নুরুল ইসলাম বাবুল ফিল্মি স্টাইলে ২জন শ্রমিককে হত্যা করেন। ঘটনার প্রতিবাদ করার প্রায় শতাধিক শ্রমিক ও ২০/২৫ জন শ্রমিক নেতাকে মারধর করে অসংখ্য মিথ্যা মামলায় জেল খাটান বাবুল। ভয়ে দুই শ্রমিক হত্যার ব্যাপারে মামলা করার সাহস পায়নি তাদের পরিবার। অবশ্য তারা বলছেন, ‘হত্যা মামলা হয়েছিল, বাবুল শেষ করে ফেলেছেন বলে আমাদেরকে জানানো হয়েছে।
বাবুলের ভয়ে ও টাকার অভাবে আমরা মামলার খোঁজ নিতে পারি নাই। ’
অনুন্ধানে জানা যায়, ১৯৯০ সালে যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুল ফিল্মি কায়দায় দুই হাত উপরে বেঁধে তিন দিন নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করেন ওই দুই শ্রমিককে। নিহতদের মধ্যে আমির হোসেন রোজা রেখেছিলেন। রোজা মুখে নিয়ে খুন হন তিনি। এই ঘটনায় আহত ও বাবুলের পক্ষে দায়ের করা ১৩ মামলায় কারা নির্যাতিত শ্রমিক সামসুল হক বর্ণনা দিয়েছেন লোমহর্ষক কাহিনী।
গাজীপুর মহানগরের ভোগড়া এলাকায় একটি মাটির ঘরে বসবাস করছেন যমুনা গ্রুপের সাবেক শ্রমিক সামসুল হক(৫৫)। নব্বই দশকে যমুনা ফ্যান, যমুনা সুইচ, যমুনা ক্যাবল, যমুনা সার্কিট আর যমুনা ওয়েলডিং রড প্রস্তুত কারখানাগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত হয়েছিলো যমুনা শ্রমিক ইউনিয়ন। যমুনা গ্রুপে কর্মরত দুই হাজার শ্রমিকের সংগঠনটির সহ-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সামসুল হক। সভাপতি ছিলেন আবু সাইদ। কোষাধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন আব্দুস সামাদ।
সামসুল হক বলেন, ১৯৯০ সালে পহেলা রমজান। যমুনা গ্রুপের শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়নের দাবিতে সকাল থেকেই আন্দোলন করছিলেন। সংগঠনের নেতা হিসেবে তিনিও ছিলেন শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বে। আন্দোলন চলাকালে দুপুরের দিকে হঠাৎ করে নুরুল ইসলাম বাবুল শ্রমিকদের লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলি বর্ষণ করেন। বাবুলের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ লাঠিচার্জ করে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে।
এ সময় বাবুলের গুলিতে নিহত হয় শ্রমিক আমির হোসেন ও আহত হয় প্রায় শতাধিক শ্রমিক। এই ঘটনায় ভোগড়া এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়। রক্তাক্ত শ্রমিকদের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যায় এলাকাবাসী। আমির হোসেন মারা যায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে আমির হোসেনের লাশ দেখতে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার(সাবেক এমপি), আ ক ম মোজাম্মেল হক(বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী), হাসানুল হক ইনু(বর্তমান তথ্যমন্ত্রী), রাশেদ খান মেনন (বর্তমান এমপি), কমরেড ওসমান আলী, নুরুল আম্বিয়া সহ অনেক নেতা।
নুরুল ইসলাম বাবুলের নির্যাতনে আহত ও ১৩ মামলায় কারাভোগকারী শ্রমিকনেতা সামসুল হক বলেন, এর আগে নুরুল ইসলাম বাবুল শ্রমিক আবুল খায়েরকে তিন দিন ধরে পিটিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করেন। ভোগড়া এলাকায় অসংখ্য মানুষ বলেছেন, দু’হাত উপরে ও পায়ের নিচে গোড়ালিতে বেঁধে ফাঁসির মঞ্চের মত করে ঝুলিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করা হয় খায়েরকে। মঞ্চের মাঝে বাঁধা অবস্থায় কয়েকগজ দূর থেকে ফুটবলের মত কিছুক্ষণ পর পর দৌড় দিয়ে লাথি মেরে মেরে বাবুল খায়েরের মৃত্যু নিশ্চিত করেন। ভোগড়া এলাকার শত শত মানুষ অসহায়ের মত বাবুলের পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ্ করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন হাজী বলেন, নুরুল ইসলাম বাবুলের ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ড আজো ভোগড়ার মানুষকে চরম আতঙ্কের মধ্যে রেখেছে।
এখনো যমুনা গ্রুপের কারখানার সামনে দিয়ে চলাফেরা করার সময় ভোগড়াবাসীর গা ছমছম করে। মনে পড়ে যায় সেই পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।