Youth cannot know how age thinks and feels. But old men are guilty if they forget what it was to be young.
নির্বাচনে জয়লাভ করবার জন্যে যদি কোনো দল তার দেশের একটি আস্ত দালানে অগ্নিসংযোগ ঘটায়, তবে তাদের আপনি কি বলবেন? নিশ্চয় উন্মাদ?
বাংলাদেশীদের কাছে এটি মোটেও অবাক করার মতন কোনো ব্যাপার নয়। আমরা হরহামেশাই আমাদের দেশের প্রধান দুই দল এবং তাদের দোসরদের কাঁদা ছোড়াছুড়ি এবং জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্যে একে অপরের উপর দোষ চাপানোর ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। সাধারণ জনগণ প্রতিবাদ করে ঠিকই। কিন্তু যখন সব ধরণের গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ পদ্ধতি ব্যর্থ হয়, তখন আমাদের শেষ আশ্রয় হল ব্যালট পেপার। কিন্তু সেখানেও আমরা নিরুপায়।
প্রধান দুটি নিমকহারাম দল ছাড়া ভোট দেওয়ার মত যে আর কেউ নেই।
১৯৩৩ সালে, জার্মানিতে, পরিস্থিতি অনেকটা এরকমই ছিল। হিটলার ছিলেন গণতান্ত্রিক জোট সরকারের চ্যান্সেলর। কিন্তু জোট সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদে নাৎসি পার্টির সদস্য ছিলেন মাত্র তিনজন। বাকি সবাই হলেন ন্যাশনালিস্ট পার্টির সদস্য।
হিটলারের ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে, ন্যাশনালিস্ট পার্টির নেতা ফ্রাঞ্জ ভন পাপেনের হাত ছিল সবচেয়ে বেশী। তিনিই প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গকে রাজি করান হিটলারকে চ্যান্সেলর বানানোর জন্যে। এই গণতান্ত্রিক সরকারে পাপেন ছিলেন ভাইস চ্যান্সেলর।
হিটলার ক্ষমতায় বসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু একচ্ছত্র আধিপত্য তিনি তখনো পাননি। নাৎসি পার্টি একটি জোট সরকার নামক জালে আটকা পড়েছে এবং এই জাল থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত, হিটলারের স্বপ্নের একনায়কতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব নয়।
হিটলারের জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়ে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ, ১৯৩৩ সালের ৫ মার্চ জাতীয় নির্বাচন ডাকেন। নির্বাচনে হিটলারের লক্ষ্য ছিল, যে কোন উপায়ে পার্লামেন্টে দুই তৃতীয়াংশ আসন লাভ করা। এ জন্যে, নাৎসিরা তৎকালীন সময়ে নজিরবিহীন নির্বাচনী প্রচারণা চালায়। নাৎসি প্রোপাগান্ডা চীফ যোসেফ গোয়েবলসের কারণেই মূলত এটি সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এতে হিটলারের দুশ্চিন্তা কিছুমাত্র কমেনি।
হিটলারের ভোটের দরকার ছিল। আর এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে জার্মানির অন্য একটি দলকে ব্জনগণের কাছে ভিলেন বানিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। এক্ষেত্রে, বলির পাঠা বানানো হয় হিটলার এবং অধিকাংশ জার্মানদের চিরশত্রু তথা কমিউনিস্ট পার্টিকে। আর এই কমিউনিস্ট পার্টিকে ফাসানোড় জন্যেই, নাৎসিরা জার্মানির ঐতিহ্যবাহী পার্লামেন্ট ভবন পুড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
১৯৩৩ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী, রাতে, রাইখস্টাগ তথা জার্মান পার্লামেন্টের ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং এ জন্যে কমিউনিস্টদের দোষারোপ করা হয়।
পরের দিন হিটলার, প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ থেকে একটি "ইমার্জেন্সি ডিক্রি" সই করিয়ে নেন। এতে হিটলারকে রাষ্ট্রের প্রতি হুমকিস্বরূপ যে কোনো ব্যাক্তি, প্রতিষ্ঠান বা দলকে শায়েস্তা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। এই ডিক্রির জোরে, হিটলার জার্মানিতে অবস্থানকারী অধিকাংশ কমিউন্সিট নেতাকে আটক করেন।
রাইখস্টাগ অগ্নিকান্ড
****
হিটলার ভেবেছিলেন, কমিউনিস্টদের শায়েস্তা করার কারণে তার ভোট সংখ্যা বাড়বে এবং এভাবে তিনি পার্লামেন্টে দুই তৃতীয়াংশ আসন লাভ করবেন। কিন্তু তার সব পরিকল্পনা ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
এত কিছুর পরও তিনি ব্যর্থ হন। ১৯৩৩ সালের ৫ মার্চের নির্বাচনে হিটলার জয়ী হয়েছিলেন ঠিকই। ১কোটি ৭২ লাখ জার্মান তাকে সমর্থন প্রদান করেছিলেন। কিন্তু পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্যে তা যথেষ্ট ছিল না। যদিও এবার তিনি ৫০ লাখ ভোট বেশী পেয়েছিলেন কিন্তু এটি ছিল মোট ভোটারের ৪৪ ভাগ।
এত প্রোপাগান্ডা চালানোর পরও অনেক জার্মান, নাৎসিদের এড়িয়ে গেছে!
