আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চাষা দের দেশ !!!

প্রায় দিনমজুর ছিলেন সোবহান (ছদ্ম নাম) এর বাবা , অনেক কষ্টে, চেয়ে চিনতে ৫ সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতেন , কখনও দুই বেলা কখনও এক বেলা । ভাঙ্গা ঘরের ফাঁক দিয়ে ঢুকত হাড় কাপানো হিম । তেল চিটচিটে কাঁথা আর তক্তার বিছানা ভাগাভাগি করতো সাত সদস্য । লিখা পড়ায় খুব ভালো মাথা ছিলো সোবহান এর ............... কি প্রক্রিয়ায় সোবহান পড়েছে সেইটা আরেক গল্প । বেশ ভাল রেজাল্ট করে যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হলো তখন বাবা প্রায় সর্বস্বান্ত , মা চিরোরুগি ।

ছোট ভাই বোন গুলো নিজেরাই একেকটা মানবিক গল্পের লব-কুশ । বিসিএস পরিক্ষায় খুব আকর্ষণীয় ক্যাডার পেলো সোবহান । চাকরীর প্রথম মাসে বেতন দিয়ে পরিবারের সবার জন্য কিছু না কিছু কিনে পাঠাল । হাসি আনন্দের চোরাস্রোত .........(আসুন আমরাও খুশী হই) চাকরীর ২য় মাসে একটা টেলিফোন , তার অ্যাকাউন্ট নং জানতে চাইছে তার হেড অফিস থেকে । সোবহান এর কোন অ্যাকাউন্ট তো নাই কোন ব্যাংক এ ! ধমক শোনা গেলো অপর প্রান্তে , আজকেই অ্যাকাউন্ট খুলে জানাতে নির্দেশ দেয়া হলো ।

পিয়ন তার চেয়ে অনেক বয়স্ক , পিয়ন খুব খুশি নতুন অফিসার এর ভদ্র আচরনে ...(আমরাও আনন্দিত) চাচা , আমাকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে , পিয়ন হাসি মুখে বলল স্যার , আপনার অ্যাকাউন্ট সরকারি ব্যাংক এ খোলার দরকার নাই , চলেন আমি আপনাকে নিয়ে যাই । একটা বেসরকারি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে জানিয়ে দিলো সোবহান । ওপারের সেই 'ধমক' বললেন ১ ঘন্টা পর আবার ব্যাংক এ গিয়ে খোঁজ নিতে । ১ ঘন্টা পর ব্যাংক এ আবার , অ্যাকাউন্ট নং বলল এক অফিসার কে । সামনের কম্পিউটার দেখে ব্যাংক অফিসার বললেন জী , স্যার আপনার টাকা এসেছে ।

অবাক...... কে পাঠাল টাকা ! অফিসার বললেন স্যার , আপনার ব্যাল্যান্স এখন ২৮লাখ ৫০০। আপনি কি টাকা উঠাবেন ? আকাশ থেকে.........নাকি হিমালয় থেকে পড়লো সোবহান !!! কে পাঠাল এতো টাকা ! সোবহান অফিসে বসে সারাদিন আকাশ পাথাল ভেবেও কুল পায়না , এই দুনিয়াতে তার এমন কোন আত্মীয় বা আপন কেও নাই যে এত টাকা তাকে দিবে , তার আত্মীয়রা তো নিজেরাই ঠিক মত খেতে পায় না, সে যদি ভাল করে লক্ষ্য করতো তাইলে দেখতে পেতো যে তার পিয়ন মাঝে মাঝে মুখ টিপে হাসছে ...। এক দুই করে সপ্তাহ পার হল, পরের রবিবার অফিস গিয়ে সে সেই নম্বর এ ফোন করলো ,সোবহান নিশ্চিত এই টাকার পিছনে 'ধমক' এর হাত আছে । ফোন ধরলেন 'ধমক', আত্মবিশ্বাস ইতিমধ্যেই শূন্য , কোনমতে সালাম দিয়ে পরিচয় দিতেই ওপার থেকে তেমনি কড়া কণ্ঠ , টাকা পাইছেন ? জী , কিন্তু এইটা কিসের টাকা , ঢোক গিলে বলল সোবহান । এইবার ওপারের গলা হো হো করে হাসতে লাগলো , আপনি এক মাসের অংশ পেয়েছেন স্যার , এইরকম প্রতি মাসেই আপনার অংশ আপনার অ্যাকাউন্ট এ পৌঁছে যাবে , আপনি কয়েকটা ব্যাংক এ অ্যাকাউন্ট খুলে সব নম্বর গুলো আমারে দিয়া দিবেন ।

