আমার লেখা ছাপানোর দিন ছিল বুধবার। পঞ্জিকা অনুযায়ী সেদিন ২৬ মার্চ। স্বাধীনতা দিবস। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সালাহউদ্দীন রাজ্জাক বলেছিল স্বাধীনতা দিবসের উপরে লিখতে। আমি রাজি হইনি।
ইতিহাসে 'দিবস'-এর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু তবুও সময়ের বিবর্তনে দিনগুলো বিবর্ণ হয়ে যায়। নতুন নতুন বিষয় সামনে চলে আসে। নতুন নতুন ঘটনা, নতুন নতুন সমস্যা। তখন পুরনো দিনের কথা বলতে গেলে চর্বিত চর্বণ হয়।
আমি তাই এই দিবস নিয়ে লিখতে চাইনি। কিন্তু নির্দিষ্ট দিন ২৬ মার্চ আমার মনে হলো লেখা উচিত।
২৬ মার্চ সকালে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে পুষ্পার্ঘ্য দিতে আমি সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলাম। আমি যখন উদ্যানে প্রবেশ করি তখন সকাল প্রায় ১০টা। আমার সংগঠন নাগরিক ঐক্যের নেতা-কর্মীদের নিয়ে বাস আসতে সময় লেগেছিল।
আগের রাতেই আমি সাভার পৌঁছেছিলাম। তাদের সঙ্গে নিয়ে যখন ভেতরে ঢুকেছি তখন একটু অবাকই হলাম। অন্যান্য বারের তুলনায় এবার জায়গাটা বেশ ফাঁকা। তখন মনে পড়ল এখন লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাইতে প্যারেড গ্রাউন্ডে জমা হয়েছে। সাভারের ভিড় কিছুটা হলেও তো কম হবে।
কি অদ্ভুত সুন্দর না। এই যে সবচেয়ে বড় মানব পতাকা নির্মাণ, সবচেয়ে বেশি কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়া! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাথায় যে কত বুদ্ধি খেলে। এই ৪৩ বছরে এরকম করে আর কেউ ভাবেনি। ভাবনাটা প্রধানমন্ত্রীর মাথা থেকেই এসেছে নাকি আর কেউ তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে তা জানি না। কিন্তু ভাবনাটা যে অভিনব তা বলতে হবে।
তিন লাখ মানুষ একসঙ্গে জাতীয় সংগীত গাওয়া এটা একটি অভিনব ব্যাপার তো বটেই। অতি সুন্দর অনুভবের একটি প্রকাশ এর মধ্যে থাকতেই পারে। কিন্তু এই উদ্যোগ, এই অনুষ্ঠান নিয়ে কথা উঠেছে।
জাতীয় স্মৃতিসৌধের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসেছিলাম আমরা। আনিসুর রহমান মুন্না, ডা. ইয়াসিন প্রমুখ ছিল প্রধান উদ্যোক্তা।
চা খেতে খেতে লাখো কণ্ঠ নিয়ে কথা উঠল। স্থানীয়রা বললেন, সাভারের গার্মেন্ট থেকে শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে। স্কুল-কলেজের শিক্ষক-ছাত্রদের যাওয়ার জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা তো হতেই হবে। না হলে ৫০ কোটি টাকার খরচ হবে কিসে।
অথচ পাখি যেমন মনের সুখে গান গায়, দোয়েল শীষ দেয়, জাতীয় সংগীত তো মানুষ গাইবে নিজস্ব স্বতঃস্ফূর্ততায়। সেই স্বতঃস্ফূর্ততা তৈরিতে তাকে বাস্তবে রূপ দিতে সরকারি প্রচারণা-অনুপ্রেরণা থাকলে সেটা অভিনন্দন পাওয়ার মতোই ব্যাপার। কিন্তু না এখানে ব্যাপারটা তা ছিল না। কারণ টার্গেটটাই ছিল গিনেস বুকে বিশ্বরেকর্ডে জায়গা করে নেওয়া। সরকার টার্গেট করেছিল তিন লাখ মানুষকে একাট্টা করার।
কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। জাতীয় সংগীত গাইতে সেখানে যান্ত্রিক গণনা অনুযায়ী লোক হয়েছিল ২৫৪৬৮১ জন। আর সেই সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দিতে গিয়ে বললেন, এই গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রাখলাম।
