ইউক্রেন-সংকটকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে রাশিয়া ও পুতিনের যে প্রবল একগুঁয়ে ছবি ফুটে উঠছে, তাতে মনে হয় সত্যিই নতুন এক স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। রাশিয়া যেন পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের হারানো জায়গাটা পুনরুদ্ধারে তৎপর হয়ে উঠেছে। ইউক্রেন ও পশ্চিমা দুনিয়ার প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে নিজের সঙ্গে সংযুক্ত করে নেওয়ার পর থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর খেপে গিয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার পাশাপাশি রাশিয়ার বিরুদ্ধে বহুমুখী অবরোধ-নিষেধাজ্ঞার জোর উদ্যোগ নিচ্ছেন দেখে মনে হচ্ছিল, দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে বুঝি শিগগিরই আর কোনো কথাবার্তা হবে না।
কিন্তু গত শুক্রবার ওবামা ও পুতিনের মধ্যে আবার টেলিফোনে কথা হলো। উভয় পক্ষ ইউক্রেন-সংকটের একটা কূটনৈতিক সমাধানের আশাবাদ ব্যক্ত করলেন।
তার ফল হলো বেশ ত্বরিত: মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি সৌদি আরব থেকে আমেরিকা ফেরার পথে আকাশেই সিদ্ধান্ত নিলেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে কথা বলবেন। লাভরভ তখন প্যারিসে। কেরি তাঁকে ফোন করলেন; দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে কথা হলো। তারপর কেরি বিমান ঘুরিয়ে সোজা গিয়ে নামলেন প্যারিসে। রোববার প্যারিসে রুশ রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে সের্গেই লাভরভের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হলো টানা চার ঘণ্টা ধরে।
কিন্তু ইউক্রেন-সংকট সমাধানের পথে এক ধাপও অগ্রগতি হলো না। কারণ, কোনো পক্ষই নিজ নিজ অবস্থান থেকে একটুও নড়েনি। বৈঠক শেষে লাভরভ সাংবাদিকদের বলেছেন, কেরির সঙ্গে বৈঠকে তিনি রাশিয়ার এই অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে, কিয়েভের পক্ষে আর পুরো ইউক্রেনকে একটি ঐক্যবদ্ধ একক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই সেটিকে এখন একটি ঢিলেঢালা ফেডারেল সরকারব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যেখানে দেশটির পূর্ব ও দক্ষিণ অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ রুশ জনগোষ্ঠী ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। আর জন কেরি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রাশিয়ার এই অবস্থানের ব্যাপারে তিনি লাভরভকে বলেছেন যে, এ বিষয়ে আলোচনায় ইউক্রেনের বৈধ সরকারকেও সঙ্গে নিতে হবে।
ইউক্রেন নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে সে ফেডারেল সরকারব্যবস্থা গ্রহণ করবে, নাকি যেমন কেন্দ্রশাসিত আছে তেমনই থাকবে। কেরি স্পষ্ট ভাষায় লাভরভকে জানিয়ে দিয়েছেন, ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে ইউক্রেন সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তের প্রতি আমেরিকা সমর্থন জানাবে না। কেরি লাভরভকে আরও জানিয়েছেন, রাশিয়া ক্রিমিয়াকে নিজের সঙ্গে যুক্ত করে নিয়ে অন্যায় করেছে—আমেরিকা এখনো এই অবস্থানে অনড় আছে। তিনি রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, ইউক্রেনের সীমান্ত বরাবর রাশিয়া যে সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে তা আর না বাড়িয়ে সব সেনাকে যেন ক্রিমিয়ায় রুশ ঘাঁটিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। কেরি অবশ্য সাংবাদিকদের এ কথাও স্পষ্ট করে বলেছেন, আমেরিকা ও রাশিয়া এখনো ইউক্রেন-সংকটের ‘কূটনৈতিক সমাধানে’র ব্যাপারে একমত আছে।
কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন, তাঁরা আগে থেকেই জানতেন যে প্যারিসে কেরি ও লাভরভের বৈঠক কার্যত ব্যর্থ হবে। এর কারণ মূলত রাশিয়ার দৃঢ় অবস্থান, আমেরিকা ও ইউরোপের সম্মিলিত চাপেও যা একটুও নমনীয় হয়নি। আমেরিকা রাশিয়ার সেনাবাহিনীর নড়াচড়াকে ভয় পাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, শুক্রবার পর্যন্ত ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া ৪০ হাজারের বেশি সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে। কিছু সংবাদমাধ্যমে লেখা হয়েছে, রাশিয়ার সেনাদের ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডের ভেতরেও পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বিশেষত ইউক্রেনের পূর্বাংশের কয়েকটি শহরে, যেখানে রুশ জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্য।
ওই সব সেনার কোনো সামরিক ব্যাজ থাকছে না, ফলে তাদের চেনা যাচ্ছে না তারা আসলে কোনো সেনাবাহিনীর সদস্য কি না। এ রকম ঘটনা ক্রিমিয়াতেও ঘটেছিল। ক্রিমিয়ায় গণভোটের আগেই পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে যখন খবর বেরোল যে রাশিয়ার সেনারা কার্যত ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, তখন রাশিয়া থেকে দাবি করা হচ্ছিল, তাদের কোনো সেনা ক্রিমিয়ায় প্রবেশ করেনি। সামরিক পোশাক পরা কিছু সশস্ত্র লোক, যাদের কোনো ব্যাজ ছিল না, পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে তাদের ‘অজ্ঞাতপরিচয় সশস্ত্র লোকজন’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছিল।
সের্গেই লাভরভ জন কেরিকে বলেছেন, ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর ইচ্ছা রাশিয়ার একেবারেই নেই।
ভ্লাদিমির পুতিনও টেলিফোনে বারাক ওবামাকে বলেছিলেন, রাশিয়া ইউক্রেন-সংকটের ‘কূটনৈতিক সমাধানে’ আগ্রহী। কিন্তু তাহলে ইউক্রেনের সীমান্ত বরাবর রাশিয়া এত বিপুলসংখ্যক সেনা সমাবেশ ঘটাচ্ছে কেন? আমেরিকা বা পশ্চিমের পক্ষ থেকে রাশিয়াকে এ রকম প্রশ্ন সরাসরি জিজ্ঞেস করা হয়েছে বলে খবর পাইনি। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে আমেরিকা ও ইউরোপ রাশিয়ার আরও সামরিক অগ্রসরমাণতা নিয়ে শঙ্কিত। আবার এমন শঙ্কার কি বাস্তব ভিত্তি থাকতে পারে, তাও বোধগম্য নয়। রাশিয়া কী অজুহাতে ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডের ভেতরে সেনা পাঠাতে পারে?
