আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রক্তাক্ত ভোট : সিইসির আলহামদুলিল্লাহ্!

উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থ ধাপ শেষে লীগ মহল ছাড়া সর্বত্রই একটা ছিঃ ছিঃ রব উঠেছে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও। উৎসবের নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে দ্বিতীয় ধাপ নির্বাচনের পরই। সব দলের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনের ফলাফল স্পষ্টতই কোনো একটি দল বা জোটের জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থনের মাপকাঠি বলে বিবেচিত হয়। ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রেও তাই।

সেই হিসেবে উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ফলাফল প্রমাণ করে, ক্ষমতাসীন লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের চেয়ে বিএনপি-জামায়াতের ১৯ দলীয় জোট অধিক জনপ্রিয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জনসমর্থন বেশি। উপজেলা নির্বাচন স্থানীয় সরকার নির্বাচন হিসেবে যদিওবা নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, কিন্তু এ পর্যন্ত আমাদের দেশে স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও নির্দলীয়ভাবে হতে দেখা যায় না। নিয়ন্ত্রণ করার যথেষ্ট আইনি ক্ষমতা থাকার পরও সব সরকারের আমলেই মেরুদণ্ডহীন থাকার কারণে কোনো নির্বাচন কমিশনই তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে রুষ্ট করতে চায়নি। ফলে দিন দিন এই স্থানীয় সরকার নির্বাচন তার নির্দলীয় চরিত্র সম্পূর্ণই হারিয়ে বসেছে।

একটি মসজিদ কমিটির নির্বাচনেও এখন দলগত বিভাজন প্রকট হয়ে দেখা দেয়। সেখানেও আসে দলের প্রধান নেতা-নেত্রীর নাম। ভোটযুদ্ধ যেন প্রার্থী-প্রার্থীতে নয়, এই যুদ্ধ যেন হয় মুজিব-জিয়ার বা খালেদা-হাসিনার। বলতেই হবে, প্রথম দুই ধাপ উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির কাছে আওয়ামী লীগ এবং বেগম জিয়ার কাছে শেখ হাসিনা হেরেছেন। কোথাও কোথাও কেন্দ্র দখল ব্যালট ছিনতাই, প্রকাশ্যে সিল মারামারির 'উৎসব' না হলে আসন ও ভোটের ব্যবধান হতো আরও বেশি।

সমালোচকরা বলেন, নীরব বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের 'থোঁতা মুখ ভোঁতা' করে দিয়েছে জনগণ। সেই ভরাডুবিতে দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা যখন দারুণভাবে হতাশ হয়ে পড়ে, তাদের মধ্যে যখন নেতিয়ে পড়ার ভাব, তখন তাদের নীতিনির্ধারকদের কপালেও ভাঁজ পড়ে যায়। আর তখনই বোধহয় তারা সিদ্ধান্ত নেন মুখোশ খুলে ফেলার, স্বরূপে আত্দপ্রকাশ করার। লীগ নেতা ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ যখন বললেন, পরবর্তী ধাপসমূহের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ইনশাআল্লাহ ভালো করবে, সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ বেশি পাবে, এগিয়ে যাবে; সাধারণ ভোটার ও শান্তিপ্রিয় জনগণের আত্দা তখনই কেঁপে ওঠে। তোফায়েল আহমেদের ইনশাআল্লাহর পর তৃতীয় ধাপ নির্বাচন শেষে আরেক লীগ নীতিনির্ধারক ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যখন বললেন, আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াতে জানে, তাতে বোঝা গেছে তাদের ইঞ্জিনিয়ারিং, 'অপারেশন' সাকসেসফুল।

ফলাফলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে তিনি যেন বললেন, মাশাআল্লাহ্! ওবায়দুল কাদের সাহেবের 'মাশাআল্লাহ' ভাব প্রকাশের পর তৃতীয় ধাপে নির্বাচনের নামে অনেক উপজেলায় যে অনিয়ম, অনাচার ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে তার প্রতি আমরা একটু নজর দিতে পারি। দেশের সব প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হয়েছে শাসকলীগ সমর্থিত প্রার্থীর লোকজনের নির্লজ্জ তাণ্ডবচিত্র। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনেও অনিয়ম হয়েছে। প্রথম ধাপে অনিয়ম হয়েছে ৬৫ ভোটকেন্দ্রে। এসব কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ছিনতাই, কেন্দ্র দখল, জাল ভোট ও বিচ্ছিন্ন কিছু সংঘর্ষ হলেও বড় ধরনের কোনো সহিংসতা ঘটেনি।

তাতে বিএনপি পেয়েছিল ৪৫ চেয়ারম্যান আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩৪। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে অনিয়ম প্রথম দফার ৬৫টি থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১০০। ব্যালট পেপার ছিনতাই, জাল ভোট, কেন্দ্র দখল, প্রার্থীর ওপর হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে বেশি। তারপরও ১১৬ উপজেলার ফলাফলে বিএনপি পায় ৫২, আওয়ামী লীগ পায় ৪৬। তৃতীয় ধাপ থেকে অনিয়ম ও সহিংসতা অনেক বেড়ে যায়।

শাসক লীগের প্রার্থী, কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ফুটে ওঠে বেপরোয়া ভাব। এ দফায় অনিয়ম হয় ২০০ কেন্দ্রে। এতে নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। শুধু ব্যালট ছিনতাই, কেন্দ্র দখল করে জাল ভোটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না অনিয়ম-অনাচার। কোথাও কোথাও ছড়িয়ে পড়ে সংঘাত।

১৬ মার্চ বাংলাদেশ প্রতিদিনের পাতায় ফুটে ওঠে সে দিনের কিছু প্রকৃত চিত্র। তাতে লেখা হয়, 'ব্যালেট পেপার ছিনতাই, প্রতিপক্ষের এজেন্ট কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে সিল মারা, বোমা বিস্ফোরণ, গুলি, সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে তৃতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচন। এসব ঘটনায় তিনজন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। বেশির ভাগ কেন্দ্রে দাপট ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের। মূলত তারাই কেন্দ্র দখল ও ব্যালট ছিনতাই করে সিল মারার চেষ্টা চালান।

' নির্বাচন পরিস্থিতিটা তৃতীয় ধাপ থেকেই বেশি খারাপের দিকে চলে যায়। সহিংসতার মাত্রাও বাড়ে। প্রথম দুই ধাপ নির্বাচনে শাসকলীগ খারাপ করলেও তৃতীয় ধাপ থেকে তাদের পালে যেন 'নতুন হাওয়া' লাগে। আলাদীনের জাদুর চেরাগ যেন তাদের হাতে চলে আসে। তাদের এই সাফল্যের (?) পেছনে যে শক্তি প্রয়োগের প্রভাব আছে তা বলাই বাহুল্য।

প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া সব ফাঁস করে দিয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ১৫ মার্চ অনুষ্ঠিত তৃতীয় ধাপ নির্বাচনে ব্যাপক ভোট জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও নির্বাচন কমিশন রহস্যজনকভাবে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। প্রশাসনের সমর্থনেই সরকার সমর্থিত প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা নির্বিঘ্নে ভোট কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মেরেছেন। নির্বাচন কমিশনের বিতর্কিত আচরণের কঠোর সমালোচনা করে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমদ বলেছেন, 'স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেই পুরনো ভোট জালিয়াতি ও শক্তি-প্রয়োগের সংস্কৃতি ফিরে এসেছে। প্রশাসনের পাহারায় সরকারি দলের কর্মী-সমর্থকরা ব্যালট ছিনতাই করছেন, বুথ দখল করে সিল মারছেন_ এসব খরব পত্র-পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে, অথচ নির্বাচন কমিশন নীরব থেকেছে।

