আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নির্মমতার মাটিতে

আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।

বাসে মানুষের গাদাগাদিতে জব্বার সাহেব মনে করেছিলেন ঘুমাতে পারবেন না । প্রথমে সিটে বসে আতঙ্কিতবোধ করেছিলেন সামনের সাত ঘন্টা কিভাবে এই খোয়াড়ের মধ্যে বসে থাকবেন । ইদানিং মানুষজনের ভীড় একেবারেই সহ্য করতে পারেন না । বিশেষত সেই ভীড় যদি লোকাল বাসের হয়ে থাকে তাহলে আরো বেশী অসহনীয় ঠেকে ।

হাঁসফাঁস করা ছাড়া উপায় থাকেনা । এই জন্য প্রায় প্রতিদিনই অফিস থেকে বের হলে একটা লম্বা পথ তাকে হেঁটে যেতে হয় । সারা মাস কিছু সঞ্চয় হলে শেষের দিকে মাঝেসাঝে রিকশা করে বাড়ী ফেরার বিলাসিতা এফোর্ড করা যায় । কিন্তু এখন তো আর কোন উপায় নেই । ঘুম না আসলে টানা সাত ঘন্টা বাসের গরমে দমবন্ধ হয়ে বসে থাকা অন্য কোন পথ নেই ।

এই ভাবতে ভাবতেই কখন ঘুম চলে এসেছিলো ঠাহর করতে পারেননি । যখন বাসের প্রবল ঝাঁকুনীতে সহযাত্রীর গায়ের উপর অনিচ্ছাকৃতভাবে মাথা ঠুকে দিয়ে সেই ব্যক্তির বাক্যবাণের ঝাঁঝ কান বরাবর ধেয়ে এলো তখন ডান দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইলেন বাস কোথায় এসে থেমেছে । বুঝতে না বুঝতেই বেঁটে করে দেখতে ষন্ডামার্কা শরীরের বাসের হেলপার হেঁড়ে গলায় “ দাউদকান্দি আসছে বাস দাউদকান্দি “ বলে উঠলে দেখতে পান সব যাত্রী কোন কারণ ছাড়া হুড়মুড় করেই বাস থেকে নেমে যাচ্ছে । অথচ বিশেষ কোন তাড়া থাকবার কারণ নেই । মিনিট পঁচিশের জন্য দাউদকান্দিতে এসে বাস থেমেছে ।

যেই জায়গায় এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে গোটা তিনেক রেস্টুরেন্ট দেখা যাচ্ছে । সব যাত্রী এই পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই খাওয়াদাওয়া , ফ্রেশ হয়ে নেওয়া ইত্যাদি কাজকর্ম সেরে পুনরায় বাসে উঠবে ।

পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি , ছিষট্টি কেজির একান্ন বছরের জব্বার সাহেব প্রথমে ভেবেছিলেন শুধু ফ্রেশ হয়ে নেবেন । তারপর রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে বাইরের খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবেন কতক্ষণ । অনেকক্ষণ যাবত কোন সিগারেট ধরাননি ।

তার তেষ্টা পেয়েছে বেশ । তাছাড়া এই প্রারম্ভিক সন্ধ্যায় বাইরে বাতাস দিচ্ছে বেশ । চারপাশ গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ বলেই সমগ্র জায়গাটার পরতে পরতে সম্ভবত এমন স্নিগ্ধতা । কিন্তু ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতে হতেই পেটে ক্ষিধা মোচড় দিয়ে উঠলে তাকে আর উপেক্ষা করতে পারলেন না । একটা সিটে বসে ক্লান্ত শরীরের উদাস গলায় ওয়েটারকে গুটিকয়েক পরোটা আর সবজির অর্ডার দিয়ে চারপাশে মানুষজনের ব্যস্ততম চলাফেরার দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ ।

তারপরেই সেই একগাদা প্রশ্ন যার উত্তর খুঁজতে তার ফেনী সফর সেসব চিন্তা তার মস্তিষ্ককে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ঘিরে ফেললো । অনেকদিন পর সন্তুষ্টির সাথে জব্বার সাহেবের গলা দিয়ে খাবার নামতে থাকে । তৃপ্তি সহকারে গোটা তিনেক পরোটা গলাধঃকরণের পর তার ইচ্ছা করলো আরো গোটা দুয়েকের অর্ডার দেন । হাতে আরো সময় আছে দশ মিনিটের মতো । অতিরিক্ত পরোটার অর্ডার দেওয়া যেতেই পারে ।

সেই সময়ে জব্বার সাহেবের চোখে পয়তাল্লিশ বছরের এক সদাবিরক্ত ভদ্রমহিলা , বছর আঠারোর উদ্ধত এক তরুণ এবং পৃথিবীর যাবতীয় নোংরামীর সাথে ধীরে ধীরে পরিচিত হতে থাকা বছর পনেরোর এক কিশোরীর মুখ ভেসে উঠলো ।

ইদানিং উপরিউক্ত মানুষগুলোর মুখোমুখি হলেই জব্বার সাহেবের নিজেকে সম্পূর্ণ নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিতে ইচ্ছা করে । যদিও তাদের কেউই কোন সময়তেই তিক্ততম কিছু প্রশ্নের জালে তাকে আটকায়না কিন্তু তিনি নিজের ভেতরেই প্রবল মানসিক অবসাদগ্রস্ততা অনুভব করেন । যেন তিনি নিজেকেই মূল্যায়ন করতে শুরু করেছেন । বিশেষত নিজের বাইশ বছরের চেনা সঙ্গিনীর কানের পাশের হালকা হলেও দৃশ্যমান পাকা চুলের দিকে চোখ পড়ে গেলে সনাতন কর্তাসত্তার চেতনা তাকে দিয়ে প্রশ্নটা করিয়েই নেয় ।