এক ব্যাংক এ বেশি টাকা রাখা যাবেনা , চাঁদাবাজদের নজর লাগতে পারে । কিসের অংশ জিজ্ঞাসা করতেই ওপারের হাসির ভলিউম বেড়ে যায় , আস্তে আস্তে সব জানবেন স্যার , আপনি যে সব ফাইল এ সই করছেন সেগুলোর প্রত্যেকটা একেকটা সোনার ডিম পাড়া হাঁস , শালারা এক জিনিস ডিক্লেয়ার দিয়ে আরেক জিনিস আমদানি করে দেশের বারোটা বাজায় আর তার ভাগ আমরা সবাই পাই । এই চাকরীর এইটাই মজা , দেশের ক্ষতি যারা করে আপনি তাদের সাইজ করছেন, এই অর্থে আমরা দেশের কাজ করছি, দেশপ্রেমিক । দেশপ্রেমিক এর এরকম সংজ্ঞা উদ্ভট মনে হলেও সোবহান ভাবছে মাসে মাসে এত্ত টাকা পাবো , আমি তো তাইলে বিরাট কিছু ! ওপারের স্যার সম্বোধন তাকে তার হারানো আত্মবিশ্বাস কিছুটা ফিরিয়ে দেয় , জিজ্ঞাসা করে আপনি কে ? ওপারের কণ্ঠ একটু নিচু গলায় বলে স্যার আমি হেড অফিসের ক্লার্ক , সারা দেশের সব স্যার দের টাকা ভাগ করে দেওয়ার দায়িত্ব আমার , সেই হিসেবে আমি ক্যাশিয়ার ও বলতে পারেন । আপনি স্যার আবার কোন সন্দেহ করবেন না যেন , সব স্যার রাই আমাকে খুব ভালো করে জানেন , আমি কাওকে ঠকাই না ।

আপনি স্যার আপনার পিয়ন ময়েজ মিয়া কে জিজ্ঞেস করলে বিস্তারিত জানতে পারবেন , ওরাও কিন্তু ভাগ পায় , দেখবেন পিয়ন ময়েজ বাড়ি গিয়া ওর শান শওকত । .................. ময়েজ মিয়া আস্তে আস্তে সব বলতে থাকে ............... ১ বছরের মাথায় আমাদের চেনা সোবহানের অনেক পরিবর্তন , সব চাইতে যে পরিবর্তন সবাই দেখতে পায় তা হল আগে সোবহানের কথার মাঝে কুণ্ঠা বোঝা যেতো , এখন সে উঁচু গলায় টেনে টেনে একরকম বাচন ভঙ্গিতে কথা বলে যা যে কেও বাজারে গেলে শুনতে পাবেন । সব চাইতে বড় মাছের বিক্রেতা যাকে সব চাইতে খাতির করছে ............ কান পাতলে শুনবেন সেই ক্রেতা একইরকম টেনে টেনে কথা বলছে , বাপ বয়সি বিক্রেতাকে তুই -তোকারি করছে । সোবহানের দিন মজুর বাবার ভাঙ্গা বেড়া দালান হতে সময় লাগে না , মা যেন চিনতে পারেন না আপন সন্তানকে , আধুনিক, সুন্দরী ও শিক্ষিতা মেয়ে কে বিয়ে করে । সোবহানের ডুপ্লেক্স এ পা ফাটা বাবা , চিরো রুগি মা বেমানান , ভাই - বোনদের পরিচয় দিতে লজ্জা পায় সোবহান ও তার বউ ।

সোবহানের ছেলে মেয়েকে দেখলে মনে হয় দেবশিশু । শিশু দুটি দাদা, দাদী , চাচা , ফুফু চেনার সুযোগ পায়না , আত্মীয় বলতে মা'র পক্ষের সবাইকে আপন জানে । এর মাঝে কয়েক বছর পার হয় , সোবহানের বউ কয়েক দিন থেকে বলছে , এই দেশে মানুষ থাকতে পারে না , সব অমানুষ , চাষা এখানে থাকলে তার সন্তানরাও চাষা হয়ে থাকবে , সুতরাং Second Home চায় তাদের । বিষয়টা নিয়ে সোবহান যে ভাবেনি তা নয় , সেও দেখেছে তার বড় কর্তারা , এ দেশের বড় রাজনীতিবিদ ,Businessman, ডাক্তার , ব্যারিস্টার , পুলিশ এর কর্তা এইরকম অনেকেই মালয়েশিয়া , কানাডা , অস্ট্রেলিয়া তে জমি বাড়ি কিনে সেখানে পরিবার পাঠিয়ে দিচ্ছে । দেশে থাকছেন শুধু নিজে , তিনি কামাই করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন পরবাসের পরিবারের কাছে ।

এসব নিয়ে আলোচনা করে সোবহানের দম বন্ধ হয়ে আসে ............... ভালো করে খোঁজ নিয়ে দ্যাখে অনেকেই সেকেন্ড হোম কিনে ফেলেছে ইতিমধ্যে ......... তাইতো এক্ষুনি তাকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে , এ দেশে মানুষ বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে , এ দেশে থাকবে শুধু চাষারা ............ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।