আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে আবারও দুর্ভাবনা!

আমাদের দেশে এসএসসি ও এইচএসসির মতো একেকটি পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে বছরের পর বছর, এমনকি যুগের পর যুগ-আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত অল্পবিস্তর ব্যতিক্রম ছাড়া বিগত ৪২ বছরে যত অনিয়ম, অবিচার ও দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে তার একটি নজিরও বোধকরি আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে না লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, মহল বা কর্তৃপক্ষের অবজ্ঞা, অবহেলা, উদাসীনতা বা খামখেয়ালিপনারও কোনো দৃষ্টান্ত। বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থী, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকের চরম অনিশ্চয়তা বা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করারও দৃষ্টান্ত মনে হয় একমাত্র বাংলাদেশই। কিন্তু হলে কি হবে, এ সব নিয়ে কার্যত কোনো ভাবনা বা যথাযথ মনোযোগ এমনকি খোদ সরকারেরই আছে কি-না সন্দেহ। যখন যে সরকারই ক্ষমতায় থাক সবার ক্ষেত্রেই কথাটি বলতে গেলে সমানভাবে প্রযোজ্য।

চাটুকার বা তোষামোদকারীরা নিজেদের এবং ব্যক্তি বা মহলবিশেষের স্বার্থরক্ষা বা উদ্ধার করার জন্য বরাবরই বাস্তবতা কিংবা প্রকৃত পরিস্থিতিটিকে সবকিছুর আড়ালে ঢেকে রাখতে সর্বাত্দক চেষ্টা চালিয়ে যায়। আর এ জন্য কখনো কখনো মনে সদিচ্ছা বা শুভবুদ্ধির উদ্রেক হলেও কোনো সরকারের পক্ষেই দীর্ঘদিনের অচলায়তন ভেঙে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সহজ কিংবা সম্ভব হয় না। ঘুরে-ফিরে শেষ পর্যন্ত একই জায়গায় এসে অবস্থান করতে হয় সরকারকে। মোটকথা পরীক্ষা নিয়ে পরীক্ষার্থী, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সচেতন সবারই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর দুর্ভাবনার যেন কোনো সীমা-পরিসীমাই নেই।

৩ এপ্রিল-২০১৪ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে।

১০টি শিক্ষাবোর্ডের অধীন মোট ১০ লাখেরও বেশি পরীক্ষার্থী এতে অংশগ্রহণ করবে। পরীক্ষাকে সামনে রেখে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে 'এইচএসসি পরীক্ষায় দুর্নীতির আশঙ্কা' এমনসব শিরোনামে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে পরদিন একটি সম্পাদকীয়ও চোখে পড়েছে। এসএসসি, এইচএসসি বা ডিগ্রির মতো একেকটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠান এবং এসবের ফলাফল নিয়ে আমরা বড় দুঃসময় অতিক্রম করে এসেছি। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অন্য সবকিছুর মতো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে।

সদ্য স্বাধীন দেশে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চরম অস্থিরতা এবং শত বাধা বিপত্তি ও অব্যবস্থার মধ্যে বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন একেকটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সঙ্গত কারণেই পরীক্ষাগুলোতে চলে ব্যাপক হারে গণটোকাটুকি। একেকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনুষ্ঠিত ডিগ্রি (পাস) পরীক্ষায় পাসের হার উঠে দাঁড়ায় ৬৫% বা ৭০% এবং বোর্ডেও অধীন এসএসসি বা এইচএসসিতে ৮৫%, ৯০%, এমনকি ৯৮ ভাগ। স্বাভাবিক অবস্থায় যা ছিল একেবারেই অভাবনীয়। কিন্তু কোনো পাবলিক পরীক্ষায় অর্জিত সর্বকালের সর্বোচ্চ এই পাসের হার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।

