মঙ্গলবার (০১-০৪-২০১৪) সকাল ৭ টা ৩৫ এর দিকে আমি অফিসে চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছি। আমার ছোট বোনের ফোন। আমি কলটি রিসিভ করতে পারি নাই। আবার ১৫ মিনিট পর আমার মেঝ বোনের ফোন। ফোনটি দেখেই ভাবছি হয়তো কোন খারাপ খবর হবে।
নইলে এত সকাল বেলায় ফোন করবে কেন? আমার বোন বলতে লাগল, নাসিম ভাইকে (৪৮) হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সাথে ভাবী আর দুলাভাই (সবার বড় বোনের স্বামী) আছে। আমি কিছু না বলে ফোনটি রেখে দিলাম। দুলাভাইকে ফোন করলাম, উনি বললেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হসপিটালের পাশে হৃদরোগ হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি। ভাই নাকি প্রচুর ঘামতেছিলেন, বুকে ব্যথা আর চোখে ঝাপসা দেখতেছিলেন, বলে ফোনটি উনিই কেঁটে দিলেন।
আবার ফোন করলাম। উনি ভাইকে সাপোর্ট দিতে গিয়ে ভালই ভুল করলেন। ভুলক্রমে হৃদরোগে না গিয়ে পাশের হসপিটালে গেলেন, সেখানে ডক্টর না পেয়ে এক দালালের কথায় রাস্তার ওপারে গেলেন এক ডক্টরেরে চেম্বারে। ডক্টর বললেন অবস্থা বেশি ভাল না। আবার উনি হৃদরোগে পাঠালেন।
হেঁটে হেঁটে ভাইয়ের অবস্থাতো আরও খারাপ।
আমি সকাল ৮.৫০ দিকে অফিস থেকে বের হয়ে গেলাম। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম বনানী থেকে শেরেবাংলা নগর। সকাল ১০.৩০ টায় পৌঁছলাম। উনি সি.সি.ইউ তে ২০ নাম্বার বেডে ঘুমিয়ে আছেন।
কি যেন একটা ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। কমপক্ষে ৪/৫ ঘণ্টা ঘুমাবেন। আমরা যারা দর্শনার্থি ছিলাম সবাই মিলে বাইরে অপেক্ষা করতেছিলাম।
এরই মধ্যে হসপিটালে আমার পূর্ব পরিচিত এলেন ভাইয়ের সাথে দেখা। উনি গত রাতেই আমাকে এস.এম.এস করে জানিয়েছেন যে, ওনার বাবা রাত ১১ টার দিকে মারা গেছেন।
আজ উনি লাশ নিয়ে যাবেন। রাতে হয়ত উনি অনেক কেঁদেছেন। তাই এখন অনেকটাই ওনাকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। একের পর এক ফোন রিসিভ করছেন, কথা বলছেন। আবার কিছুক্ষনের মধ্যেই দেখলাম, আর একটা লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
লাশ ধরে অনেকেই কাঁদছে।
দুপুর ১ টা বেজে গেল এরই মধ্যে। রাতে আমি অফিস করেছি। আমার দুচোখে ঘুম,আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। অবশেষে ভাবীকে বললাম আমি রাতে রোগীর সাথে থাকব।
এখন চলে যাই। তারপর মেঝ বোনের সাথে তার বাসা আজিমপুরে চলে গেলাম। দুপুরে একটু খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসতে ছিল না। বিছানা থেকে উঠে গোসল করলাম।
গোসল শেষে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুমাতে আর পারলাম কই? বোনের বাসায় আবার মেহমান আসল। ওদিকে আবার আমার বাসায় গিয়ে বউকে নিয়ে হসপিটালে যাবার কথা। বউকে ফোন করলাম। বললাম বাসায় আমি আর যাব না।
তুমি সরাসরি হসপিটালে চলে এসো। সেখান থেকে তোমাকে আমি বাসায় পৌঁছে দিব। আমার কথা শুনে বউ মনে হল একটু বিরক্ত হল। বাসায়ও বাজার-টাজার নাই। সন্ধ্যা ৭ টায় বাসায় পৌঁছে, বাজার সেরে, রাতে কোনরকম খেয়ে আধা ঘণ্টার মধ্যে মগবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
সেখানে রাজিব আর নেছার ভাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। রাজিব নতুন একটা প্রজেক্ট পেয়েছে। সেটার বিষয়ে আমাদের সারে ৮ টার দিকে বসার কথা। ঠিক ৮ টা ৫০ এর দিকে আমি পৌঁছলাম। হসপিটাল থেকে আবার আমার বড় দুলাভাই বার বার ফোন করছে আমার অবস্থান জানার জন্য।
সোয়া নয়টায় মিটিং শেষ করে ঠিক ১০ টার মধ্যে পৌঁছলাম। যেয়ে ভাবীকে আমি ছুটি দিলাম। ভাবী সারাদিন অনেক কষ্টে করেছেন। গোসল নেই, ঠিকমত খেয়েছে কিনা কে জানে?
