কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহ আদালতে নেওয়ার পথে জেএমবির তিন শীর্ষ জঙ্গি নেতাকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, দেশে জঙ্গি তৎপরতা নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার গত পাঁচ বছরে জঙ্গিবিরোধী দৃঢ় অবস্থান নেওয়ায় তাদের প্রকাশ্য তৎপরতা কমে এলেও তারা যে একেবারে নিষ্ক্রিয় নয়- সে কথা অনেকেই বলছেন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই মূলত দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটেছে, তারা তাদের শক্তি সংহত করার সুযোগ পেয়েছে তাদের প্রতি ওই সরকারের নমনীয় নীতির কারণে। জঙ্গিরা যে লক্ষ্য অর্জনের জন্য বোমা-সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়েছে, চারদলীয় (বর্তমান ১৯ দল) জোটের মধ্যেই সে লক্ষ্যে বিশ্বাসীদের উপস্থিতি ছিল এবং আছে। এমনকি বিএনপির কিছু সাবেক মন্ত্রী-এমপিও জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বলে গণমাধ্যমে সে সময়ই খবর বের হয়েছিল।
এমন অভিযোগও কেউ কেউ করেন যে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতেই দেশে বোমা হামলা শুরু হয়েছে। কাজেই জঙ্গিবাদের উত্থানের জন্য শুধু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, এ জন্য কিছুটা দায়ভার আওয়ামী লীগকেও বহন করতে হবে। আবার কেউ বলছেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না, বর্তমান বিশ্বপ্রেক্ষাপটেই একে দেখতে হবে, বিবেচনা করতে হবে। কারও বক্তব্যই এক কথায় বাতিল করে দেওয়ার মতো নয়। কেন, কীভাবে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটছে, একবাক্যে এবং একপেশে বক্তব্য দিয়ে তা ব্যাখ্যা করা ঠিক নয়।
জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করা যাবে কীভাবে অথবা দেশের মাটি থেকে ধর্মীয় জঙ্গিদের সমূলে উৎপাটন করার প্রকৃত উপায় কী এক কথায় এসব প্রশ্নের যারা উত্তর দেন বা খোঁজেন, তারা সমস্যাটিকে গভীরভাবে তলিয়ে দেখেন বলে মনে হয় না। রাজনৈতিকভাবে আমাদের দেশ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আছে। একপক্ষ যেটা বলবে, অন্যপক্ষ বলবে তার উল্টোটা। কোনো জাতীয় ইস্যুতেই একমত হওয়ার সুযোগ নেই। জঙ্গি সমস্যা মোকাবিলার জন্য জাতীয় ঐক্যের কথা যারা বলেন, তারাও বলতে পারেন না কীভাবে এ ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব।
উগ্র সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এক সুরে কথা বলবে এমন পরিস্থিতি যদি দেশে তৈরি হয়, তাহলে তো আর কোনো সমস্যাই থাকে না!
এটা দেখা গেছে যে, বিভিন্ন সময় জেএমবির সদস্য অথবা আত্দঘাতী জঙ্গি হিসেবে যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের অধিকাংশই মাদ্রাসার ছাত্র এবং অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সদস্য। ধৃত জঙ্গিদের স্বীকারোক্তি থেকে এটাও জানা যাচ্ছে যে, তারা বিদেশ থেকে অর্থসাহায্য পান, আফগানিস্তান অথবা অন্য কোনো দেশে গিয়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী চক্রের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, জঙ্গি নির্মূলে কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানই যথেষ্ট নয়। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব এবং মাদ্রাসা শিক্ষা জঙ্গি তৈরির প্রধান সহায়ক ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করছে। আজকাল ইংরেজি শিক্ষিত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের মধ্যে কেউ কেউ জঙ্গিবাদী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে বলে জানা গেলেও তা খুব ব্যাপকভাবে নয়।
তাই জঙ্গি দমন বা নির্মূল করার জন্য দেশ থেকে যেমন দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর করা দরকার, তেমনি দরকার মাদ্রাসাগুলোর ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্যক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন আনা। একই সঙ্গে জঙ্গিদের সঙ্গে যে বিদেশি কানেকশন গড়ে উঠেছে তা ছিন্ন করা। তাদের অর্থের সরবরাহ বন্ধ করা। এ কাজগুলো কোনোটাই সহজ নয়। বিএনপি-জামায়াত জোটের পরিবর্তে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা ক্ষমতায় এলেও যেমন দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করা যাচ্ছে না, তেমনি মাদ্রাসাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকারও আওয়ামী লীগ দেখাতে পারছে না।