ক্রমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্থিরতা এবং বাধা বিপত্তিগুলো কমে আসায় শিক্ষাক্ষেত্রেও স্বাভাবিকতা ফিরে আসতে থাকে। ফলে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের শেষার্ধে অনুষ্ঠিত এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার নেমে আসে ২৮%, ৩০% বা ৩২% এ এবং ডিগ্রিতে (পাস) একেবারে অবিশ্বাস্য_ ৬%, ৭% কিংবা ৯% এ। গোটা আশির দশকই কাটে বলতে গেলে রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চরম অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতা লাভের এক-দেড় যুগ পরেও শিক্ষাক্ষেত্রে, বিশেষ করে একেকটি পাবলিক পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, রাজনীতিক এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা দফতরের সরকারি কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগসাজশে সংঘটিত অনিয়ম অব্যবস্থা নৈরাজ্য আর দুর্নীতির কথা বোধকরি কেউই কোনোদিন ভুলতে পারবেন না। শিক্ষকদের একটি বড় অংশ এ ব্যাপারে হয় একেবারে উদাসীন বা নির্লিপ্ত থেকেছেন, না হয় স্রোতে গা ভাসিয়েছেন।

নব্বইয়ের দশকে বিএনপি সরকারের আমলে (১৯৯১-১৯৯৬) এবং আওয়ামী লীগের আমলে (১৯৯৬-২০০১) বোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনুষ্ঠিত পরীক্ষাগুলোতে নতুন করে অনিয়ম, অব্যবস্থা এবং নৈরাজ্য পরিলক্ষিত হয়। এ সময়ে অনুষ্ঠিত একেকটি পরীক্ষায় ব্যাপক গোলযোগ, গণটোকাটুকি, এমনকি পরীক্ষাকেন্দ্রে গুলি ছোড়ার মতো ঘটনাও সংঘটিত হয়েছে। কোনো বিষয়ের একটিমাত্র পত্রের পরীক্ষায় পাঁচ হাজার, ১০ হাজার করে পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত মোট ৩০ বা ৪০ হাজারের মতো পরীক্ষার্থী বহিষ্কার করার দৃষ্টান্তও রয়েছে। দৃষ্টান্ত রয়েছে ডিগ্রি পাস ও সার্টিফিকেট কোর্স একদিনের একটিমাত্র বিষয়ের পরীক্ষায় পাঁচ হাজার পরীক্ষার্থী বহিষ্কারের। বহিষ্কার ছাড়াও প্রশ্নপত্র কঠিন হওয়ায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষাদানে বিরত থাকে আরও মোট ২০/২৫ হাজার কিংবা এরও বেশিসংখ্যক পরীক্ষার্থী।

পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কার এবং বিরত থাকা পরীক্ষার্থীর মোট সংখ্যা ৫০, ৬০ এমনকি ৭০ হাজারও ছাড়িয়ে যায় কখনো কখনো। মাস্টার্স শেষ পর্ব পরীক্ষা চলাকালে ব্যাপক হারে নকল করায় একটি কেন্দ্রের মোট ১৬০০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম দিনই চার শতাধিক পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করার ঘটনাও সচেতন অনেকের মনে থাকার কথা। ভুলে যাওয়ার কথা নয় একেকটি বোর্ডের অধীন অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় ৬০/৮০ কিংবা ১০০টিরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজনও পাস না করার স্মৃতি। এভাবে নব্বইয়ের দশকের শেষ এবং চলতি শতকের প্রথম দশকের শুরুর দিকে একেকটি পরীক্ষায় পাসের হার মাত্র ১৭%, ২৫% কিংবা বড়জোড় ৩০%/ ৩২% এর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এভাবে আমরা অনেক পথ অতিক্রম করে এসেছি।

গত ৮/৯ বছর ধরে বহিষ্কার এবং বিরত থাকা পরীক্ষার্থীর সংখ্যা অবিশ্বাস্য হারে কমে যায়। আর পাসের হার ৪০, ৫০, ৬০, ৭০ এভাবে উঠতে উঠতে গত দুবছর ধরে ৮০ কিংবা ৯০ এর ঘরে সামান্য এদিক-সেদিক হয়ে ওঠানামা করে। শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেলেও জিপিএ-৫ বা প্রথম বিভাগ (বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে) অর্জনের দিক থেকেও সংশ্লিষ্ট সবার মনে অনেকটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। কাজেই বলা যায়- এসএসসি, এইচএসসি বা ডিগ্রির মতো একেকটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠান এবং এসবের ফলাফল নিয়ে আমরা বড় দুঃসময় অতিক্রম করে এসেছি।

