আজ থেকে এক যুগ আগের কথা বলছি। হ্যা এক যুগ। সাল ২০০২। চুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা। প্রথম দেখাতেই চুয়েটের গোলচত্বর জায়গাটা আমার খুবই ভাল লেগে গেলো।
কী সুন্দর গোলগাল একখানি চত্বর! ভালো লাগার প্রধান কারণ ছিল অবশ্য ক্যান্টিনের চা। আমি বাংলাদেশের কোথাও গিয়েছি কিন্তু চা খাই নাই এই কথা আমার ছায়াও বলতে পারবে না। তাই ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে আমি আর আমার বাবা সিধা ক্যান্টিনে ঢুকে চা পুরী খেয়ে ফেললাম। আর কবে আসব না আসব তা কে বলতে পারে। যে পরীক্ষা দিলাম, চুয়েটের ছায়াই আর এই জীবনে মাড়াতে হয় কিনা সন্দেহ!
আমার সন্দেহে পানি ঢেলে দিয়ে আর কৃতার্থদের তালিকায় চুন কালি মেখে আমার নামখানি সেই তালিকায় উঠে গেলো।
এক ধাক্কায় চুয়েটেরই পুরাকৌশল (কেউ বিশ্বাস করে না আমার প্রথম পছন্দ পুরাকৌশল ছিল বললে )। শুরু হল আমার চুয়েট জীবন।
সেই আমলে মেয়েদের হলে কোন ক্যান্টিন ছিল না। ডাইনিং ছিল খালাদের হাতে; খাবারের দোকান বলতে বাচা বাবা, ক্যান্টিন আর ক্যান্টিনের পিছনের একটা দোকান (নাম মনে নাই)। প্রথম দিন সকাল ৯টায় ক্লাস।
আমিসহ অন্য কোন নতুন মেয়ের কাছে সকালে খাওয়ার জন্য কিছু নাই। যাওবা ছিল আগের রাতে ডাইনিং এর নমুনা দেখে নম নম করতে করতে এর ওর থেকে যা পেয়েছি তাই উদরস্থ করে রাত কাবার করেছি। তাই এই সাতসকালে আমি সবাইকে প্রস্তাব দিলাম, চল ক্যান্টিনে যাই। বরাবরের মত আমি যাই প্রস্তাব করি, তাতেই সাকুল্যে ২/৩ দিন জন পাওয়া যায়; এবারো তার ব্যাতিক্রম হল না। তো সাকুল্যে আমরা ২-৩ জনই রওনা হলাম।
চা কেক খেয়ে মহারাজাকে ঠাণ্ডা করে ক্লাসে চলে গেলাম। সামান্য এই ঘটনা যে ২০০৩ সালে ইতিহাস হতে পারে, তা বুঝতে আমার আরও অনেক দিন লেগেছিল। পরের দিন সকালে ৪/৫ জন অভিভাবিকা আমাদের দরজায় হাজির। আমাদেরকে মানে আমরা যারা ক্যান্টিনে কেক খাই। তাদেরকে আমাদের কেক এনে দিতে হবে।
আমি তিন লাফ দিয়ে বললাম, “খালাম্মা, আপনারাও চলেন আমাদের সাথে। ” কিন্তু কিছুতেই তাঁদেরকে রাজি করাতে পারলাম না। তাঁদেরকে খাওয়া এখানে এনে দিতে হবে। তাঁরা গিয়ে খেয়ে আসবেন না। মহাফাঁপর!
