খুব জানতে ইচ্ছে করে...তুমি কি সেই আগের মতনই আছো নাকি অনেকখানি বদলে গেছো... অপ্রাপ্তির দোহা সম্মেলন: বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি?
হাসান কামরুল
নাটকীয়তা ও বহুনাটকীয়তার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে দোহা সম্মেলন। জাতি সংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয় আশয়কে চুলচেরা বিশ্লেষনের মাধ্যমে কার্বণ নিসরন কমিয়ে আনা ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অর্থনৈতিক সাহায্যের মাধ্যমে ক্ষতি পোষিয়ে আনার যে পরিকল্পনা নিয়ে দোহা সম্মেলন শুরু হয়েছিল তা প্রায় ভেস্তে গেছিল উন্নত বিশ্বের অনীহার কারণে। জাপান, চীন, ইন্ডিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো কিয়োটো প্রটোকলের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় এ সংক্রান্ত অনিশ্চয়তার মাত্রা বৃদ্ধি করেছে । কারণ এই ডিসেম্বর মাসেই বিদ্যমান কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ শেষ হতে চলছে । দোহা সম্মেলনের শেষ দিন কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ নতুন করে বৃদ্ধি করা নিয়ে উন্নত বিশ্ব দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য ২০২০ সাল পর্যন্ত কিয়োটো প্রটোকলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে অত্যন্ত নির্জীবভাবে। যদিও এ প্রটোকলে জাপান চীন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র বরাবরের মতো বাইরেই রয়েছে। এ দেশগুলো যদি কিয়োটো প্রটোকলে আসে তাহলে তাদেরকে কার্বণ নিসরন কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু তারা কার্বন নিসরন কমাবেনা তা আগেও বলেছে এখনো বলছে। ৩৫টি শিলোপান্নত দেশ কার্বন নিসরনে দায়ী।
এগুলোই গোটা পৃথিবীকে বিপদাগ্রস্ত করে তুলছে। জলবায়ুর বৈরিতার জন্য দায়ী। তারা ধনিক দেশ কিন্তু তাদের ধনতন্ত্রের কবলে শেষ হয়ে যাচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। উন্নয়নশীল দেশগুলো কার্বন পুড়ায়না কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। অর্থাৎ কার্বন পুড়াচ্ছে উন্নত বিশ্ব আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলো।
এসব উন্নয়নশীল দেশগুলো আবার উন্নয়নের ঢেকুর তুলে মোটা অংকের সাহায্যের জন্য উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর কাছে হাত পাচ্ছে। দোহা সম্মেলন, বালি সম্মেলন, ডারবান সম্মেলন, কোপেনহেগের সম্মেলন বা সামনে ব্রাজিলে জলবায়ু সংক্রান্ত যে সম্মেলন হতে যাচ্ছে তার মুল উদ্দেশ্যেই হচ্ছে উন্নত বিশ্ব থেকে আর্থিক ক্ষতিপুরণ আদায় করার কৌশলমাত্র। ধনিক দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিবে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে যেসব কুফলগুলো লক্ষনীয় তার বেশির ভাগই হচ্ছে বায়ুস্তরের ক্ষয় ওজোন স্তরের ক্ষয়ের কারণে সৌরালাকোর অতিবেগুনি রশ্মির ভূপৃষ্ঠে পৌছে যাবে। অতিবেগুনি রশ্মির কারণে পৃথিবীর জলজ প্রাণী এমনকি মানুষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যাবে।
এ ক্ষতিকর রশ্মির কারণে মানুষের বংশবিস্তার কমে যাবে এবং অনারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মরে যাবে । আর এভাবেই জলবায়ুর বৈরিতার কারণে লক্ষ কোটি বছরের বাস্তুসং¯হান চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অর্থাৎ এ অব¯হা চলতে থাকলে মানুষের কারণেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। বাস্তসং¯হানের চক্রবিধিতে যেমন বড়রা ছোটদেরকে খেয়ে ফেলে তেমনি এখন পৃথিবীর চক্রবিধি শুরু হয়েছে। এ চক্রবিধিতে ধনিক দেশগুলো গরিব দেশগুলোকে খেয়ে ফেলবে।
আর এ খাওয়া শুরু হয়েছে জলবায়ুর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। ধনিক দেশগুলো আরো ধনি হচ্ছে শিল্পোন্নত হতে হতে তারা অনুন্নয়ন দেশগুলোকে প্রতিনিয়ত বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আগামি ২০২০ সাল নাগাদ ১শত বিলিয়ন ডলার ছাড়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে দোহা সামিটে। এ ১শত বিলিয়ন ডলার দিয়ে শিল্পোন্নত বিশ্ব ১শত বিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বণ বাতাসে ছেড়ে দিবে। আর তাতে ১শত কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হওয়া থেকে শুরু করে রোগে শোকে ভুগে মরে যাবে।
