সম্মুখ সারির বেসামরিক নেতাদের যাঁরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আবদেল মনেইম আবুল ফতুহ অন্যতম। তিনি ‘স্ট্রং ইজিপ্ট পার্টি’র সভাপতি। ২০১২ সালের নির্বাচনে তিনি চতুর্থ স্থান লাভ করেছিলেন। তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন সাবেক সদস্য।
তরুণ অধিকারপন্থী আইনজীবী খালেদ আলীও নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তিনি এই নির্বাচনকে এক প্রার্থীকেন্দ্রিক বিমূর্ত ‘প্রহসন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
এমনকি সেনাবাহিনীর সাবেক জেনারেল, যেমন সামি আনান ও আহমেদ শফিক দুজনেই এই প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এঁদের মধ্যে শফিক ২০১২ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয় হন ও মুরসির বিরুদ্ধে পুনর্নির্বাচনে লড়েন।
ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স টু সাপোর্ট লেজিটিমেসি (বৈধ বা আইনসম্মত বিষয়কে সমর্থনদানে গঠিত জাতীয় ঐক্য) এই নির্বাচনে কোনো প্রার্থী মনোনয়ন বা কাউকে সমর্থন দেবে না।
এরা ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে সমর্থন দিয়েছিল। মিসরের প্রথম স্বাধীনভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে উৎখাতের ঘটনাকে ক্যু হিসেবে আখ্যায়িত করে তারা এর নিন্দা জানানো অব্যাহত রাখবে।
আমি এক পূর্ববর্তী লেখায় সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম, এই নির্বাচন অভিজ্ঞ বামপন্থী নেতা সাবাহি ও সদ্য সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিসির মধ্যকার দ্বৈরথে পর্যবসিত হবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই নির্বাচন হবে ‘ভালো’ ও ‘আরও ভালো’র মধ্যে লড়াই। উভয় প্রার্থীই ২৫ জানুয়ারির বিদ্রোহ এবং ৩ জুলাইয়ের শুদ্ধি অভিযানের সমর্থকদের সমর্থন ও শ্রদ্ধার পাত্র—এ বিবেচনায় তাঁদের মধ্যে লড়াই জমে উঠবে।
অন্যদিকে কিছু বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদ মনে করেন, সিসির মনোনয়নের পর মিসরে সন্ত্রাসী আক্রমণ বেড়ে যাবে।
স্ট্রং ইজিপ্ট পার্টির মুখপাত্র আহমেদ ইমাম বলেছেন, প্রেসিডেন্ট পদে সিসির মনোনয়নে এটাই প্রমাণিত হয় যে সেনাবাহিনী দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে, আর গত ৩০ জুনের ঘটনা ছিল একটি ক্যু। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে এবং যাঁরা এ সমস্যা সৃষ্টি করেছেন, তাঁরা এর সমাধান করতে পারবেন না।
২০১২ সালের আগস্ট মাসে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার আগে সিসি খুব একটা পরিচিত ছিলেন না। গত জুলাইয়ে মুরসিকে উৎখাতে সৃষ্ট গণজাগরণকে সমর্থন জানালে তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
কিন্তু বিদ্রূপাত্মক ব্যাপার হচ্ছে, তিনি তখন বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করবেন না। সিসির প্রতিপক্ষের শঙ্কা হচ্ছে, তিনি নির্বাচিত হলে মিসরে সামরিক শাসন চলমান থাকবে, ছয় দশক ধরে যা চলে আসছে, শুধু মুরসির এক বছরের শাসনামল ছাড়া। যদিও মুরসির শাসনামলে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল না বলেই অনেকে মনে করেন।
ব্রিটেনের অবজারভার পত্রিকা সিসির মনোনয়ন আর মোবারকের জামানার নিপীড়নমূলক তৎপরতার মধ্যে সাদৃশ্য দেখতে পাচ্ছে। একইভাবে ওয়াশিংটন পোস্ট বলেছে, মিসরে কোনো গণতান্ত্রিক রূপান্তরের নমুনা দেখা যাচ্ছে না।
হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী ও বিরোধীদলীয় কর্মীকে গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গ টেনে তারা বলেছে, সিসিও ভুল পথে এগোচ্ছেন। এই গ্রেপ্তারকৃতদের সংখ্যা ১৬ থেকে ২১ হাজার। তাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। এমনকি মিডিয়া ও সাংবাদিকদের ওপরও নির্যাতন চালানো হচ্ছে, বিক্ষোভ-সমাবেশে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
প্রখ্যাত মিসরীয় সাংবাদিক ফাহমি হাওয়েইদি মিসরীয় আরবি দৈনিক আল-শুরুতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে আলজেরিয়ার পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
সিসির মনোনয়নের কিছুদিন আগে কায়রোর কাছে ছয় ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এসব কথা বলেছেন। নব্বইয়ের দশকে আলজেরিয়ার এই পরিস্থিতি ১০ বছর স্থায়ী হয়েছিল, হাজার হাজার মানুষ এতে মারা যায়। হাওয়েইদি আলজেরিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিসরীয় সেনাবাহিনীর তুলনা টেনেছেন এই বলে যে উভয়ই গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথ রুদ্ধ করেছে। তাদের মধ্যে পার্থক্য শুধু জনসমর্থনের মাত্রার দিক থেকে।
নয় দশকের সাধনার পর মুসলিম ব্রাদারহুডের জামানা মাত্র এক বছর টিকেছে।
তারা ২০১২ সালের নির্বাচনকে স্বপ্নের ইসলামি প্রজাতন্ত্র বাস্তবায়নে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে মনে করেছিল। বছরের পর বছর নিপীড়নের পর ব্রাদারহুডের এক বছরের জামানায় বেসামরিক রাষ্ট্র ও সংবিধানের প্রতি তীব্র ঘৃণা উৎসারিত হয়। এর ফলে মিসরীয়রা তাদের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে পারেনি। জনগণের ঐক্য হয়নি এবং ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে পাল্টা কিছু হয়নি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাজেম এল বেলবাওয়ি সিসিকে দে গল ও আইসেনহাওয়ারের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
তাঁরা ছিলেন উর্দি পরা লোক, তবে ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথিতযশা প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাজনীতিবিদ আমর মুসা বলেছেন, সিসি নির্বাচিত হলে মিসরের তৃতীয় প্রজাতন্ত্রের শুভারম্ভ হবে। আবার বহু মিসরীয় তাঁকে একজন রক্ষাকর্তা হিসেবে দেখছে, যিনি তিনটি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বছরে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন। মিসরের শিল্প ও বিনিয়োগমন্ত্রী মনির ফকরি আবদেল নূর বলেছেন, সেনাবাহিনীর একজন জেনারেলের পক্ষে নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন দাখিল করাটা শুভ লক্ষণ নয়। এটা অত্যন্ত বাজে ব্যাপার।
তিনি স্বৈরতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে যান। জর্জ ওয়াশিংটন যেমন সে দেশে রূপান্তর ঘটিয়েছেন, তাঁর দ্বারা সে রকম কিছু সম্ভব নয়। তবে আবদেল নূর বলেছেন, দেশে এখন একজন শক্তিশালী নেতা প্রয়োজন, যিনি দেশে আইনশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও বিনিয়োগের পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে পারবেন।
মিসরীয়রা তিন বছর সংগ্রামের পর এখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। অনেকেই মনে করেন, সিসি এর জন্য উপযুক্ত লোক।
কিন্তু বহু বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক সিসিকে একজন গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে গণ্য করছেন না। তার পরও বহু স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী মনে করেন, তিনি স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারবেন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কামাল গাবালা: মিসরের আলআহরাম পত্রিকাগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।