আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাগর পথে মানবপাচারে সক্রিয় একশ’ সিন্ডিকেট

আমি যা বলতে চাই... আলম দিদার, কক্সবাজার থেকে ফিরে : কক্সবাজার থেকে ট্রলারে করে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় যাত্রা। উত্তাল সাগর পথে বাহন ট্রলার কিংবা কার্গো বোট। পৌঁছতে সময় লাগে ৭ দিন ৭ রাত। ওই সময়টা কোনোভাবে পার করতে পারলেই হলো! নিজের জীবনকে এক অনিশ্চয়তার হাতে তুলে দিয়ে এভাবেই অবৈধভাবে সাগর পথে পাড়ি জমাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি দেয়া সাগর পথের এই সব যাত্রীদের বেশির ভাগেরই সলিল সমাধি ঘটে সেই উত্তাল সাগরেই।

না হয় তাদের ঠাঁই হয় বাংলাদেশী বা ভারতীয় আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে কারাগারে। আর এসব মানব পাচারের কাজে জড়িত মূল হোতারা বরাবরই থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। রাজনৈতিক ছত্রছায়া, স্থানীয় প্রভাব আর পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর চলছে সাগর পথে মানবপাচার। টেকনাফ-উখিয়া রুটে মানবপাচারে জড়িত রয়েছে একশ’ সিন্ডিকেট। পুলিশ প্রশাসনও হন্য হয়ে খুজছে এসব দালালদের।

টেকনাফ থানায় দায়ের করা পুলিশের ১৫ মামলার এজাহার থেকে এসব সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু মালয়েশিয়া নয়, থাইল্যান্ড কিংবা ইন্দোনেশিয়া যাত্রা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সেখানে যাচ্ছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার স্বপ্নপ্রত্যাশী মানুষ। ভালো উপার্জনের আশায় এসেব লোকজন বিক্রি করে দিচ্ছেন ঘরবাড়ি, জমিজমা। টাকা তুলে দিচ্ছেন দালালদের হাতে।

আর এই কাজটি করতে গিয়ে গরিব, দিনমজুর, মধ্যবিত্ত মানুষেরা মোকাবিলা করছেন সাগরের উত্তাল ঢেউ। প্রবল বৃষ্টি। ভয়ঙ্কর প্রাণী। বেশির ভাগই ধরা পড়ছেন কোস্টগার্ডের হাতে। জেল খাটছেন।

অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পথে পথে ঘুমাচ্ছেন। না খেয়ে পার করছেন দিন। আর যারা অর্ধাহারে-অনাহারে ওইসব দেশে পৌঁছেন তাদেরও শান্তি নেই। স্বল্প খরচে বিদেশ পাড়ি দিয়ে এসেব লোকজনকে করতে হয় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

হাজারো স্বপ্ন নিয়ে দালালদের হাতে সব কিছু তুলে দিয়ে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে তাদের স্বপ্নভঙ্গ হলেও ধরা পড়ছে না মানবপাচারের কাজে জড়িত মূল হোতারা। রাজনৈতিক ছত্রছায়া, স্থানীয় প্রভাব আর পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর চলছে বিদেশে লোক পাঠানোর নামে এই মানবপাচার। এই কাজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একশটি সিন্ডিকেট। নিঃস্ব করছে তারা স্বপ্নপ্রত্যাশী মানুষদের। আর এ জন্য গোপনে বেছে নেয়া হয়েছে কক্সবাজার জেলার টেকনাফের সমুদ্র রুটটি।

ভুক্তভোগীরা জানান, সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড কিংবা ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার জন্য একজন লোকের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। আর এই কাজটির জন্য তারা স্থানীয়ভাবে খোঁজ করে বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা আদম পাচারকারীদের। যাদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রামের অনেক ট্রাভেলস প্রতিষ্ঠানের। কেউ যদি এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেতে চান, তাহলে তারা টেকনাফে স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করা সিন্ডিকেটের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করিয়ে দেয়। বেশির ভাগ লোকই মালয়েশিয়া পৌঁছে যায়।

