[বঙ্গবন্ধুকে পাহারা দিচ্ছে মেজর জিয়া। আর এই পাহারাদার নাকি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি!!!]
এবার দেশের রাজনীতিতে বোমা ফাটিয়েছেন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি দাবি করেছেন তার প্রয়াত স্বামী জিয়াউর রহমান হলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। আমার মনে হয় পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ হলে এহেন দাবি নিয়ে আর কোনো আলাপ-আলোচনা করতে কেউ উৎসাহিত হতো না। কিন্তু বড় বিচিত্র এই দেশ।
খালেদার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে 'হুক্কা-হুয়া, হুক্কা-হুয়া' বলে সব ইসলামপন্থি জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী মহল কোরাস গাওয়া শুরু করে দিলেন। আর ধন্যবাদ আমাদের গণমাধ্যম। একপাশে জাতির জনক ও অন্য পাশে জিয়ার নাম এবং ছবি দিয়ে হরেক রকমের কোসেস করে চলছে আসলে কে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এই সত্যটি উদঘাটনে। এটাকে তথ্য-সন্ত্রাস বললেও কম বলা হবে। এটা একেবারেই অপ-সাংবাদিকতা।
তবে এই জাতীয় অপতৎপরতা আমাদের দেশে কোনো নতুন বিষয় নয়। বিশেষ করে পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপরই শুরু হয় ইতিহাস বিকৃতির পালা। শুরু হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ও জাতীয় মহান বীর এবং স্থপতিদের নির্বাসন দিয়ে, তাদের চরিত্র হনন করে খলনায়কদের ইতিহাসের সোনালি পাতায় অভিষিক্ত করার। এই লক্ষ্য অর্জনে বিভিন্ন মিথ্যা, বানওয়াট ও অলিক তত্ত্বের জন্ম দেওয়া হয় ছলচাতুরীর মাধ্যমে। এর মধ্যে রয়েছে ঘোষক তত্ত্ব, ড্রাম তত্ত্ব, জন্মদিন তত্ত্ব এবং সর্বশেষ যোগ হলো রাষ্ট্রপতি তত্ত্ব।
সত্যের খাতিরেই এসব মিথ্যা তত্ত্ব ও খলনায়কদের আসল চেহারা জাতির সামনে তুলে ধরা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের পিতৃপুরুষদের বীরগাথা ও শৌর্য-বীর্যের অবিকৃত ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরা প্রয়োজন।
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় আমরা যখন ভারতের দেরাদুনস্থ টান্ডুয়া মিলিটারি একাডেমিতে সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম তখন আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে একটি গুজব শোনা গেল যে, সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার উদ্যোগে ও আমাদের কতিপয় বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক মীরজাফরদের সহায়তায় রাজনৈতিক মীমাংসার নামে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করার লক্ষ্য নিয়ে একটি নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। এই মীরজাফরদের তালিকায় খুনি মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের নামও ছিল। কৌশলগত কারণে মুজিবনগর সরকার এদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকাশ্য ব্যবস্থা গ্রহণ না করলেও সরকার ও যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের কোণঠাসা কিংবা গুরুত্বহীন করে রাখা হয়েছিল।
কিন্তু সত্য কখনো চাপা থাকে না। জাতির জনকের সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে যুদ্ধকালীন সময়ের নীলনকশাটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। যে সব বিপথগামী সেনাসদস্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল তাদের জবানবন্দিতেই জানা গেল যে, জাতির জনককে খুন করার আগে তারা যখন জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়েছিল তখন জিয়া বলেছিল, ‘We are senior officials we should not involve in it if you can go ahead I am giving you green signal.’ কিন্তু সবকিছু জেনেও বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানি কারাগার থেকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরে এলেন তখন প্রথম মন্ত্রিপরিষদের সভায় যুদ্ধে ভূমিকা রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ অন্যদের সঙ্গে জিয়াউর রহমানকেও বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করেন। কিন্তু পরবর্তী ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্নতর। বঙ্গবন্ধু জিয়ার শিরে যে গৌরবের পালক পরিয়ে দিয়েছিলেন জিয়া তার মর্যাদা ধরে রাখতে পারেননি।
কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে, যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনে জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে ও ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা ও দুই লাখ মা-বোনের রজনীগন্ধার মতো পবিত্রতা হারানোর বিনিময়ে পাওয়া সোনালি ফসল আমাদের সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ও আদর্শকে নির্বাসন দেওয়ার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেই তার শিরস্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া বীরউত্তম খেতাবটি নিজের পায়ের নিচে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। সুভাষ মুখপাধ্যায়ের একটি কবিতার চরণ মনে পড়ে_ ইচ্ছা করে পায়ের নিচে আছড়ে ফেলি মাথার মুকুট। ঠিক তাই করলেন জিয়া। এখন তিনি আর বীরউত্তম নন, বরং 'রাজাকার উত্তম। ' জিয়া কোনো বোকা লোক ছিলেন না।
পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছেন। যুদ্ধবিদ্যায় তিনি পারদর্শী। তিনি ভালো করেই জানেন 'বীর আর কাপুরুষ একত্রে চলতে পারে না। পরাজিত কাপুরুষ যদি বীরের হাত ধরে, তবে তার বীরত্ব খসে পড়ে। ' ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে জিয়াউর রহমান পরাজিত আল-বদর, আল-শামস, রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন।
আজ বিএনপি আর জামায়াতের যে মাখামাখি তার রূপকার হলেন জিয়া। তাই কোনো দাবি, সংগ্রাম কিংবা আবেদন-নিবেদন খালেদাকে জামায়াত থেকে পৃথক করতে পারবে না। কারণ তিনি জিয়ার আদর্শ বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। কেবল ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে জিয়া যে সব কাজ করেছেন তাতে তার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন ওঠার অবকাশ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনা অন্তরে ধারণ করতে পেরেছিলেন কি-না সেখানে বিস্তর কথা রয়েছে।
জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা নিয়ে জিয়াউর রহমানের অভিপ্রায় ও দৃষ্টিভঙ্গির কথা আমি ইতিপূর্বেও কয়েকবার লিখেছি। ১২ ডিসেম্বর, ১৯৭৮। জিয়া গিয়েছিলেন চট্টগ্রামে। জিইম প্লান্ট উদ্বোধন করতে। অনুষ্ঠান শেষে তিনি সার্কিট হাউসে ফিরে এলেন।
চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা ডা. এএফএম ইউসুফ বললেন, 'স্যার, আমরা ইসলামী আদর্শের রাজনীতি করি কিন্তু আমাদের পতাকায় ইসলামী রং নাই। ' জিয়া কেবল ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছেন। টাওয়ালে হাত মুছতে মুছতে বললেন, 'হবে, সব হবে। আগে হিন্দুর লেখা জাতীয় সংগীতটি পরিবর্তন করি। ' তিনি আরও বললেন, বাকশালীরাই আমার জাতীয় সংগীতকে (প্রথম বাংলা দেশ আমার শেষ বাংলা দেশ) সমালোচনা করে জনপ্রিয় করে দিয়েছে।
আমি কেবল ঘোষণা দেব মাত্র। কোনো এক অলক্ষুনে মুহূর্তে এই সার্কিট হাউসেই জিয়া নিহত হন। মৃত্যু মানেই শোকাবহ- মৃত্যু মানেই বেদনাদায়ক। জিয়ার মৃত্যুও তার কোনো ব্যতিক্রম নয়। তবে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার ভাবনা- যদি জিয়া মারা না যেতেন তবে 'হিন্দুর লেখা' জাতীয় সংগীত পরিবর্তনটি জাতিকে কীভাবে গ্রহণ করতে হতো! সবুজ জমিনের মাঝে রক্তিম সূর্য খচিত আমাদের প্রিয় জাতীয় পতাকাটির কী পরিণতি হতো তাওবা কে জানে!
