দেশের অনেক ক্রান্তিলগ্নে এই গুণী লেখক তার লেখনীর মাধ্যমে সেসব সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসেছেন। সম্প্রতী রাজনৈতিক অস্থিরতায়ও তার কলম থেমে থাকেনি। জামাত শিবিরকে উদ্দেশ্য করে তার একটি লেখার প্রতিবাদে এক শ্রেণীর লোক তার প্রতি হিংস্র হয়ে ওঠে। বিভিন্ন মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের দুর্নাম রটাতে শুরু করেন। অনেকে তাকে পক্ষপাতিত্বের দোষেও দুষতে থাকেন।
অথচ তার কিছুদিন পরই তিনি কিন্তু বিশ্বজিত হত্যার প্রতিবাদে ছাত্রলীগকেও ছেড়ে কথা বলেননি। তাই আসুন সকল ধরনের হিংসা, বিভেদ, ক্রোধ, অভিমান ভুলে এই গুণী লেখকের এই শুভ দিনে তাকে অভিনন্দন জানাতে কুন্ঠাবোধ না করি।
মুহাম্মদ জাফর ইকবালের সংক্ষিপ্ত জীবনী:
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে যে কজন লেখকের অবদান অনস্বীকার্য তাদের মধ্যে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল অন্যতম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেবার পর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী নেন। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বেল ল্যাবরেটরীতে কাজ করেন।
তবে দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই দেশে ফিরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দেন। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, শিশুসাহিত্য ছাড়াও ছোটদের জন্য গণিত ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বই লিখেছেন। তাঁর লেখা একাধিক কিশোর উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপ দেয়া হয়েছে। এসব ছাড়াও তিনি একাধিক পত্রিকায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে লেখেন। বিজ্ঞান ,গণিত, শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়াও দেশ, দেশের বিভিন্ন আলোচিত প্রসঙ্গে কলাম লেখেন তিনি।
দৈনিক প্রথম আলোয় তিনি ‘সাদাসিধে কথা’ শিরোনামে লেখেন।
১৯৫২ সালের ২৩ শে ডিসেম্বরের কোনো এক শুভক্ষণে সিলেটের আকাশ, বাতাসে তার আগমনী বার্তা ছড়িয়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফয়জুর রহমান ও আয়েশা আখতারের ঘর উজ্জ্বল করে তিনি পৃথিবীর আলোতে আসেন। তার পিতা ফয়জুর রহমান একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি শহীদ হন। তার পিতাও লেখালেখির চর্চা করতেন। পিতার সূত্র ধরে ছোটবেলা থেকেই টুকটাক লেখালেখি শুরু করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতোকোত্তর শেষ করে ১৯৭৬ সালে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে আমেরিকাতে পাড়ি জমান এবং সেই সময় তার এক সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ইয়াসমিন হককে বিয়ে করেন। সংসার জীবনে তিনি এক পুত্র ও এক কন্য সন্তানের গর্বিত জনক।
কর্ম জীবনের শুরুতে তিনি আমেরিকার বিখ্যাত বেল কমিউনিকেশন রিসার্চ (বেলকোর) গবেষক হিসেবে দীর্ঘদিন সাফল্যের সাথে কাজ করেন। পরবর্তীতে দেশপ্রেমের তৃষ্ণায় কাতর হয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। সেই থেকে এখনও তিনি এই পদে সাফল্যের সাথে নিয়োজিত আছেন।
তাই তো তিনি তার পাঠকদের নিকট প্রিয় জাফর ইকবাল স্যার নামে পরিচিত। এছাড়া তিনি দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ‘সাধাসিধে কথা’ নামে নিয়মিত কলাম লেখেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় থেকেই তিনি লেখালেখির প্রতি বিশেষ জোড় দেন। এসময় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় তার প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক গল্প ‘কপোট্রনিক ভালোবাসা’ প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে এক পাঠক তার এই গল্পটি বিদেশি একটি গল্প থেকে চুরি করা বলে দাবি করেন।
সেই পাঠকের ভুল ভাঙানোর জন্য ‘কপোট্রনিক ভালোবাসা’ গল্পটিকে বিভিন্ন ভাবে ঘুরিয়ে একাধিক গল্পে রূপ দেন এবং আমেরিকায় থাকাকালীন সময়ে সবগুলো গল্পকে একসাথে করে ‘কপোট্রনিক সুখ-দু:খ’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন।