বর্তমানে মালয়েশিয়ায় দিন-রাত কাজ করে প্রতি মাসে দেড়-দুই হাজার রিংগিত আয় হয়, যা বাংলাদেশের ২৫-৩০ হাজার টাকার সমান। অনেক সময় বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে আসা শ্রমিকরা দিনের বেলায় কাজ করে নিজের বাসায় ফিরতে পারে না। তাই তারা সে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পাহাড়ে রাত কাটান। তবে সেখানে পৌঁছার পর থাইল্যান্ডের নৌ ও কোস্ট গার্ড বাহিনীর হাতে আটক হন অনেকে। যারা ধরা পড়েন তাদের ওপর শুরু হয় নির্যাতন।

থাইল্যান্ড কোস্টগার্ড হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ইঞ্জিনবিহীন নৌকায় বাংলাদেশীদের তুলে সমুদ্রে বাসিয়ে দেয়। সাগরে ভেসে থাকার পর এসব লোকজনের ভাগ্যে মৃত্যু ছাড়া কিছুই জোটে না। সাম্প্রতিককালে টেকনাফ ও কক্সবাজারের নাজিরারটেক, কস্তুরা ঘাট, উখিয়ার মনখালী, সোনারপাড়া, টেকনাফের শামলাপুর, শীলখালী, জাহাজপুরা, টেকনাফ সদর, শাহপুরীর দ্বীপ ঘোলা পাড়া, পশ্চিম পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, জেটিঘাট, কাটাবনিয়া, মিটা পানির ছড়া, রাজার ছড়াসহ বিভিন্ন উপকুলীয় এলাকা দিয়ে মালয়েশিয়া যাত্রা বেড়েছে। এসব স্থান থেকে যান্ত্রিক ফিশিং বোট দিয়ে লোকজন সাগর পাড়ি দিচ্ছে। ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে কক্সবাজার থেকে ট্রলার যোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে ভারতের আন্দামান সাগরে নৌ সেনাদের হাতে ধরা পড়ে অনেকে।

এদের মধ্যে বেশির ভাগ বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের নাগরিক। ১ দিন ১ রাত সাঁতার কেটে ও ভাসমান থেকে ভারতীয় নৌ-বাহিনী ৬৭ জনকে উদ্ধার করলেও অবশিষ্টদের মধ্যে প্রায় দুই শতাধিক লোক এখনও কারাগারের আটক রয়েছে বলে জানা গেছে। ওই ট্রলারে থাকা মালয়েশিয়াগামী আবদুল মালেকের স্ত্রী ছখিনা খাতুন ও বশির আহমদের স্ত্রী লাইলা বেগম বলেন, ‘আমরা কানের দুল, নাকের ফুল ও বিভিন্ন প্রকারের আসবাবপত্র বিক্রয় করে স্বামীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করে ছিলাম। কিন্তু স্বামীকে মৃত্যুর খবরে তাদের মাথায় সাত আসমান ভেঙে পড়ে। ’ বর্তমানে অনেক কষ্টে দিন কাটছে তাদের।

ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ। অনুসন্ধানে একজন দালাল চক্রের সক্রিয় সদস্য জানান, একটি ট্রলারে ১১০-১৪০ জন পর্যন্ত লোক নেয়া যায়। এদের শুকনো খাবার হিসেবে দেয়া হয় গুড় ও চিঁড়া। ৭ দিনের হিসেবে ১০ বস্তা চাউল, ২০ কেজি শুটকি ও ২ মণ আলু থাকে। এই ৭ দিনে শুধুমাত্র সাত বেলা ভাত দেয়া হয়।