অনেক পানি ঘোলা করেও জিয়াকে শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার ঘোষক বানানো যায়নি।
ঘোষক তত্ত্ব ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করা যায়নি। এমনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ করে খালেদা তার প্রিয়তম স্বামীকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করলেন কোন বিবেচনায়। এটাকে পাগলে কি না বলে... হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া যেত। তবে বিষয়টি নিয়ে জাতীয়তাবাদী মহলে যেরকম যজবা সৃষ্টি হয়েছে তাতে মনে হয় এর মাঝে কোনো গভীর চক্রান্ত থাকলেও থাকতে পারে। রেকর্ড অনুযায়ী দেখা যায় যে, রাষ্ট্রপতি তত্ত্বটির ঘোষণা দেন খালেদাতনয় তারেক জিয়া লন্ডন থেকে।
মায়েরা পুত্রস্নেহে কাতর থাকেন। বঙ্কিম চন্দ্র লিখেছেন_ 'দেখ পৃথিবীতে সবচেয়ে কম লাভের জিনিস হলো মাতৃস্নেহ। ' বেটা সাহিত্য সম্রাট! ধুরন্ধর বটে। মাতৃস্নেহকে নিঃস্বার্থ বলেনি। বলেছে কম স্বার্থের ভালোবাসা।
তারেক জিয়ার বিদ্যা-বুদ্ধি-জ্ঞান-গরিমা নিয়ে দেশের মানুষের মনে কোনো প্রকার বিভ্রান্তি নেই। তবে পরদিনই পুত্রের কথার প্রতিধ্বনি করে বেগম জিয়াও তার স্বামীকে দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দিলেন। এটা কী শুধুই পুত্রস্নেহ না কোনো নতুন দুষ্ট কৌশল। শুনেছি বেগম জিয়া ঐতিহাসিক কারণে তারেকের চেয়ে কোকোকে বেশি ভালোবাসে। এখন কোনো কারণে যদি কোকো তার পিতা জিয়াউর রহমানকে জাতির পিতা বলে দাবি করে কিংবা সে যদি ঘোষণা করে যে, বঙ্গবন্ধু খেতাবটি আসলে শেখ মুজিবকে নয়, জিয়াউর রহমানকে দেওয়া হয়েছিল।
সঙ্গে সঙ্গে পুত্রস্নেহে খালেদা জিয়া জাতীয়তাবাদী গণমাধ্যম কর্মীদের সমাবেশ ডেকে তাই ঘোষণা করে দেন, তবে কে তা ঠেকাবেন? অনেকে বলবেন যিনি বঙ্গবন্ধু খেতাবটি দিয়েছিলেন সেই দিনের সেই ছাত্রসমাজের অগি্নপুরুষ আজকের নন্দিত জননেতা তোফায়েল আহমেদ তো বেঁচে আছেন। তিনি নিজেই সাক্ষী দেবেন কাকে তিনি বঙ্গবন্ধু খেতাবটি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হবে না। জাতির জনক ২৫ আগস্টের মধ্যরাতে স্বাধীনতার ঘোষণাটি তৎকালীন ইপআর-এর ওয়ারলেসের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রচার করলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমে তার শত শত প্রমাণও আছে।
এই ঐতিহাসিক ঘোষণাটি স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রথমে আবুল কাশেম সন্দ্বীপ ও পরে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান উপর্যুপরি ঘোষণা দিলেন। পরে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন যে একজন সেনা অফিসার দ্বারা ঘোষণাটি পাঠ করাতে পারলে দেশের মানুষ উৎসাহিত হবেন। তখন খবর এলো যে মেজর জিয়া যিনি জাহাজ থেকে পাকিস্তানের অস্ত্র খালাস করতে চট্টগ্রামে এসেছিলেন অবস্থা অনুকূল নয় দেখে তিনি কালুরঘাট হয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। ওই খবর পেয়ে তাকে ডেকে এনে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পাঠ করানো হলো। জিয়ার মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত দেশ ও জাতির ইতিহাস এমনটিই ছিল।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর কে বা কারা জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বানিয়ে ফেলেছে। তাই অনেকেই মন করছেন, খালেদা জিয়া তার স্বামীকে শুধু প্রথম রাষ্ট্রপতি বানিয়েই ক্ষান্ত হবেন না, শেষ পর্যন্ত জিয়াকে জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু বানিয়ে ছাড়বেন। কিসের ইতিহাস আর কিসের ভূগোল। জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীরা আছেন খালেদা জিয়ার পাশে। দেশনেত্রী যা বলবেন তাই হবে জাতির আসল ইতিহাস।
সুত্র ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।