****
যদিও বা নির্বাচনে হিটলার স্বীয় লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিলেন, কিন্তু এতে তিনি ভেঙ্গে পড়েননি। তিনি জানতেন যে সাফল্য নিঃশ্বাস দূরত্বে আছে। রাখস্টাগে আগুন ধরানোর ঘটনাটিও পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি। এর মাধ্যমে, জীবন সায়াহ্নে অবস্থানকারী প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ থেকে একটি ডিক্রী পাস করানো তো গিয়েছে। ফলে রাষ্ট্রের প্রতি হুমকিস্বরূপ যে কোনো ব্যাক্তি, প্রতিষ্ঠান বা দলকে শায়েস্তা করা যাবে।
ডিক্রীর সাহায্যে হিটলার তার সমস্ত প্রতিপক্ষকে ইচ্ছা করলে ধ্বংস করে দিতে পারবেন।
****
ব্লগে যারা "আইন" বিষয়ে পড়াশুনা করছেন তারা নিশ্চই "enabling act" নামক শব্দযুগলের সাথে পরিচিত? সহজ কথায় বলতে গেলে, "enabling act" নামক বিশেষ আইনটি যাকে দেয়া হয়, তিনি চাইলে রাষ্ট্রের যে কোনো ধরণের আইন পরিবর্তন অথবা নতুন কোন আইন সংযোজন করতে পারবেন। চাইলে আইন পরিবর্তন করে তিনি একনায়ক হয়ে যেতে পারবেন। অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার পুরো দায়িত্ব আক্ষরিক অর্থে তার উপর বর্তাবে।
হিটলারের পরবর্তী পরিকল্পনা ছিল অতি সরল।
তা হল, "enabling act"টি কায়েম করা। কিন্তু এরকম একটি আইন পাশ করতে হলে পার্লামেন্ট সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশ ভোট প্রয়োজন। অনেকে বলতে লাগলেন যে, জাতীয় নির্বাচনে হিটলার যেমন দুই তৃতীয়াংশ সীট পেতে ব্যর্থ হয়েছেন, তেমনি একটি মহা শক্তিশালী ও গণতন্ত্র হরণকারী আইন পাশের ক্ষেত্রেও তিনি একই ভাবে ব্যর্থ হবেন। সাংসদরা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন।
কিন্তু হিটলারের এত কিছু ভাবার সময় ছিল না।
তার নিজস্ব একটি পরিকল্পনা ছিল। তার বিশ্বাস এই পরিকল্পনা কাজে দিবে। আর এটাই শেষ সুযোগ।
****
হিটলার জানতেন যে, জার্মানরা গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি বিরক্ত ছিল। দেশে তখন প্রায় ৬০ লাখ মানুষ বেকার।
অর্থনৈতিক মন্দা জার্মানদের কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। সেই সাথে ১ম বিশ্বযুদ্ধের ভার্সাই চুক্তির কারণে জার্মানদের সম্মান বলে আর কিছুই ছিল না। জার্মানরা মনে প্রাণে পুনঃজাগরণের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল। তাদের দরকার ছিল একজন নেতার। ১৯৩৩ সালের ৫ মার্চের নির্বাচনে ১ কোটি ৭২ লাখ জার্মান হিটলারের উপর আস্থা প্রদান করেছিলেন।
হিটলার এবার বাকি সব জার্মান জনগণের আস্থা অর্জনের পরিকল্পনা করেন।
****
১৯৩৩ সালের ২১ মার্চ, হিটলার ক্ষমতা লাভের জন্যে তার শেষ চাল চালেন। এই দিন জার্মানির পটস্ডাম নামক শহরের গ্যারিসন চার্চে নতুন পার্লামেন্ট তথা রাইখস্টাগের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গসহ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অসংখ্য জার্মান বীরদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। একজন উৎফুল্ল ও বিনয়ী হিটলার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সমস্ত অতিথিদের বরণ করে নেন।
পটস্ডাম গ্যারিসন চার্চ।
এই অনুষ্ঠানে বক্তৃতাদানকালে হিটলার বলেন, "গত কয়েকটি সপ্তাহ ছিল জার্মান জাতির জন্যে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা যথাযথরূপে আমাদের জাতীয় সম্মান বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছি। ধন্যবাদ জেনারেল ফিল্ডমার্শাল হিন্ডেনবার্গ। আজ সমগ্র জার্মানি জুড়ে পুরাতন ও নতুন শক্তির মাঝে এ শুভ মিলন উদযাপন করা হবে।