তিনি কি করেছেন তাদের জন্য ? কতোটুকু করতে পেরেছেন ? সুখী হবার জন্য সংসারে অঢেল উপকরণের প্রয়োজন নেই ভেবে এসেছেন আজীবন । সেই কারণেই তেলতেলে হাসিমাখা নিকৃষ্টতম মুখে অফিসে টেবিলের তলা দিয়ে কচকচে নোটের কোন এদিক ওদিক হয়নি কখনো । তবুও তার পরিজনের কেউই আনন্দিত নয় । নিজ নিজ পৃথক কারণেই প্রত্যেকের মুখ সবসময় আষাড়ের আকাশের মতো । কেউ ক্ষুব্ধ , কেউ অভিমানী , কেউ উদাসীন তো কেউ ক্লান্ত ।

ঠিক এই চক্রের মধ্যেই তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপন আবর্তিত হয় । আবর্তিত হচ্ছে । কিন্তু অন্তত এইবারে এই গতানুগতিকতা থেকে বেশ কিছুদিনের জন্য বাইরে আসা যাবে ।

এদিকে বাসের সব যাত্রীকে বাসে উঠে আসবার জন্য বলা হলে জব্বার সাহেব হৃষ্টচিত্তে বিল মিটিয়েই দ্রুত বাসে ফিরে তার সিটে উঠে বসেন । মিনিট পঁচিশের এই বিরতিটা তার মেজাজ ফুরফুরে করে দিয়েছে ।

এই কারণে বাসের ড্রাইভার নিজের পছন্দের চটুল হিন্দী গান ছেড়ে দিলেও তাতে মনুষ্যপ্রাণীর রুচিহীনতা নিয়ে তার মনের মধ্যে কোন দার্শনিক ভাবনার উদয় ঘটেনা । জব্বার সাহেব শুকনো , তামাটে চেহারার সহযাত্রীর কাছ থেকে পত্রিকাটা চেয়ে নিয়ে অস্ফুট আলোতেই পড়তে চেষ্টা করলেও সুবিধা করে উঠতে পারেননা । পত্রিকাটি পাশেরজনকে ফিরিয়ে দিতে দিতেই তার তিন রো সামনের যাত্রীদের মধ্যে কোন এক কারণে তুমুল বচসা শুরু হয়ে যায় । সেই প্রবল বাদানুবাদ একসময় অনিবার্যভাবেই গালাগালিতে পর্যবসিত হবার পর হাতাহাতি শুরু হলে জব্বার সাহেব জীবনে যা করেননি তাই করে বসলেন । নিজের ব্যক্তিত্বের মধ্যে প্রয়োজনীয় ভারিক্কি ভাব এনে ঝগড়ারত মানুষদের মিউচুয়াল করিয়ে দিতে সফল হলেন ।

কোন যুক্তি নেই তবু জব্বার সাহেবের মনে হতে লাগলো একবার ঢাকায় গিয়ে মালিবাগের সেই চুনকাম ঝরে ঝরে পড়া পুরনো বাড়ীটায় পৌঁছাতে পারলেই এখন থেকে অনেক কিছু বদলাতে আরম্ভ করবে । একটা মামলার রায়ে জয়লাভের এতো এতো ক্ষমতা সেটা কখনো উপলব্ধি করেননি ।

এদিকে বাস ক্রমশ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ঢিমেতালে নয় বরং দ্রুত গতিতেই চলছে । কোন এক কারণে আজকে ট্রাফিক জ্যামের বিশেষ উপদ্রব দেখা যায়নি । এভাবে আরো ঘন্টা এক বাস চলার পর তার শেষ গন্তব্য সায়েদাবাদ থেকে চার কিলোমিটার দূরে থাকতে থাকতে প্রফুল্লচিত্তের জব্বার সাহেবের হঠাৎ মনে হলো সামনেই এক পরিচিত মিষ্টির দোকান থেকে কেজি দুয়েক মিষ্টি কিনবেন ।

এখানে নেমে গেলেও সমস্যা হয়না । কিছু না কিছু একটা জুটে যাবেই । তাছাড়া রাত বিশেষ হয়নি এখন । এরকম কিছু দ্রুতগতির ভাবনার ফলাফল সচরাচর না বোধক হয়না ।

হেলপারকে সেখানেই নেমে যাবেন কথাটা বলার বিশ সেকেন্ড পর ছুটন্ত বাস থেকেই ডান পায়ের পরিবর্তে বাঁ পা দিয়ে ফেলার খেসারত হিসাবে যখন বাসের চাকা জব্বার সাহেবের পায়ের উপর দিয়ে চলে গেলো তখন শারীরিক যন্ত্রণার ফলে তীব্র আর্তনাদের সাথে সাথে এক ধরণের শঙ্কা তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো ।

সেই চিরাচরিত পরাজয়ের শঙ্কা । অচেতন হবার আগে মাদকতাময় শহরের যে টুকু আলো তার চোখে এসে পড়েছিলো তাতে জব্বার সাহেব দেখেছিলেন দুইজন ঠেলাগাড়িওয়ালা কোত্থেকে দেখতে পেয়ে মাটিতে তার শায়িত শরীরের দিকে দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.