ট্রলারের ২ হাজার লিটার তেল লাগে। তিনি আরও জানান, থাইল্যান্ড সীমান্ত গিয়ে সেখানে দালাল চক্রের কিছু সদস্য রয়েছে। তারা থাইল্যান্ড থেকে মালয়েশিয়া সীমান্ত পারাপার করতে জনপ্রতি ৭০-৮০ হাজার টাকা নেয়। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কিছু লোক ফিশিং ট্রলারের মাধ্যমে প্রথম অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যায়। এরপর উখিয়া উপজেলার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের আয়ুব আলী মাঝি কক্সবাজার থেকে আরও একটি ফিশিং ট্রলারে করে ৪০ জন নাগরিকসহ সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া রওনা দেয়।

এই খবর শরণার্থী শিবির ও সীমান্তবর্তী দুই এলাকায় জানাজানি হয়ে গেলে অসংখ্যা মিয়ানামার ও স্থানীয় বাসিন্দারা সাগর পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকেন। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গোপসাগর দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। আর এই কাজটি করে আসছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। লোক পাঠানোর কাজে এই মুর্হূতে ১০০টি সিন্ডিকেট পৃথকভাবে কাজ করছে। এসব সিন্ডিকেটের মধ্যে বাংলাদেশীরা যেমন আছেন, তেমনি আছেন মিয়ানমারের রোহিঙ্গারাও।

এদের কাছে নিঃস্ব হয়ে ভারতের আন্দামান দ্বীপ ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন কারাগারে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে অসংখ্য হতভাগ্য মানুষ। রাজধানী ঢাকার উত্তরার বিসমিল্লা ট্রাভেলস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রয়েছে এমন অভিযোগ। এরা দীর্ঘদিন ধরে লোকজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সমুদ্র পথে মালয়শিয়া পাঠাচ্ছে। ওই চক্র গত অক্টোবর মাসে চট্টগ্রামের স্টেশনরোডের ৪টি আবাসিক হোটেলে নিরীহ লোকজনকে এনে জড়ো করেছিল। পরে র‌্যাব ৭-এর একটি দল তাদের হাতেনাতে আটক করে।

বাংলাদেশের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের মিস্ত্রিপাড়ার মো. সেলিম ওরফে লম্বা সেলিম, শরীফ হোসেন, মো ইসলাম, মো. মুজিবুর রহমান, রহমত উলাহ, মো. শরীফ, নুর মোহাম্মদ, ধলু হোসেন, কালু মিয়া, আবদুর রহমান, আয়ুব আলী মাঝি, আবুল কালাম, মো. ফিরোজ, ইউনুছ, নয়াপাড়ার কসাই মুজিদ, লাল মিয়া সাবরাং ক্যাটিন, টেকনাফের মো. ইসমাইল, মো. হোসেন মৌলভী, মো. রফিক, কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের ১নং শেডের মো. রফিক, মো. উলাহ, মো. আমিন ও মাহাবুব আলম মিয়ানমারের আকিয়াব আবদুর রহিমের নাম রয়েছে এই সিন্ডিকেটে। তাদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ করেছেন প্রতারণার শিকার অনেকেই টেকনাফ থানায় পৃথক ১৫টি মামলা করেছে। টেকনাফস্থ ৪২ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল জাহিদ হাসান বলেন, ‘অবৈধ ঝুঁকিপূর্ণ পথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমানো থেকে লোকজনদের রক্ষা করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এই জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সামাজিক ও রাজনৈতিক লোকজনদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। ’ একই রকম অভিমত ব্যক্ত করেছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার।

তিনি বলেন, ‘মানবপাচার প্রতিরোধে এর সাথে জড়িত বেশ কয়েকটি গ্র“পকে চিহ্নিত করার কাজ চলছে। ইতিমধ্যে তাদের গ্রেফতারে পুলিশ অভিযানও চালিয়েছে। কয়েকজন গ্র“প লিডারকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এরপরও বলবো মানবপাচার প্রতিরোধে যারা মালয়েশিয়া যাওয়ার লোভে নিজের প্রাণকে ভাগ্যের হাতে তুলে দিয়ে নৌকায় করে সমুদ্র পথে রওনা দেয় তাদের আরো সচেতন হতে হবে। তাদের সচেতনতাই হচ্ছে মানবপাচার প্রতিরোধের অন্যতম উপায়।

’ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.