আমরা আপনাকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। দেশের জন্যে আপনার অবদান ভুলার নয় হের প্রেসিডেন্ট। আজ আপনার অবস্থান আমাদের সবার উপরে। "
এরপর হিটলার বক্তৃতা মঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আবেগাক্রান্ত হিন্ডেনবার্গের কাছে যান এবং তার হাতটি ধরেন এবং সম্মানের সাথে কুর্নিশ করেন। নাৎসি প্রোপাগান্ডা চীফ গোয়েবলস অনুস্থানটি পুরো বিশ্বে সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন।
সমগ্র বিশ্ব হিটলারের সাথে হিন্ডেনবার্গ তথা পুরো জার্মান অভিজাত শ্রেণীর এই মিলন প্রত্যক্ষ করেন।
হিন্ডেনবার্গকে কুর্নিশ করছেন হিটলার। আমি আমার আগের একটি লেখায় এই ছবিটিকে ভুল করে হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণের মুহূর্তের ছবি হিসেবে উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু আসলে তা নয়।
পটস্ডামের এই অনুষ্ঠানটি পুরোপুরি সফল ছিল।
কোটি কোটি জার্মান হিটলারের সাথে হিন্ডেনবার্গের এই আবেগঘন মুহূর্ত প্রত্যক্ষ করেছিলেন। জার্মানরা তাদের প্রিয় ফিল্ডমার্শাল হিন্ডেনবার্গকে ভালোবাস্তেন। আর এর প্রভাব নিশ্চিতভাবে নাৎসিদের পক্ষেই পড়েছিল। চারপাশে জোড় গুঞ্জন উঠছিল যে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। এর ফলে জার্মানির ভাগ্য পুরো পাল্টে যাবে।
গ্যারিসন চার্চের অনুষ্ঠানে হিটলার। তার সরাসরি ডানে পাপেন।
প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের সাথে হিটলার।
চার্চে বক্তৃতা দিচ্ছেন হিটলার। তার সরাসরি সামনে চেয়ারে বসা প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ।
অনেকে বলেন যে, হিটলারের বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট ভীসণ আবগাক্রান্ত হয়ে পড়েন।
****
দুই দিন পর ১৯৩৩ সালের ২৩শে মার্চ পুরো জার্মান জাতির ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছিল। এই দিন বার্লিনের ক্রল অপেরা হাউসে রাইখস্টাগের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনের শুরুতেই হিটলারকে "Enabling act" প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এই আইনকে অবশ্য সরাসরি "Enabling act" হিসেবে নামকরণ করা হয়নি।
"রাইখ ও রাইখের মানুষের দুর্দশা ঘুচানোর আইন" এই নামে নামকরণ করা হয়। আইন অনুযায়ী হিটলারকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা, বৈদেশিক রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি করার ক্ষমতা, সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা দেওয়া হবে। আইনটি হিটলারের উপর চার বছরের জন্যে বহাল থাকবে।
এরপর রাইখস্টাগে আইনটি পাশের জন্যে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। ৪৪১ জন পক্ষে, ৮২ জন বিপক্ষে।
স্পষ্টতই দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠটা এখানে অর্জিত হয়ে গিয়েছে। সমগ্র পার্লামেন্ট এবং পার্লামেন্টের বাহিরে নাৎসিদের উল্লাসধ্বনিতে রাইখস্টাগের কার্যক্রম কিছুক্ষণের জন্যে থেমে যায়।
উল্লাসধ্বনি থেমে যাবার পর আবার যখন কার্যক্রম শুরু হয়, তখন কিন্তু জার্মানি আর আগের জার্মানি নেই, সেই জার্মানি ছিল হিটলারের একান্ত নিজের। কঠোর সাধনা করেই তিনি তা পেয়েছিলেন। এবং আশ্চর্য বিষয় হল এই যে, তিনি তা অর্জন করেছিলেন বৈধ পদ্ধতিতে এবং দেশের অধিকাংশ জনগণের সমর্থনপুস্ট হয়ে।
(চলবে)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আমার লেখাগুলোর লিংক ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।