তাদের ওই নীরবতা চলমান উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের পরিবেশকে সহিংস করে তুলেছে। ' তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে পেছনে ফেলে যায়। তারা পায় ৩৭ চেয়ারম্যান আর বিএনপি পায় ২৬। এক ধাপে এগিয়ে গেলেও তিন ধাপ মিলিয়ে বিএনপি থেকে ৬ চেয়ারম্যান কম পায় আওয়ামী লীগ। তারা পায় ১১৭ জন আর বিএনপি পায় ১২৩ জন।

তৃতীয় দফা নির্বাচনে সংঘাত-সংঘর্ষে ৩ জন নিহত হওয়া এবং এত অনিয়মের পরও সরকারি 'কলের গানে' বাজল উল্টো সুর। আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা একজন এইচটি ইমাম বলেন, নির্বাচন 'অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে'। তার ওই বক্তব্যে অবশ্যই বোঝা গেছে, পরবর্তী ধাপের নির্বাচনসমূহ 'আরও অবাধ ও সুষ্ঠু' করার দায়িত্ব তারা পালন করবেন! মনে হয় তারা সেটা করেও চলেছেন। বিএনপিকে যে তাদের পেছনে ফেলতে হবে! দেশ-দুনিয়ায় তাদের দেখাতে হবে না তারা বিএনপি থেকে কত জনপ্রিয়! খালেদা জিয়ার চেয়ে তাদের নেত্রী শেখ হাসিনার নামে দেশের মানুষ কত পাগল! এটা প্রমাণ করতে গিয়ে চতুর্থ ধাপ নির্বাচনে তাদের রাজনৈতিক শরীর প্রায় 'উলঙ্গই' হয়ে গেল। সেই নির্বাচন নিয়ে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দৈনিকগুলোর শিরোনাম হলো_ 'কেন্দ্র দখলের নির্বিঘ্ন উৎসব', বাংলাদেশ প্রতিদিন লিখল 'দখল, গুলি, সংঘাতে নিহত ৪'।

পত্রিকাটি লিখেছে, 'ভাবনাতীত অনিয়ম, কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই, গুলি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ভোট বর্জন ও গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে চতুর্থ দফা উপজেলা নির্বাচন। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত চারজন। সারা দেশে গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন তিন শতাধিক। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ' দৈনিক মানবজমিন তো শিরোনাম দিয়েছে 'রক্তাক্ত ভোট'।

চতুর্থ দফা উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতা হয়েছে ৪০ উপজেলায়। এমন একটি খারাপ ও সহিংস নির্বাচনের পরও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম কী করে সন্তোষ প্রকাশ করলেন বোঝা গেল না। এত কিছুর পরও তিনি নির্বিকারভাবে বলছেন, 'আগের তিনটির চেয়ে এবারের নিবাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে'। তিনি যেন মনে মনে সুবহানাল্লাহ পড়লেন এমন একটি 'সুন্দর' নির্বাচনের জন্য। ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার তো আরও সরেস।

চুতর্থ দফায় নির্বাচনে তিনি এত উৎফুল্ল হয়েছেন, তার সন্তুষ্টির প্রকাশ ঘটেছে 'আলহামদুলিল্লাহ' ধ্বনি উচ্চারণের মাধ্যমে। দ্বিতীয় ধাপ নির্বাচন শেষে ফলাফলে বিবর্ণ আওয়ামী লীগের বিষণ্ন নেতা-মন্ত্রীদের উদ্দীপক কথাবার্তার অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দুর্বোধ্য নয়। এতে তাদের পরিকল্পনা এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু ঠিকঠাকভাবে হওয়ার অভিব্যক্তিই প্রকাশিত হয়েছে।

এ মুহূর্তে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠান খুব জরুরি ছিল না। একটু ভুল হিসাব-নিকাশ থেকেই সরকার উপজেলা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয় বলে ধারণা করা যায়।