আমার ভাই শুয়ে আছেন। এখন আগের চেয়ে ভাল বোধ করছেন।
কিন্তু কিছুতেই ওনার ঘুম আসছেনা। এদিকে হসপিটালে লক্ষ্য করলাম প্রচুর মশা। তাই মশার তাড়াবার কাজে আমি লেগে গেলাম। রাত ২ টা পর্যন্ত কখনও দাঁড়িয়ে আবার কখনও বসে হাত পাখা দিয়ে মশা তাড়ালাম।
ব্যাডের পাশে অল্প একটু জায়গা পেলাম।
সেখানে চাদর বিছিয়ে কোনরকম শুয়ে রইলাম। একটু ঘুমাতে পারলে হয়তো ভাল লাগত। চারপাশে রোগিদের চীৎকার।
১৯ নম্বর ব্যাডে এক বয়স্ক রোগী, ওনার দেখা শুনার জন্য শুধু দেখালাম ওনার ছেলের বউ। মহিলাটিও হাল্কা-পাতলা গড়নের মাঝ বয়সি।
মহিলাটির স্বশুর হটাৎ করেই মাঝে মধ্যেই চিৎকার করে উঠে। তাছাড়া গায়ে দেবার জন্য চাঁদর নেই। হসপিটাল থেকেই বরাদ্দ দেবার কথা কিন্তু বার বার মহিলাটি চাঁদর চেয়ে কেন পাচ্ছে না তা আমারও বোধগম্য হচ্ছে না। বাসা থেকেও হয়ত আনা হয়নি। শেষ পর্যন্ত দেখলাম গামছা দিয়েই ওনার গায়ে জড়িয়ে দেওয়া হল।
কিছুক্ষণ পর দেখলাম মহিলাটি উধাও হয়ে গিয়েছে। ওই বয়স্ক লোকটি তার ছেলের বউ কে ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। এক পর্যায়ে বেয়াদব বলে গালি দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
আমাদের সামনের ব্যাডেই আর এক রোগী দেখলাম। বয়স আনুমানিক ৫৫ হবে।
প্রায় সুস্থ হয়ে পরেছেন। তাই আর শুয়ে থাকতে পারছেন না। ব্যাড থেকে নেমে যেতে চান। ওনার বউ এতে রেগে গেলেন এবং বললেন এমন করলে উনি কাল সকালই হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাবেন। কথা বলতে বলতে হটাৎ করই বসতে যেয়ে একটু ব্যাথা পেলেন ভদ্রলোক।
যখনই বউ তার স্বামীকে ধরতে গেলেন। লোকটি আর ভদ্র থাকলেন না। অমনিই বউয়ের গালে, পীঠে চড় মারা শুরু করে দিলেন। একটু কষ্টের মাঝেও আমার হাসি পেল। যাহোক হসপিটালের স্টাফরা এই সব দেখে ওনাকে সি.সি.ইউ থেকে নরমাল ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিলেন।
ভোর রাতের দিকে আবার একজনের মৃত্যু। তার ছেলে-মেয়ে-আত্মীয়-স্বজন রা কান্নাকাটি করছে। হাসাপাতাল এক আজব যায়গা। সবাই আসে সুস্থ হতে। কেউ ফিরে সুস্থ হয়ে আবার কেউ ফিরে বাড়িতে যাবার জন্য নয়, চলে যায় না ফেরার দেশে।
মাঝে মধ্যে নিজেকে নিয়ে ভাবি আমারওতো কোনদিন এই ব্যাডে আসতে হতে পারে। কি আজব মানুষ আমরা বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ্ কাছে কতই না প্রার্থনা করি। মসজিদে গিয়েওতো আমরা এত অসহায় হয়ে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করি কি না সন্দেহ আছে? ভোরের অপেক্ষায় আছি। ডাক্তার আর কত দিন থাকতে বলে আর কত দিন পর রোগীকে রিলিজ করবে তা জানার অপেক্ষায় আছি।
ভোলামন১৪৩ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।