পর পর কয়েকটা জনসভায় জমিয়ে বক্তৃতা করেছি। ইদানীং এলাকায় একটা অন্যরকমের খাতির পাচ্ছি। দলের মধ্যে কিছু সিনিয়র নেতাদের কাছে বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছি কিন্তু কয়েকজনের আবার চোখে মুখে একটা উদ্বেগ লক্ষ্য করছি-হয়ত ওরা ভাবছে ওদের উত্থানের পথে আমি বাধা হয়ে দাঁড়াব কিনা। এসবের মধ্যে খারাপ খবর যেটা সেটা হল বক্তৃতা দেবার ব্যাপারে যার উপর আমি ভরসা করি সেই সুহাসকে ঠিক মত পাওয়া যাচ্ছেনা। কয়েকজনের কাছে খোঁজ খবর করেও যখন হদিশ পাওয়া গেলনা তখন একদিন সকালে নিজেই সুহাসের বাড়ী গিয়ে হাজির হলাম।
অ্যাসবেসটসের ছাউনি দেওয়া পাশাপাশি দুটো পাকা ঘরের একটাতে সুহাস থাকে সেটা জানতাম। ডাকাডাকি করার পর বোধহয় ঘুম ভাঙল। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজিয়েছে, চুল উস্কোখুষ্কো একটা ফুলপ্যান্ট পরা খালি গায়ে হাড়গোড় সব প্রকাশ করতে করতে সুহাস আমার সামনে এসে দাঁড়াল। চেহারার বেশ পরিবর্তন হয়েছে দেখলাম। ওকে যথেষ্ট রোগা আর ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল।
কিরে ব্যাপার কি তোর? সামনে একটা বড় ভোট আসছে আর এই সময় তুই ডুব মেরে ঘরে বসে আছিস কেন?
সুহাস ইঙ্গিতে আমায় ভেতরে যেতে বলায় ওর পেছন পেছন ওর আগোছালো ঘরটার মধ্যে ঢুকে পড়লাম। কবেকার একটা পুরানো কাঠের টেবিলের উপর রাজ্যের বই, পত্র পত্রিকার স্তুপ জমে আছে। খাটের উপর এখানে ওখানে খাতা, বইয়ের ছড়াছড়ি। আলনায় যেমন তেমন ভাবে কতকগুলো গেঞ্জি, জামা,প্যান্ট ঝুলছে। খাটের উপরই বসে পড়লাম।
পঞ্চায়েতের প্রধান হবার আগে এখানে রোজই একবার করে আসতাম। কিন্তু এখন আর সময় কই যে আসব!
আসলে আমার মন, শরীর কিছুই ভাল চলছে না। তাই ক’দিন কোথাও বেরোই নি। তোমার খোঁজ খবরও রাখতে পারিনি। তাছাড়া তুমি তো এখন নেতা হবার লড়াইতে ব্যস্ত।
খোঁজ নিয়ে করবই বা কি? সুহাসের এই নির্লিপ্ত ভাব দেখে আমার রাগ হয়।
তোর বলার ধরণটা আমার ভালো লাগল না সুহাস। কাজ করতে করতেই মানুষ নেতা হয়। মানুষ যদি আমার কাজ পছন্দ করে, আমার বক্তব্য শুনে খুশী হয়ে আমাকে তাদের মাথা করতে চায় তবে আমি তাদের পছন্দ অগ্রাহ্য করব কেন?
তুমি কি আমাকে একটা কাজ যোগাড় করে দিতে পারো? আমার একটা সম্মানজনক কাজ দরকার।
এটা তুই কি বলছিস সুহাস? আমি কি এমন ক্ষমতাধর যে চাইলেই তোর একটা কাজ করে দেব? আর তাছাড়া এটাই যদি তোর চাওয়া হয় তুই সাধারণ পথেই সেটা পেতে পারিস।
তুই এম এ পাস। কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় বসলে তোর যা জ্ঞানগম্যি তাতে না হবার তো কিছু নেই।
তুমি কি জানো, এবার প্রাইমারি টীচারের পরীক্ষায় আমি ওতরাতে পারিনি?