যেসব বৈদেশিক উৎস থেকে জঙ্গিরা অর্থ ও অন্যান্য রসদের জোগান পাচ্ছে, সেই উৎসগুলো বন্ধ করার মতো পদক্ষেপও আওয়ামী লীগ সরকারকে গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না।
বিভিন্ন সময় গ্রেফতারকৃত জঙ্গিদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, জঙ্গিরা মূলত কিছু মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করেই তাদের তৎপরতা চালায়। পবিত্র মসজিদকেও তারা শেল্টার হিসেবে ব্যবহার করে। অথচ আওয়ামী লীগের জন্য মসজিদ ও মাদ্রাসা- দুটোই অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে 'ধর্মবিরোধী' বা 'হিন্দুপ্রেমিক' দল হিসেবে প্রচার করায় তারা স্বভাবতই কিছুটা আত্দরক্ষামূলক অবস্থায় থাকে।
ফলে মসজিদ-মাদ্রাসা নিয়ে বিতর্ক তারা এড়িয়ে চলে। বিরুদ্ধ প্রচারণার জবাব দেওয়ার পরিবর্তে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এমন সব আচরণ করেন বা কথা বলেন যা তাদের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক অবস্থানকে স্পষ্ট না করে বরং ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করেন তাদেরই উৎসাহিত করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকেও মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের ব্যবস্থা করতে পারেনি। মসজিদগুলোয় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা গিয়ে নামাজ আদায় করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অভিযোগ আছে, কোনো কোনো মসজিদে ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিকরা তাদের রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের সুযোগ নেন।
এটা ক্ষতিকর। মসজিদের মাইক থেকে অসত্য ঘোষণা প্রচার করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার বেশ কিছু ঘটনার কথা শোনা গেছে। 'ধর্ম পালনের স্বাধীনতায় হাত দেওয়া হচ্ছে'- এ সমালোচনার ভয়ে শঙ্কিত থাকায় সরকার তথা আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক প্রচারণা বন্ধে বাস্তবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ বা পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়ামী লীগ কোনো কোনো ধর্মভিত্তিক সংগঠনের সঙ্গে এক ধরনের আপস বা সমঝোতার নীতি নিয়ে চলে বলেও অভিযোগ আছে।
দেশে কওমি মাদ্রাসাগুলো নিয়ে নানা কথা আছে।
এ মাদ্রাসাগুলোয় কী পড়ানো হয়, তাদের টাকা-পয়সার উৎস কী তা জানার উপায় নেই। অনেক মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না, জাতীয় পতাকা উঠানো হয় না। অথচ এ কওমি মাদ্রাসাগুলো মূলত জঙ্গি তৈরির কারখানা বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কোনো কওমি মাদ্রাসায় যদি জঙ্গিবাদের শিক্ষা দেওয়া না-ও হয়, তাহলেও সেখানে যে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয় না, সেখান থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে কেউ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে কোনো চাকরি পাওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠে না- সে বিষয়ে সম্ভবত কোনো বিতর্কের সুযোগ নেই। অর্থাৎ শিক্ষার নামে কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা অশিক্ষাই গ্রহণ করে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার এক কলামে লিখেছেন : 'প্রত্যন্ত গ্রামের কোনো একটি কওমি মাদ্রাসার হতদরিদ্র ছাত্র এবং ঢাকা শহরের নামিদামি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের আধুনিকা একটি ছাত্রীকে যদি সামনাসামনি বসিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তারা এ ধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। একই দেশের একই বয়সী দুজন ছেলেমেয়ে কিন্তু তাদের চিন্তাভাবনা, লেখাপড়া, মূল্যবোধ, মুখের ভাষা এত ভিন্ন যে তারা কি আদৌ কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারবে? আমাদের