হাজার বুঝানোর চেষ্টা করলাম, বললাম ওখানে সব মানুষেরাই খাওয়া দাওয়া করে, কোন হিংস্র প্রাণি না।
কে শোনে কার কথা? মেয়েরা যে (তখনো সেই রকমভাবে) ক্যান্টিনে যায় না, আমরা গুটিকয়েক মেয়ে বাদে সব মেয়ে কি করে জানি জেনে বসে আছে। আর আমাদের জানতে পুরো সেমিস্টার লেগেছিল! এখন মনে হয় কখনো না জানলেই বোধহয় ভাল ছিল।
ভিনদেশে বসে আজকে আমি যখন চুয়েটের এখনকার পরিস্থিতি দেখি, তখন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। এই কষ্টটুকু আমি অবশ্য সানন্দে উপভোগ করি। এত পরিবর্তন, এত সুন্দর পরিবেশ দেখে এক অদ্ভুত আনন্দ হয়।
আবার এও বুঝি যে আজ থেকে ১০ বছর পর কেউবা হয়ত আজকের অবস্থানটাকেই মেনে নিতে চাইবে না বা বিশ্বাস করতে পারবে না। তবুও বলতে হয়, সেই সময় আমাদের চাওয়াটা আকাশ-কুসুম কিছু ছিল না। আমরা সারারাত খোলা আকাশের নীচে শুয়ে তারা গুণতে চাইনি, চাইনি ছেলেদের সাথে কাঁঠাল চুরি করতে বা ক্রিকেট খেলতে! আমরা শুধু একটু প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছিলাম। জানি, নিঃশ্বাসের সংজ্ঞা সবার কাছে, সব যুগে এক নয়।
মাঝে মাঝে তাই মনে হয়, আসলেই নারী দিবসের কোন দরকার আছে কি? মাসকয়েক আগে একটি সেমিনারে যোগ দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা কয়েকজন ইতালি গিয়েছিলাম।
তো এক রাতে ডিনার করার সময় এক জার্মান ছেলে, যে কিনা বর্তমানে গবেষণার জন্য সুইজারল্যান্ডে থাকে, আমার কাছে আমার “জার্মান-জীবন” সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল। তার নিজের বিদেশে থেকে থেকে এখন মনে হয়েছে, জার্মান জাতিটা এত কাঠখোট্টা না হলেও পারত বোধহয়। তো তার মাতৃভূমিতে আমার কেমন লাগছে? আমি এক সেকেন্ডও চিন্তা না করে বললাম, "জোসেফ, রাত তিনটা বাজে নির্জন রাস্তায় নিওন আলোতে নির্দ্বিধায় নির্ভয়ে হাঁটার যে কি আনন্দ তা আমি জার্মানিতে এসে পেয়েছি। এর বেশি কিছু ভাবার অবকাশ এখনো হয়ে উঠেনি। " এক মাস পর জোসেফ আমার কাছে স্বীকার করেছে, সে এভাবে কখনো ভেবে দেখেনি।
এখনো তাই কোন মধ্যরাতে স্টুডেন্টডরমের ছোট্ট কামরা থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি “নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়!”
থাকুক না নারী দিবস ততদিন, যতদিন না আকাশটা সবার জন্য বড় হয়।
শুভ হোক সকলের পথ চলা!
আরও পড়তে চাইলেঃ http://bsaagweb.de/bsaag-magazine-march-2014/
উপরের লিঙ্কে দেখতে না পারলে: http://goo.gl/84PPE
সকল নারীর প্রতি সম্মানার্থে আমরা এবারের ম্যাগাজিন জার্মান প্রবাসে সাজিয়েছি শুধুমাত্র নারীদের লেখা দিয়ে। জার্মানিতে অবস্থানরত নারীদের মধ্যে অনেকেই বহু বছর যাবৎ জার্মানিতে অবস্থান করছেন, নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজের মাধ্যমে সুনাম অর্জন করেছেন আবার কেউ বা সদ্য পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু বিসাগের প্ল্যাটফর্মে তাঁদের পদচারণা তুলনামুলকভাবে অনেক ক্ষীণ। তাই আমাদের চেষ্টা তাঁদের চোখ দিয়ে আরেকবার জার্মানিকে আপনার কাছে তুলে ধরা।
জার্মান প্রবাসে – নারী দিবস বিশেষ সংখ্যা – মার্চ, ২০১৪
# পড়ুন "জার্মান প্রবাসে" – নারী দিবস বিশেষ সংখ্যা – মার্চ, ২০১৪! http://bsaagweb.de/bsaag-magazine-march-2014/
#ফেসবুকে আমরা - জার্মান প্রবাসে- http://goo.gl/EW4qBH
একটু পড়ে যদি রিভিউ দেন তাহলে অশেষ উপকার হয়। আর কি কি যোগ করা যায় তাও জানাতে পারেন আমাদের। আপনার একটা চাওয়া, একটা মন্তব্য অথবা আপনার কোন অভিজ্ঞতা ভাগ করুন না আমাদের সাথে! চটজলদি লেখা পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়ঃ german.probashe@gmail.com
অসংখ্য ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন সবাই!।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।