যারা ওখানে গিয়ে গান গেয়েছেন তারা সবাই কেবল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেখানে গেছেন নাকি তাড়িত হয়ে গেছেন সে প্রশ্ন তুলছি না। কিন্তু যারা যাননি তাই বলে তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে তাও নয়।
কারণ পত্রিকায় লিখেছে, ইলেকট্রনিক মিডিয়া বলেছে বিশ্বরেকর্ড গড়তে এই আয়োজন। এই রেকর্ড গড়া নিয়েই কথা উঠেছে। 'সাপ্তাহিক'-এর সম্পাদক গোলাম মোর্তুজা তার ফেসবুকে লিখেছেন, 'প্রাণপ্রিয় জাতীয় সংগীত গাওয়া, সবাই মিলে গাওয়া, লাখ লাখ মানুষ মিলে গাওয়া_ ভালো লাগার, ভালোবাসার, আনন্দের। কিন্তু একটি রাষ্ট্রের গিনেসের পেছনে ছোটাটা বড়ই বেমানান। ১. কয়েক দিন আগে আমরা জাতীয় পতাকা তৈরি করে গিনেস বুকে স্থান পেয়েছিলাম, সেটা যে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানিরা ভেঙে দিয়েছে সেই তথ্য কি আমরা জানি! ২. তিন লাখ মানুষ জাতীয় সংগীত গেয়ে যে রেকর্ড আমরা করতে যাচ্ছি, ভারত, চীন এমনকি পাকিস্তানও যে কোনো মুহূর্তে এই রেকর্ড ভেঙে দিতে পারে।
৩. যে রেকর্ড করার জন্য কোনো যোগ্যতা লাগে না, সেই রেকর্ডের পেছনে এত সময় শ্রম, অর্থব্যয় করাটা হাস্যকর ব্যাপার। এত হৈচৈ করাটা রীতিমতো আহাম্মকের কাজ। ৪. জাতীয় সংগীত গাওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় চাঁদাবাজি এবং একদিনে ৫০ কোটি টাকা খরচ করাটা নিশ্চয় একটি রেকর্ড। এটা গিনেসে স্থান পেতে পারে। '
আমার সামনে টেবিলে পড়ে থাকার পত্রিকার প্রথম পাতায় লাখো কণ্ঠের ছবি।
সব নীল কামিজ পরা মেয়েদের ছবি। এরা কি সবাই স্কুল থেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এসেছে? একই রঙের কামিজ পরা এতগুলো মেয়ে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এদের প্রতি জাতির অঙ্গীকার কি? প্রধানমন্ত্রী তো তাদের ভবিষ্যতের কথা কিছু বললেন না। প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা ভরা এ অনুষ্ঠানে এই ছাত্রীরা হয়তো কোনো মতে একটি খাবারের প্যাকেট পেয়েছে। অনেকে নাকি পায়ওনি।
বস্তির ওই খেটে খাওয়া কিশোর তো ওখানে জায়গা পায়নি। ওদের ডাকা হয়নি? ওদের জাতীয় সংগীত শেখার দরকার নেই? নিজের দেশের জন্য গান, জাতির জন্য গান, মুক্তিযুদ্ধের গান যেরকম করে সব লজ্জা সংকোচ বাদ দিয়ে গলা ছেড়ে বস্তির ওই ছেলেটি, কারখানার শ্রমিক কিংবা গ্রামের ক্ষেতমজুর কৃষক গাইতে পারবে সেরকম করে লেখাপড়া জানা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক কি গাইতে পারবেন? না, মধ্যবিত্তের সঙ্গে এই দরিদ্র মানুষের কোনো দ্বন্দ্বের কথা বলছি না। জানতে চাইছি এদের কথা কি ভাবা হয়েছিল। ৪৩ বছরের স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী এদের জন্য কোন্ ভিশনের কথা বললেন। ৫০ কোটি টাকা কিসে খরচ হলো? মানুষ তো তিন লাখ হয়নি।
ধরে নিলাম যে খাওয়ার প্যাকেট দেওয়া হয়েছিল সেগুলো প্রতিটির মূল্য ২০০ টাকা। ইসলামী ব্যাংকের টাকা ফেরত দেওয়ার নাটক করলেন কিন্তু ইবনে সিনা থেকে তো ফ্রি স্যালাইন নেওয়া হয়েছে। সে হিসাবে ৬ কোটি টাকার হিসাব পাই। বাকি টাকা কোথায় খরচ হয়েছে সেটি কি আমরা কোনো দিন জানতে পারব? কথাগুলো মনের মধ্যে বাজছে। আমেরিকাতে আমার এক ফেসবুক ফ্রেন্ড আছেন।
কৃস্টিনা রোজারিও। আমেরিকান নন, বাঙালি। এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। এখন আমেরিকাতেই সেটেল। গতকাল দুপুরে তিনি আমার চ্যাট অপশনে এসেছিলেন।