আমাদের দেশে পরীক্ষা, বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ রয়েছে প্রচুর।

এই গলদ একদিনে কিংবা এক বছরে, এমনকি বিশেষ কোনো দলীয় সরকারের আমলেও তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিনের অনিয়ম, অব্যবস্থা, অদক্ষতা, অমনোযোগিতা, রাজনীতিকদের স্বার্থান্ধতা ও সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের খায়েস এবং গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিধারী কিছু ব্যক্তির অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের ফসল হচ্ছে এসব। এসবকিছুকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে উদ্যোগী ও মনোযোগী হলে এসব কিছুই অতিক্রম করা সম্ভব। বলে রাখা ভালো, গত ১০-১২ বছরে পাবলিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবার মানসিকতা এবং যুগ যুগ ধরে বিরাজমান পরিস্থিতির অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে।

পরীক্ষার হলে গণটোকাটুকি বা নকলের মহোৎসব, কোনো পরীক্ষায় একটিমাত্র বিষয়ে ৭-৮ হাজার পরীক্ষার্থী বহিষ্কার, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ৩০-৪০ হাজার পরীক্ষার্থীর পরীক্ষাদান থেকে বিরত থাকা, পরীক্ষাকেন্দ্রে হামলা, ভাঙচুর, গুলি, ধাওয়া-ধাওয়ি, রক্তপাত, এমনকি মানুষের জীবননাশের ঘটনা_ এসব কিছুই এখন অতীতের স্মৃতিমাত্র। একইভাবে পাসের হার কখনো ১৭%, ২৫%, ৩০, কখনো আবার ৪০%, ৫০% এসবও এখন বলতে গেলে দুঃস্বপ্ন। নকল নামের দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে সবাই এখন অনেকটাই মুক্ত। বহুল আলোচিত 'আসন বিনিময় প্রথা' এবং 'ত্রিভুজ তত্ত্ব' প্রথমদিকে কিছুটা অসুবিধা দেখা দিলেও এসব প্রয়োগের ফলে বিগত বছরগুলোতে অনেক সুফল পাওয়া গেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী খোদ ঢাকা শহরেই আসন বিনিময় প্রথা এবং ত্রিভুজ তত্ত্বের আড়ালে কীভাবে ২০টি সেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত হওয়া কিংবা নিজেদের প্রতিষ্ঠানের ফলাফল তুলনামূলকভাবে ভালো করা যায় এ জন্য কিছু লোক একেবারে উঠেপড়ে লেগেছেন।

আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষায় দুর্নীতির আশঙ্কা মূলত এখান থেকেই। সবারই মনে থাকার কথা, ২০১৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর এ নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। আগের বছরের তুলনায় পাসের হার কিছুটা কমে যাওয়ায় এবং ৬০ হাজার জিপিএ-৫ এর জায়গায় দুই/তিন হাজার কম হওয়ায় কেউ কেউ এটাকে 'ফলাফল বিপর্যয়' (!) বলেও অভিহিত করেছিলেন ওই সময়। এমন ফলাফলের জন্য সরকার এবং বিরোধী দলের পক্ষ থেকে পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করে। এ ছাড়া প্রশ্নপত্র কঠিন, সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং শিক্ষকদের তড়িঘড়ি করে উত্তরপত্র মূল্যায়নের বিষয়টিকেও সামনে তুলে ধরেছেন ভুক্তভোগীরা।

কিন্তু এসব পাল্টাপাল্টি অভিযোগ-দোষারোপ, ক্ষোভ-অসন্তোষ, অবিশ্বাস-সংশয়ের পর আট মাস অতিবাহিত হতে চললেও কোনো স্তর থেকে এসব নিরসনের জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি। শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের এভাবে চুপ করে বসে থাকলে চলবে কী করে? যেভাবেই হোক সবার মন থেকে অবিশ্বাস, সন্দেহ, সংশয়, আশঙ্কা এবং সব ধরনের ভয়ভীতি ও দুর্ভাবনা দূর করতে হবে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাজিতপুর কলেজ, কিশোরগঞ্জ

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.