এই নির্বাচনের মাধ্যমে শাসকলীগ ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশে-বিদেশে তাদের কাটা যাওয়া নাক-কান কিছুটা জোড়া লাগিয়ে শরম ঢাকতে চেয়েছিল। সেই নির্বাচন যে একটি নজিরবিহীন, বিরোধী দলের ভাষায় প্রহসনের নির্বাচন ছিল তার প্রমাণ তো ৩০০ আসনের সংসদের ১৫৩ আসনে কোনো নির্বাচনই না হওয়া। ১৫৩ জন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ২০ দিন আগেই অটো এমপি হয়ে গেছেন। 'আমরা আর মামুদের' মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে আসনগুলো। প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন যে, সমমনাদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে আসন ভাগাভাগি করে নেওয়ায় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি।

বিএনপি সমঝোতায় রাজি হলে তাদেরও কিছু আসন ছেড়ে দেওয়া হতো। বক্তব্যটা প্রায় এমনই ছিল। অথচ আমাদের সংবিধানের ৬৫ (২) অনুচ্ছেদ বলছে, 'একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিন শত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে (সংরক্ষিত আসনের ৫০ মহিলা সংসদ সদস্য) লইয়া সংসদ গঠিত হইবে : সদস্যগণ সংসদ সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন। ' সংবিধানের এই নির্দেশের মৌল চেতনা হচ্ছে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠিত হবে। কিন্তু সংবিধানের এই নির্দেশ উপেক্ষা করা হয়েছে।

নির্বাচনটি করিয়ে নেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ একতরফাভাবে। জনগণকে তাদের পছন্দের প্রার্থী বাছাইয়ের কোনো সুযোগই দেওয়া হয়নি। বাকি ১৪৭ আসনের নির্বাচনও ছিল নামকাওয়াস্তে ভোটারবিহীন নির্বাচন। দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ; ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, রাশিয়াসহ সমগ্র গণতান্ত্রিক বিশ্ব প্রত্যাখ্যান করেছে সেই নির্বাচন। প্রতিবেশী একটি দেশ এবং লীগ বেনিফিশিয়ারিরা ছাড়া আর কেউই নেই পক্ষে।

সরকার গঠনের পর রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক রক্ষার স্বার্থে সরকারপ্রধানকে রুটিনমাফিক অভিনন্দন জানালেও সবাই এখনো বলছেন তারা বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক আশু নির্বাচন চায়। গেল সপ্তাহে বাংলাদেশ সফররত ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট প্রতিনিধিরা বেশ জোরালোভাবেই এমন কথা বলে গেছেন। ব্রিটেনও পুনরায় একই অভিমত দিয়েছে। লীগ সরকার উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে এই বলে দেশি-বিদেশি চাপ প্রয়োগকারীদের নিবৃত্ত করতে চেয়েছিল যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে সরকার গঠন করত। তাদের ঘনিষ্ঠ কোনো বিদেশি মিত্র তাদের এই পরামর্শ দিয়ে থাকতে পারে।

আওয়ামী লীগের মতো তাদেরও বোধহয় এমন বিশ্বাস ছিল (আওয়ামী লীগ এমন ধারণা হয়তো দিয়ে থাকতে পারে), যেহেতু যে কোনো প্রকারেই হোক শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরকার গঠন করে ফেলেছেন, এলাকার উন্নয়ন, স্থিতিশীল পরিবেশ, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের লোভে শাসক লীগের প্রার্থীদের জনগণ ভোট দেবে। দুই বছর সহিংস আন্দোলনের কারণে জনগণ বিএনপি-জামায়াতের ওপর বিরক্ত বলেও তারা ধরে নিয়েছিল। কোনো কোনো সহিংস ঘটনায় এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনাশে যে জনগণ সরকারি বাহিনী ও দলকেই সন্দেহ করে এটা বোধহয় বুঝতে পারেনি তারা। তাদের হিসাব মেলেনি। ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের ফলাফলে লীগ নেতারা চোখে শর্ষে ফুল দেখতে থাকেন।