কি দায়িত্ব ছিল না যে এ দেশের এক বয়সী ছেলেমেয়েরা যেন দেশ সম্পর্কে একই রকম ধারণা, একই রকম মূল্যবোধ, একই রকম ভালোবাসা এবং যখন প্রয়োজন তখন একই রকম ক্ষোভ নিয়ে বড় হয়- সেটি নিশ্চিত করা?' এ দায়িত্বটি আসলে কেউ যে পালন করেনি তা আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষায় সংস্কার আনাটা এখন সময়ের দাবি। অথচ যারা কওমি মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষক তারা সংস্কারের বিরোধিতা করেন। দেশের আলেম-মাশায়েখরা একদিকে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বলেন, বলেন বোমা মেরে মানুষ হত্যা করা ইসলামসম্মত নয়; অন্যদিকে যেসব কওমি মাদ্রাসায় জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ আছে, সেসব মাদ্রাসায় পুলিশি অভিযানের বিরোধিতাও তারা করেন।
জঙ্গি বা জেএমবির কর্মী হিসেবে মাদ্রাসা ছাত্রদের গ্রেফতার করা হলে তারও বিরোধিতা করা হয়। হুমকি দেওয়া হয়, মাদ্রাসায় হাত দিলে জিহাদ শুরু করা হবে। প্রশ্ন হলো, মাদ্রাসা রক্ষার জন্য জিহাদ এবং জঙ্গিদের ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার জিহাদের মধ্যে পার্থক্য কী? জঙ্গিরা বোমা ফাটিয়ে মানুষ মেরে ইসলামী শাসন বা আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ করতে চান আর মাদ্রাসা রক্ষার নামে যারা জিহাদ করতে চান, তাদের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?
পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে ধর্মভিত্তিক এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতিচর্চার এক উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে আমাদের দেশ। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পরাভূত করার যে কথা আমরা বলি তা এখন অনেকটা 'মিথ' হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা সহজভাবে স্বীকার করতেও আমাদের অনেকের কষ্ট হয়। অথচ বাস্তব সত্য হলো, দেশে এখন পাকিস্তানপন্থি সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় রাজনৈতিক ধারার পরাজিত শক্তি অনেক সবল অবস্থানে আছে আর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী অসাম্প্রদায়িক ধারার রাজনৈতিক শক্তি হয়ে পড়েছে দুর্বল।
এক পক্ষ ঐক্যবদ্ধ, অন্যপক্ষ বিভক্ত। এ নিয়ে কেউ বিতর্ক করতে পারেন, তাতে সত্যের কোনো হেরফের হবে না। একটা কথা চালু আছে যে, আমাদের দেশের মানুষ ধর্মভীরু কিন্তু উগ্র সাম্প্রদায়িক নয়। পাকিস্তান আমলেও এ বাক্যটি যতটা সত্য ছিল, এখন আর ততটা আছে বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। যারা ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেন, তারা বছরের পর বছর দেশের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক ও উসকানিমূলক প্রচারণা চালিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে জোরালো কোনো প্রচারণা না থাকায় পরিস্থিতি বদলে গেছে।
এক দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওয়াজ মাহফিলের নামে যে সাম্প্রদায়িক ও বিভেদাত্দক উন্মাদনা প্রচার করেছেন, তার বিপরীতে প্রগতিশীলদের পক্ষ থেকে অসাম্প্রদায়িক ও উদারতার পক্ষে কি কেউ তেমন জোরালো বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থিত হয়েছেন? দেশের ভেতরে ধর্মের নামে উগ্রবাদী রাজনীতিচর্চার যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছে দীর্ঘ দিন ধরে, তা আমরা উপেক্ষা করেছি, দেখেও না দেখার ভান করেছি। বিষবৃক্ষ রোপণ করে তা থেকে অমৃত আশা করা যায় না।
পাকিস্তানি জমানার শুরু থেকেই বামপন্থিরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং ছাত্র-যুব সমাজ দ্রুত সে আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ছিল এক মাইলফলক।
বলা যায়, বামপন্থিদের প্রভাবেই আওয়ামী লীগও পরিবর্তিত হয়েছে, ক্রমেই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে সাম্প্রদায়িকতার ভূত মানুষের ওপর আর ভর করতে পারবে না। সংবিধানে যেহেতু 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি সংযোজিত হয়েছে কাজেই দেশের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই অসাম্প্রদায়িক তথা ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় শানিত হয়ে উঠবে। অথচ এটা বোঝা হলো না যে স্বাভাবিকভাবে কেউ ধর্মবিশ্বাসী হতে পারে, ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না। শিক্ষা-সংস্কৃতির চর্চা এবং বিকাশ ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতা মানুষের মধ্যে স্থায়ী রূপ পায় না।
ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে স্বাধীনতার পর নানা ধরনের অপপ্রচার হয়েছে। সেসব অপপ্রচারের যুক্তিসঙ্গত জবাব দেওয়ারও কোনো প্রয়োজন কেউ বোধ করেনি। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগেরও ব্যর্থতা আছে। স্বতঃস্ফূর্ততাই আওয়ামী লীগের বৈশিষ্ট্য। আওয়ামী লীগ কখনোই সাংগঠনিক দুর্বলতা দূর করে একটি সংগঠিত ও সুসংহত রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার জন্য যা যা করা দরকার তা করেনি বা করতে উৎসাহবোধ করে না।
ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা এ দলটি বারবার উচ্চারণ করলেও দেশের মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়টি পরিষ্কার করে উপস্থাপন করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা- শব্দযুগল একটা বায়বীয় ব্যাপার থেকে গেছে।
অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক দলগুলো সংগঠিত ও পরিকল্পিত প্রচারণার মাধ্যমে মানুষের মনে এক ধরনের মোহ সৃষ্টি করতে পেরেছে। দোজখের ভয়, বেহেশতের প্রলোভন অনেককেই দুর্বল করে। তা ছাড়া মানুষ দেখছে, সব শাসন আমলেই দুর্নীতির বিস্তার ঘটছে।
কোনো সরকারই সুশাসন নিশ্চিত করতে পারেনি। এ অবস্থায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সবচেয়ে সংগঠিত দল জামায়াতে ইসলামী দেশে 'সৎ লোকের শাসন' কায়েমের স্লোগান তুলে কিছু মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে। ধর্ম ও রাজনীতিকে তারা এক ও অভিন্নভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করে থাকে। ধর্ম যে ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও চর্চার বিষয়, একে রাজনীতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে তা যে মঙ্গল বয়ে আনে না- এ কথাটি ধর্মনিরপেক্ষ বা অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলো (আওয়ামী লীগসহ) মানুষের সামনে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরতে পারেনি। তারা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তির চেয়ে উন্নত বা আকর্ষণীয় কোনো বক্তব্য দিয়ে দেশের মানুষের সামনে হাজির হতেও পারেনি।
মানুষকে নতুন স্বপ্ন দেখানোর বদলে অতীতমুখীনতাই মূলধারার রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হওয়ায় মানুষের মধ্যে তা কোনো উদ্দীপনা সৃষ্টি করে না। এর সুযোগ নিয়েছে ধর্মব্যবসায়ীরা, জঙ্গিবাদীরা। তারা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এখন কেবল সেমিনার বা টকশোয় জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করে কিংবা মাঠে-ময়দানে উচ্চৈঃস্বরে বক্তৃতা করে ওই শক্তিকে পরাভূত করা সহজ হবে না। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়জুড়ে সাম্প্রদায়িক শক্তি তার শিকড় ছড়িয়েছে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে।
তাদের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ এখন অত্যন্ত মজবুত। তাদের শিকড় উৎপাটনের জন্য অব্যাহতভাবে আদর্শগত সংগ্রাম চালাতে হবে ব্যক্তিপর্যায়ে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে। আদর্শগত লড়াইয়ে বিজয় অর্জন রাতারাতি হবে না, এ জন্য দরকার হবে লাগাতার প্রচারণা-লড়াই। সে লড়াইয়ের মানসিকতা ও প্রস্তুতি আওয়ামী লীগসহ তার সহযোগী দলগুলোর কতটুকু রয়েছে, মানুষ সে ব্যাপারে সন্দেহমুক্ত না হলে অনুপ্রাণিত হবে না। মানুষের ভেতরের অন্ধকার দূর করার জন্য আলো ছড়িয়ে জাগরণ তৈরি করার পরিবর্তে জঙ্গি দমনের শর্টকাট পথ খুঁজলে দেশের সামনে থেকে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিপদ দূর হবে না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
ই-মেইল : bibhu54@yahoo.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।