বিজ্ঞান বিষয়ক বইয়ের পাশাপাশি তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, কিশোর সাহিত্য, ভৌতিক সাহিত্য এর উপর অসংখ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি বই লিখেছেন। এছাড়া কলাম সংকলন ও টিভি নাট্যকার হিসেবেও তিনি পাঠকমহলে সমানভাবে সমাদৃত।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল নন্দিত কথাশিল্পী প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদের অনুজ জাফর ইকবালের বেশিরভাগ লেখাতেই দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠত। দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় দেশের জনগণ তার দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে।
তার আরেক অনুজ আহসান হাবীবও একজন সাহিত্যিক। বর্তমানে তিনি রম্য ম্যাগাজিন ‘উন্মাদের’ সম্পাদক ও কার্টুনিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সাহিত্য চর্চার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি অসংখ্য পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরষ্কারে ভূষিত হন। শুধু তাই নয়, ঠিক তার পরের বছরই নাট্যাঙ্গনের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটটিও শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে তিনি অর্জন করেন।
এছাড়াও তিনি আরও অসংখ্য পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। যেমন – কাজী মাহবুবুল্লাহ জেবুন্নেছা পদক, খালেদা চৌধুরি সাহিত্য পদক, শেলটেক সাহিত্য পদক, ইউরো শিশুসাহিত্য পদক, মোহা. মুদাব্বর-হুসনে আরা সাহিত্য পদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালাইমনি এ্যাসোসিয়েশন পদক, আমেরিকা এল্যাইমনি এ্যাসোসিয়েশন পদক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক সম্মাননা পদক। তবে আমার দৃষ্টিতে সারাজীবন লেখালেখি করে তিনি সবচাইতে বড় যে পুরষ্কারটি পেয়েছেন সেটি হলো পাঠক ও দর্শকদের হৃদয়ে সম্মানের সাথে জায়গা করে নেওয়া। এরচাইতে বড় পুরষ্কার আর কিছু হতে পারে না।
মুহাম্মদ জাফর ইকবাল – এর বইসমূহ
উপন্যাস:
আকাশ বাড়িয়ে দাও, দুঃস্বপ্নের দ্বিতীয় প্রহর, বিবর্ণ তুষার, সবুজ ভেলভেট, কাচসমুদ্র, ক্যাম্প, মহব্বত আলীর একদিন।
ছোট গল্প
ক্যাম্প, ছেলেমানুষী, নুরূল ও তার নোটবই, মাসুদ রানা
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
কপোট্রনিক সুখ দুঃখ, ট্রাইটন একটি গ্রহের নাম, যারা বায়োবট, টুকুনজিল, বিজ্ঞানী সফদর আলীর মহা মহা আবিস্কার, নি:সঙ্গ গ্রহচারী, মহাকাশে মহাত্রাস, ওমিক্রমিক রূপান্তর, ফোবিয়ানের যাত্রী, বিজ্ঞানী অনিক লুম্বা, বেজি, নয় নয় শূন্য তিন, অবনীল, ক্রোমিয়াম অরণ্য, ক্রুগো, সিস্টেম এডিফাস, একজন অতিমানবী, পৃ, ইরন, ফিনিক্স, অবনীল, ত্রাতুলের জগৎ, মেতসিস, ত্রিনিত্রি রাশিমালা, রুহান রুহান, জলমানব, অন্ধকারের গ্রহ, প্রডিজি, কেপলার টুটুবি।
কিশোর সাহিত্য
দীপু নাম্বার টু (পরবর্তীতে এটি থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল), হাতকাটা রবিন (পরবর্তীতে এটি থেকে নাটক নির্মিত হয়েছিল), দুষ্টু ছেলের দল, জারুল চৌধুরীর মানিকজোড়, আমার বন্ধু রাশেদ (পরবর্তীতে এটি থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল), দস্যি কজন, কাবিল কোহকাফী, কাজলের দিনরাত্রি, মেকু কাহিনী, টি-রেক্সের সন্ধানে, আমি তপু, শান্তা পরিবার, বকুলাপ্পু, নিতু ও তার বন্ধুরা, টুকি এবং ঝায়ের (প্রায়) দুঃসাহসিক অভিযান, শাহনাজ ও ক্যাপ্টেন ডাবলু, রাজু ও আগুনালির ভুত, নাট বল্টু, রাতুলের রাত রাতুলের দিন।
ভৌতিক সাহিত্য
প্রেত, পিশাচিনী, নিশিকন্যা, ছায়ালীন, ও, দানব।
টিভি নাটক
গেস্ট হাউস, ঘাস ফরিঙের স্বপ্ন, শান্তা পরিবার, একটি সুন্দর সকাল, লিরিক।
মুক্তিযুদ্ধ
১৯৯১ সালের মুক্তিযুদ্ধের উপর ভিত্তি করে ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ নামক একটি বই লেখেন।
কলাম সংকলন
সাধাসিধে কথা, নি:সঙ্গ বচন, প্রিয় গগন ও অন্যান্য, হিমঘরে ঘুম ও অন্যান্য, পৃথিবীর সৌন্দর্য এবং আলফ্রেড সরেন, ২০৩০ সালের একদিন ও অন্যান্য, দু:স্বপ্নের রাত এবং দুর্ভাবনার দিন, এখনো স্বপ্ন দেখায়, ক্রসফায়ার এবং অন্যান্য, আরো একটি বিজয় চাই, ভবদহের গল্প এবং অন্যান্য, বৈশাখের হাহাকার ও অন্যান্য।
*** সমাপ্ত ***
তথ্যসূত্রে: অনলাইন ঢাকা গাইড (http://www.online-dhaka.com)। জাফর ইকবাল স্যারের জন্মদিনে জাফর ইকবাল স্যারের ভক্তদের জন্য অন্যরকম একটি উপহার রইলো আমাদের পক্ষ থেকে। উপহারটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।