আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবাদের অহঙ্কার





স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবাদের অহঙ্কার
ফকির ইলিয়াস
_________________________________________________

মার্চ এলে অনেক রাজাকারও স্বাধীনতার গান গায়। এই গান তাদের নিজস্ব। লক্ষ্য করেছি, এসব রাজাকারা জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে তাদের অনুষ্ঠান শুরু কিংবা শেষ করে না। তারা ধর্মীয় গজল পরিবেশন করে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত যিনি লিখেছেন- তিনি হিন্দু।

তাঁর গান ওরা গাইবে কেন?
যারা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান করে না, যারা নানা কথায় আওয়ামী লীগের সমালোচনার নামে রাজাকার আলবদরদের পারপাস সার্ভ করে তাদের মতলব অন্যখানে। এরা কখনই চায় না এই দেশ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হোক। সম্প্রতি নিউইয়র্কে বাংলাদেশে ফাঁসি হওয়া একজন যুদ্ধাপরাধীকে নিয়ে একটি তথাকথিত সেমিনার হয়েছে। ঐ সেমিনারে যারা বক্তব্য দিয়েছেন এরা নিউইয়র্কে অপরিচিত নন। এরা মূলতই ঘাতক-দালালদের পক্ষের লোক।

এদের কেউ কেউ বলেছেন, তারা নাকি কাদের মোল্লার ‘সাংবাদিক’ জীবনের সহচর ছিলেন। তারা সাফাই গেয়েছেন, ঘাতক কাদের মোল্লা নাকি ব্যাঙও মারেনি। আমরা সবাই জানি, মানুষ খুনিরা মানুষই খুন করে। ব্যাঙ মারে না। কথা সেটা নয়।

কথা হচ্ছে, এসব ধ্বজাধারী সাংবাদিকই আবার কিছু প্রগতিবাদী সাংবাদিকদের বন্ধুÑ এই নিউইয়র্কে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে কিছু প্রগতিবাদীই এসব মুখোশধারী একাত্তরের দালালদের প্রেতাত্মার সঙ্গে ওঠাবসা করেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কি ইসলামি আন্দোলনের অংশ ছিল? এই প্রশ্নটি করা দরকার সে সব দালাল রাজাকারদের। তা না হলে যুদ্ধাপরাধীদের তারা ‘ইসলামি আন্দোলনের’ খেলাফতে ভূষিত করতে চাইছে কেন? একাত্তরের পরাজিত রাজাকার শক্তি অতীতে রাজনৈতিকভাবে কী বলেছেÑ তা আমাদের আরেকবার পড়া দরকার। ধর্মব্যবসায়ী জামাত নারী অধিকার ও নারী নেতৃত্ববিরোধী নানান ফতোয়া দিলেও অবশেষে মন্ত্রিত্ব নারী নেতৃত্বকেও জায়েজ করেছে।

জামাতের জন্য অবশ্য এটি কোনো নতুন বিষয় নয়। ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার জন্য ১৯৯১ সালেও সংরক্ষিত দুটি মহিলা আসনে প্রতিনিধি বসিয়ে একইভাবে নারী নেতৃত্বকে জায়েজ করেছিল। কিন্তু বিএনপি তখন জামাতকে সন্তুষ্ট না করায় আবার নারী নেতৃত্ব মানি না, বলতে সময় লাগেনি।
২০০১ সালের নির্বাচন তথাকথিত ইসলামি রাজনীতির সোল এজেন্ট দাবিদার দল জামাত আদর্শ বিসর্জন দিয়ে সব ধরনের আপোস-মীমাংসায় পৌঁছে মসনদের ভাগিদারও হয়েছে। অবশ্য মন্ত্রিত্ব জায়েজের জন্য জামাতের আমির সাবেক শিল্পমন্ত্রী মওলানা মতিউর রহমান নিজামী ওরফে মইত্যা রাজাকার নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘ইসলামে নারী নেতৃত্বকে অযোগ্য বলা হয়নি, আমরা নারী নেতৃত্বের জোটে যোগ দিয়েছি ইসলাম নির্মূলকারীদের হাত থেকে দেশকে হেফাজত করতে।