বরং ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়ার দূরপ্রসারী ভাবনার প্রকাশ ঘটে দেশটির কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে সেটিকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রস্তাবের মধ্যে।
রাশিয়া ইউক্রেনকে এমন একটি ফেডারেল রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়, যার প্রতিটি অঞ্চল হবে স্বায়ত্তশাসিত, তারা নিজ নিজ অর্থনীতি, করব্যবস্থা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভাষা এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ও আমদানি-রপ্তানির বিষয়গুলোতে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে। প্যারিসে লাভরভ এসব কথা কেরিকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে বলেছেন। তিনি এও বলেছেন যে ইউক্রেনে রুশ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যা, তাতে ইউক্রেনের ফেডারেল ব্যবস্থা প্রবর্তন ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই বলে মস্কো মনে করে।
রাশিয়ার এই প্রস্তাবের কথা শুনে কিয়েভের শাসকেরা প্রচণ্ড খেপে গেছেন। তাঁরা যখন ইউক্রেনে কেন্দ্রীয় শাসন আরও শক্তিশালী করতে চাইছেন, তখন সব অঞ্চলকে ব্যাপক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দিয়ে ঢিলেঢালা একটা ফেডারেল ব্যবস্থা প্রবর্তন করার প্রস্তাব যে তাঁরা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করবেন, এতে কোনোই সন্দেহ নেই।
এখন আমেরিকার প্রস্তাব অনুযায়ী ইউক্রেনের শাসনব্যবস্থা কী হবে, সেটা নিয়ে যদি একটা ত্রিপক্ষীয় আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়, এবং সেখানে রাশিয়া যদি ইউক্রেনকে রাখতে রাজি হয়, তাহলে সে আলোচনাও যে ফলপ্রসূ হবে না, তা আগে থেকেই অনুমান করা যায়। আবার আমেরিকা কিয়েভের যে শাসকদের ইউক্রেনের ‘বৈধ সরকার’ মনে করছে, রাশিয়া তাঁদের অবৈধ, সন্ত্রাসী বলে মনে করে, যাঁরা সহিংস পন্থায় ইউক্রেনের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করেছেন। সামনে মে মাসে ইউক্রেনে নতুন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা; কিন্তু রাশিয়া মনে করে ইয়ানুকোভিচ এখনো ইউক্রেনের বৈধ প্রেসিডেন্ট। সুতরাং মে মাসের নির্বাচনে ইউক্রেন একজন নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করলেও সেই প্রেসিডেন্টকে রাশিয়া স্বীকৃতি দেবে না। কারণ, যিনি প্রেসিডেন্ট হবেন, তিনি হবেন নিঃসন্দেহে একজন মস্কোবিরোধী।
সব মিলিয়ে ইউক্রেন-সংকট জটিলতর হয়ে উঠছে। এই জটিলতা সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়ার আশঙ্কাই বেশি; কারণ, ইউক্রেনের সামাজিক সংহতি ইতিমধ্যে ভেঙে পড়েছে, জাতিগত ঘৃণা-বিদ্বেষ ক্রমেই বাড়ছে। বেসামরিক মানুষের হাতে প্রচুর অস্ত্র আছে, উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো ক্রমেই আরও সহিংস হয়ে উঠছে। শান্তিশৃঙ্খলা ভেঙে পড়লে সংখ্যালঘু রুশ জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও মানবাধিকার রক্ষার অজুহাতে রাশিয়ার সেনাবাহিনী ঢুকে পড়লে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এবং তা যদি সত্যিই ঘটে, তাহলে ইউক্রেনের আরও অঙ্গহানির ঝুঁকি বাস্তব হয়ে উঠতে পারে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।