তাই নিজেদের শক্তি ও জনসমর্থন প্রমাণের জন্য তারা কদর্য পথ ধরেন। কিন্তু তাতে সরকার লাভবান হয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। যাদের কাছে জনসমর্থন ও জনপ্রিয়তা প্রমাণের জন্য দলীয় চেয়ারম্যান সংখ্যা তারা বাড়িয়ে নিচ্ছেন, তারা কি 'লীগ-গীতিতে' মজেছেন? স্বশরীরে সবাই এই নির্বাচন হয়তো পর্যবেক্ষণ করছেন না, তাই বলে এই নির্বাচনে কী হচ্ছে, জয় ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য সরকার ও সরকারি দল কী করছে তা কি তাদের কাছে গোপন থাকছে?

চতুর্থ দফা নির্বাচন শেষে বিএনপিকে পিছে হটিয়ে দিয়েছে শাসক লীগ। এখন তাদের ঝুড়িতে ১৬৮ আর বিএনপি ১৪৪। জামায়াত, এলডিপি ও অন্যান্য জোটভুক্তদের নিয়ে ১৯ দলীয় জোটের চেয়ারম্যান এখনো মহাজোট থেকে বেশি।

১৯ দলীয় জোটের ১৮০ আর মহাজেটের ১৭০। পঞ্চম দফা নির্বাচনে জোটগতভাবেও ১৯ দলকে এগিয়ে থাকতে দেবে সরকারি মহাজোট_ তা মনে হচ্ছে না। তারা পঞ্চম দফায় আরও নির্লজ্জ, আরও বেপরোয়া হয়ে যেতে পারে। তবে বিএনপি-জামায়াত যদি নির্বাচনী অনাচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে, পরিস্থিতি ভিন্নও হতে পারে। নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর সদস্যরা আন্তরিক ও সতর্ক না থাকলে শেষ দফা নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করা যাবে কিনা এখনই বলে দেওয়া যাবে না।

এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেছেন, 'পঞ্চম দফায় নির্বাচন অন্য রকমও হতে পারে। তবে নির্বাচনের ব্যাপারে মৌলিক বিষয় হলো_ নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে তা কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। সাধারণ মানুষের কাছেও না, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও না। এ ধরনের একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সৃষ্ট স্থানীয় সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তর উপজেলা পরিষদ কখনোই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে না। ' স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমদের একটি বক্তব্য এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য।

'উপজেলা নির্বাচনে হানাহানির সঙ্গে নির্বাচনী ফলাফলের একটি যোগসূত্র সৃষ্টি হওয়ায় মানুষ বুঝে নিয়েছে, জোর করে ভোটের ফল পাল্টানোর জন্যই এসব অনিয়ম, হানাহানি করা হচ্ছে। ' এরপর এই নির্বাচন নিয়ে আর কোনো কথা থাকে না।

সবশেষে দুটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি। (এক) জনপ্রিয়তা প্রমাণের পরীক্ষায় সরকার ফেল করেছে। জোরজবরদস্তি করে অন্যের বিজয় ছিনতাইয়ের মাধ্যমে বেশি উপজেলায় জিতলেও প্রকৃত বিজয়ের গৌরব তাদের কপালে জুটবে না।

সর্বসাধারণের ধারণা, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ৪৮৭ উপজেলার মধ্যে ১০০টিতেও শাসকলীগ সমর্থিত প্রার্থী জিতত কিনা সন্দেহ। (দুই) এই সত্য প্রমাণ হয়েছে যে, আওয়ামী লীগের সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অসম্ভব। এই নির্বাচন প্রমাণ করেছে, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল রেখে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে দশম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বেগম খালেদা জিয়া সঠিক কাজ করেছেন। আন্তর্জাতিক মহলও তা আরও ভালোভাবে বুঝল। দশম সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচন নিয়েও শেখ হাসিনার লীগ সরকার আরেকটি আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে পড়ল।

 

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : kazi.shiraz@yahoo.com

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।