প্রাইমারি? কই তুই পরীক্ষায় বসেছিস আমাকে তো বলিস নি। আমাকে বলা তোর উচিত ছিল। আর তোর মত ছেলে প্রাইমারীতে না বসে এস এস সি তে বসলেই তো পারে।
সেখানেও কি সব ঠিকঠাক হচ্ছে? হচ্ছে না তো।
বেশির ভাগই ঠিকঠাক হচ্ছে। কিছু এদিক ওদিক সব আমলেই হত, এই আমলেও হবে।
আমি দুলাখ টাকা কোথায় পাব যে তাই ভেট দিয়ে চাকরি করব?
এসব বাজে কথা। এসব গুজব।
লোকে যা বলে সেটাই বিশ্বাস করিস না। সুহাসের উপর এবার আমার রাগ হতে থাকে। ও আমার বক্তৃতা লিখে দেয় বলে কি ধরাকে সরা ভাবে।
তুমি হয়ত সবটা জানোনা। অনেক কিছু আড়ালে আবডালে হয়।
কিন্তু হচ্ছে যে সেটা আমি নিশ্চিত জেনে তোমাকে বলছি।
যাক, সুহাস, সকাল বেলা আমি ঝগড়া করতে তো আসিনি। তুই কি আমাকে সাম্প্রতিক পরিস্থিতির উপরে বেশ কিছু খসড়া বক্তৃতা মানে আমাদের লাইন থেকে যেটা বললে লোক শুনে বাহবা দেবে তেমন কিছু আমায় রেগুলার লিখে দিয়ে সাহায্য করবি? তুই তো জানিস তোর উপর আমার কত ভরসা। আমি সাগ্রহে সুহাসের সম্মতির জন্য অপেক্ষা করি।
সুহাস কিছুক্ষণ কি যেন ভাবে তারপর মাথা নাড়ে, অসম্মতি জানায়।
ওর দুঃসাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাই।
কি বলছিস তুই সুহাস? তুই না আমাদের ছেলে?
তুমি যতদিন ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের পক্ষে কথা বলতে ততদিন আমি তোমায় সাহায্য করেছি কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। কারণ তুমি আর সত্য বলতে পারবে না। নেতা হবার জন্য এখন তুমি মিথ্যা বলবে, ইচ্ছা করে মানুষের মনে মিথ্যা আশা জাগিয়ে তুলবে। না আমার কাছ থেকে তুমি একাজে সাহায্য আশা কোরনা।
আমি ওর ব্যবহারে স্তম্ভিত হয়ে যাই। এতক্ষন আমি আপনাদের সামনে বিনয় করছিলাম মাত্র। না জানার ভান করছিলাম মাত্র। রাজনীতিতে অনেক রকমের মানুষ নিয়ে চলতে হয়। পছন্দ না করলেও তাদের তালে তাল দিতে হয়।
কারণ শুধু ন্যায়বাদী, সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের সংখ্যা, মানে এইরকম যাদের ভোটদানের অধিকার আছে তাদের সংখ্যা বড়ই কম। মাত্র ঐ কয়েকটি ভোট পেলে তো আর ক্ষমতা ধরে রাখা যায়না। আর ক্ষমতা ধরে না রাখতে পারলে কোন কিছুই ধরে রাখা যায়না। তখন হাড়গোড় বেরোন, খোঁচা খোঁচা দাড়ি ধরে রেখে এইরকম এক প্রেতমূর্তি হয়ত হওয়া যায় এর বেশী কিছু নয়। আমি আর একজন সুহাস সহজেই খুঁজে বার করতে পারব।
কিন্তু সে শালাও যে আসল সময়ে এরকম বিগড়ে যাবেনা এমন কথা আমি কি করে দিতে পারি?
প্রিয় পাঠকবৃন্দ আপনাদের সঙ্গে ছলনা করতে চাইনা। দুনিয়াটা আপনাদের পছন্দসই করে গড়ে তোলার দায়িত্ব শুধু আমার একার নয়, আপনাদেরও। তাই পাকা কথা দেবার আগে জানতে চাই সুহাস এবং আমার মধ্যে কাকে আপনাদের পছন্দ?।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।