আওয়ামী লীগ এদেশ থেকে ইসলামি মূল্যবোধের চিহ্ন মুছে ফেলে ইসলামি রাজনীতি ধ্বংস করতে চেয়েছিল’ (দৈনিক যুগান্তর, ২৭.১০.২০০১)।
এর আগের ঘটনা ছিল এরকম। দলীয় এক সংবর্ধনা সভায় একাত্তরের ২৫ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিত্ব গ্রহণের যৌক্তিকতা সম্পর্কে জামাতের সেদিনের বয়ান ছিল ‘জামাতে ইসলামী পাকিস্তান ও ইসলামকে এক ও অভিন্ন মনে করে। ..কাজেই পাকিস্তান যদি না থাকে, তাহলে জামাতের কর্মীরা দুনিয়ায় বেঁচে থাকার কোনো সার্থকতা মনে করে না। ’ (দৈনিক সংগ্রাম, ২৬.৯.১৯৭১)।


জামাতের দুই প্রধান নেতা সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ ভালোই জানেন। একাত্তরে নিজামি ও মুজাহিদ দুজনই ছিলেন জামাতের ছাত্র সংগঠন তথাকথিত ইসলামী ছাত্রসংঘের শীর্ষস্থানীয় নেতা। মওলানা নিজামী ছিলেন পাকিস্তান (পাকিস্তানের উভয় অংশের) ছাত্রসংঘের (বর্তমান ছাত্রশিবির) সভাপতি। আর আলী আহসান মুজাহিদ পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সভাপতি। আজকের মতো মিলেমিশে দুই নেতা সেদিন মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই এর বিপক্ষে অবস্থান নেন।

দলে দলে তরুণ-যুবকরা সেদিন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও সেদিনের এই দুই তরুণ মুক্তিযুদ্ধ বিনাশ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিধনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। দুই সভাপতির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ঘাতক ‘আল-বদর বাহিনী’। এটি ছিল মূলত ছাত্রসংঘের একটি আর্মস ক্যাডার বাহিনী। যদিও এই বাহিনী গো আযমের সার্বিক নির্দেশে কাজ করতো কিন্তু এ প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ছিলেন মওলানা নিজামী। তিনি এই বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং মুজাহিদ ছিলেন প্রধান সংগঠক।

আল-বদর বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার। স্বাধীনতাকামীদের খুঁেজ বের করা এবং হত্যা করা। এর উদ্দেশ্য সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য মানুষ হত্যা ছাড়াও স্বাধীনতার ঊষালগ্নে ঢাকাসহ সারা দেশে জঘন্য হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয় এই ঘাতক বাহিনী। অবশ্য জামাত এখন আর এ কথা স্বীকার করে না। বরং ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘আজকের কাগজ’-এ তৎকালীন জামাতের সেক্রেটারি জেনারেল মওলানা নিজামী দাবি করেন যে, ‘জামাত নয়, আওয়ামী লীগই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে’ (দৈনিক আজকের কাগজ, ১৫.১২.৯১)।

এরকম প্রমাণ অনেক দেয়া যাবে।
‘বদর দিবস : পাকিস্তান ও আল-বদর’ শিরোনামে নিজামী তার লেখায় বলেন যে, ‘আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে পাক সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় এদেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ সমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আল-বদর বাহিনী গঠন করেছে। বদর যুদ্ধে মুসলিম যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল তিন শত তের। এই স্মৃতিকে অবলম্বন করে তারাও ৩১৩ জন যুবকের সমন্বয়ে এই ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের বিশ্বাস সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয় যেদিন আল-বদরের তরুণ যুবকরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হিন্দুস্তানের অস্তিত্বকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের পতাকা উড্ডয়ন করবে।