বাংলাদেশে তার প্রজেক্ট আছে। তাদের হিসাবে বাংলাদেশে ঠোঁট কাটা রোগীর পরিমাণ আড়াই লাখের বেশি। তিনি এই ঠোঁট কাটা রোগীদের ঠোঁট জোড়া লাগানোর কাজ করেন। নিজে ডাক্তার নন, কিন্তু আমেরিকান কিছু ডাক্তার বন্ধু ও সার্জেন্ট আছেন তাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসেন নিজেদের খরচে। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র নিজেরা কিনে আনেন।
প্রতি বছর ৫০০ রোগীর ঠোঁট জোড়া লাগান। এ মাসেই একবার এসেছিলেন। এবার কামারপাড়ার ইস্টওয়েস্ট মেডিকেল কলেজের সঙ্গে যৌথভাবে এই কার্য পরিচালনা করেছেন।
১৮ তারিখে নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জাকিয়া বিথীসহ আমি এই অপারেশন দেখতে গিয়েছিলাম। এক কথায় বলব, আমি মুগ্ধ হয়েছি।
আমেরিকান দুজন সার্জেন্ট ছিলেন, তাদের সঙ্গেও কথা বললাম। এদের আগের পুরুষ ভারতে বা বাংলাদেশে ছিলেন। কেউই বাংলা বলতে পারেন না। কিন্তু বললেন বাংলাদেশকে খুব পছন্দ তাদের। নিজেরা প্লেনের টিকিট কেটে আসেন, নিজের খরচে ঢাকার কোনো মাঝারি মানের হোটেলে থাকেন।
গ্রামে যান, সেখানে যে অবস্থা পান সেভাবেই থাকেন। আবারও ধন্যবাদ জানালাম।
কৃস্টিনা আমাকে বললেন, শুধু ধন্যবাদে চলবে না মান্না ভাই। আপনি তো অনেক মানুষ চেনেন। বলুন না তাদের আমাদের এই কাজে সাহায্যের হাত বাড়াতে।
আমি কি সাহায্য করব। নেহাতই মধ্যবিত্ত মানুষ আমি। নিজের সংগঠন চালাতেই হাবুডুবু খাই। তবুও পাঠকবৃন্দ কৃস্টিনার কথা আপনাদের বললাম আমি। যদি পারেন সাহায্য করবেন।
কৃস্টিনা আমাকে ফেসবুকে বললেন, আপনাদের স্বাধীনতা দিবস। আমার এখানে মধ্যরাত। হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেল। ৫০ কোটি টাকা খরচ করছেন একটি গানের পেছনে? রেকর্ড গড়তে? আমি যদি পেতাম বাংলাদেশের সব লোকের কাটা ঠোঁট জোড়া লাগিয়ে দিতাম। ওরা হাসত।
পাঠকবৃন্দ কৃস্টিনাদের প্রজেক্টের নাম SMILE।
আবার গোলাম মোর্তুজার কথায় আসি। মোর্তুজা তার স্ট্যাটাচে লিখেছেন ৫. লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত, ৫০ কোটি টাকার এই কাজটি করছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। 'ফোরথট পিআর' নামক যে প্রতিষ্ঠানকে এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে ৬. মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
৬. এই 'ফোরথট পিআর' বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী ঘৃণিত। এশিয়া এনার্জির পিআর প্রতিষ্ঠান! ৭. রাজনীতিতে নির্বাচনে, জনগণ-জনগণের ভোট যখন প্রয়োজন হয় না, তখন যা ইচ্ছে অন্যায়-অনৈতিকতা করা যায়। বর্তমানে যার প্রতিযোগিতা চলছে।
মোর্তুজার এই স্ট্যাটাচ সম্পর্কে নিশ্চয় সংস্কৃতিমন্ত্রী বা মন্ত্রণালয় এতক্ষণে জেনে গেছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান অভিযোগ করেছেন, এই অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের উপেক্ষা করা হয়েছে। অনুষ্ঠানটি করা উচিত ছিল মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু সেটি করল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। সে ব্যাপারেও প্রশ্ন রেখেছেন।
আমি বলেছি, লাখো কণ্ঠের উদ্যোগটা ছিল অভিনব।
কিন্তু সেটাকেও করা হলো প্রশ্নবিদ্ধ।
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য
ই-মেইল :mrmanna.bd@gmail.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।