আর সেদিনই পূরণ হবে বিশ্ব মুসলমানদের অপূর্ণ আকাক্সক্ষা’ (দৈনিক সংগ্রাম, ১৪-১১-১৯৭১)।
৭১ এর ডিসেম্বরের ৩ তারিখে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলে নিজামী ও তার সুযোগ্য সহকর্মী মুজাহিদও পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার শেষ প্রচেষ্টা চালান। ১, ৩, ৪ ডিসেম্বর পর পর তিন দিন ছাপা হয় দৈনিক সংগ্রামে নিজামীর ‘হিন্দুস্তানি হামলার পটভূমি ও আমাদের দায়িত্ব’ শীর্ষক নিবন্ধ। ৪ ডিসেম্বর সে নিবন্ধে লেখে, তথাকথিত স্বাধীন বাংলা আন্দোলনের নামে ভারতের পোষ্যপুত্ররা (স্বাধীনতাকামী ও মুক্তিযোদ্ধা) ৫৪ হাজার বর্গমাইলের এই ভূখ- পূর্ব-পাকিস্তানকে কৌশলে ভারতের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল। সহজে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় এবার ভারত ভেতরে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে এবং বাইরে থেকে সর্বাত্মক হামলা চালিয়ে পূর্ব-পাকিস্তানকে গ্রাস করার শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে’ (দৈনিক সংগ্রাম, ৪-১২-৭১)।

একই দিনে হানাদার হিন্দুস্তানি বাহিনীর হামলার দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার জন্য মুজাহিদ পাকিস্তানি বাহিনীকে অভিনন্দন জানান। তিনি পাকিস্তান সরকারকে প্রতিশ্রুতি দেন, ছাত্র সমাজ ইস্পাতকঠিন শপথ নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর পাশাপাশি লড়ে যাবে। (দৈনিক সংগ্রাম, ৫-১২-৭১)।
কাদের মোল্লাকে যারা তাদের আলোর বাতিঘর বলছে, এরা কারা? কী তাদের আসল পরিচয়? কখনো ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার, কখনো রাজাকারদের এজেন্টদের কেউ কেউ এখন নিউইয়র্কে। এরা আবার সাংবাদিকদেরও মুরব্বি।

কী দুর্ভাগ্যজনক এই অভিবাসী সমাজের। ছি! এসব প্রতিক্রিয়াশীলদের নসিহত আর মিথ্যে সাক্ষ্যবাণীও আমাদের শুনতে হচ্ছে! একই অবস্থা বাংলাদেশেও। প্রেসক্লাব, আইনজীবী সমিতি, শিক্ষক সমিতি, প্রকৌশলী সমিতি, চিকিৎসক সমিতিসহ উচ্চ আয়ের পেশাজীবীদের কেউ কেউ যখন মহান স্বাধীনতার মূল্যবোধকে প“লিত করে মিথ্যার বেসাতি ছড়ানÑ তখন সাধারণ মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত না হয়ে পারে না।
এই প্রজন্মের মাঝে স্বাধীনতার প্রকৃত মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা তাই আজ জরুরি বিষয়। নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত না হলে দেশপ্রেম প্রতিষ্ঠা হয় না।

আর দেশপ্রেম প্রতিষ্ঠিত না হলে দেশের কল্যাণে কাজ করার মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল। স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু পরাজয়ের মৌন ধারাবাহিকতায় ক্রমশ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে সেই স্বপ্নসৌধ। বলতে দ্বিধা নেই যদি একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক নেতা কিংবা নেত্রী কঠোর হয়ে বাংলাদেশের হাল ধরতেন তবে আজকের প্রেক্ষাপট ভিন্ন রকম হতো।

শেখ মুজিব সেই পথই দেখিয়েছিলেন জাতিকে। বাঙালির সামনে এখন আর বিশেষ কোনো স্বপ্ন গন্তব্য নেই। শুধু আছে একটি পরিশুদ্ধ, ইতিহাস অন্বেষী প্রজন্ম গঠনের প্রত্যয়। যারা সত্যের ওপর শক্তিশালী বুক নিয়ে দাঁড়াবে। বাঙালি জাতি যদি এই স্বপ্নটি পূরণেও ব্যর্থ হয় তবে জাতির যাযাবরত্ব আরো দীর্ঘায়িত হতে পারে।

স্বপ্ন এখন একটিই এই প্রজন্ম জাগবে। সেই জাগ্রত বিবেকই শাণিত করবে আমাদের জাতীয়তাবাদের একান্ত অহঙ্কার।
----------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ // ঢাকা '' : ২২/মার্চ/২০১৪ শনিবার
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.