বাংলাদেশের মতো যেসব দেশে নদীমাতৃক সেসব দেশ আগামি ১শত বছরে নদীর কোলেই মিছে যাবে। কিন্তু তাতে ধনিক শ্রেনীর দেশগুলোর কিছু আসে যায়না। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কার্বন পুড়ায় চীন, তারপর জাপান যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। পাশ্ববর্তী দেশ ভারত শতকরা ৬৮ ভাগ জ্বালানী চাহিদা পুরণ করে কয়লা সম্পদ থেকে। বলা হয়ে থাকে কয়লা পুড়ানোর কারণে কার্বন নিসরনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হয়।
কিন্তু ভারতের কার্বন নিসরনের কারণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত। যার প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশে আচড়ে পড়ছে। বাংলাদেশের জলবায়ুর যতোই ক্ষতি হোক ভারত কি কার্বন পুড়ানো থেকে সরে আসবে? আসবেনা এ প্রশ্নের সহজ সরল উত্তর। ভারত এশিয়া অঞ্চলের নেতৃত্বে আসতে চায়। এ জন্য ভারতে প্রয়োজন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অন্যতম শর্ত হচ্ছে জ্বালানী চাহিদা ও নিরাপত্তার সামাঞ্জস্য করা। ভারতের মোট উৎপাদিত বিদ্যুত ও চাহিদার মধ্যকার ব্যবধান এখনো প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট। এ শর্টেজ নিয়েও ভারত ৪৭ শতাংশ নাগরিকে বিদ্যুতের জোগান দিয়ে যাচ্ছে। ভারতের টার্গেট আগামি ২০২০ সালের মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনা । তাই ভারত ক্রমশই ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার আরো বাড়িয়ে দিবে এ কথা নিদ্বির্ধায় বলা যায়।
সেক্ষেত্রে জলবায়ুর পরিবর্তন আমলযোগ্য নয়। অন্যদিকে চীন উদিয়মান শক্তির মধ্যে অগ্রগন্য। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কয়লা সম্পদের মজুদ রয়েছে চীনে। এখানে জ্বালানী অন্যতম উৎস হচ্ছে কয়লা। আর কয়লা নির্ভর চীনের অর্থনীতিও কয়লা পুড়ানো থেকে বিরত থাকবেনা ।
জাপানের অব¯হান কৌশলগতভাবেই ভিন্ন। জাপান এমন একটি দেশ যাদের নিজস্ব কোন প্রাকৃতিক সম্পদের আধার নেই। অতচ জাপান ধনিক দেশগুলোর মধ্যে সর্বাধিক্যে রয়েছে। জাপানের মোট জ্বালানী শক্তির প্রায় সবটুকুই আমদানি নির্ভর। জাপান যদি এই মহুর্তে ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার কমিয়ে আনার ঘোষণা দেয় তাহলে অর্থনৈতিক ভীতে দারুন এক ধাক্কা লাগবে।
কারণ ফসিল ফুয়েল আমদানির লক্ষ্যে মাল্টি ট্রিলিয়ন ডলারের জাপানি বিনিয়োগ রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। নবায়নযোগ্য জ্বালানীর বিনিময়ে জাপানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। হয়তো আস্তে আস্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানীতে ফিরবে সেটাও সময়ের ব্যাপার। প্রচলিত জ্বালানীর বাইরে যেতে চায়নি বলেই জাপান কিয়োটো প্রটোকলের আওতাভুক্ত হতে আগ্রহী নয়। উদিয়মান শক্তি হিসেবে চীন ও ভারতেরও একই অব¯হান।
যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে কিয়োটো প্রটোকলে যোগ দিয়ে উন্নত বিশ্বের রোষানলে পড়তে চায়নি। শিল্পোন্নত দেশগুলোকে নেতৃত্ব দিতেই প্রটোকলের বাইরে থেকে কৌশলগত অব¯হানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনেও খুব জোরালোভাবেই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তীত বিশ্ব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এমনকি ঘূর্নিঝড় স্যান্ডির আক্রমনের ফল যে জলবায়ুর ওষ্ঠাগত আচরন তা আমেরিকার প্রেসিডেন্টও স্বিকার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র কিয়োটো প্রটোকল মানেনা আবার ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে প্রভাব মোকাবেলায় ১শত বিলিয়ন ডলার ছাড়ে ওকালতিও করেছে।
যাই হোক দোহা সম্মেলনে যেটুকু প্রাপ্তি তা হলো ২০২০ সাল পর্যন্ত কিয়োটো প্রটোকলকে টিকিয়ে রাখা গেছে। সেই সঙ্গে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১শত বিলিয়ন ডলার ছাড়ের ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে পৌছানো গেছে। যা মন্দের ভাল বলে অনেকেই অভিহিত করেছে। কিন্তু বিস্তরভাবে এ সম্মেলন থেকেও যতোটুকু আশা করা গেছে তার সামান্যটুকুও অর্জিত হয়নি। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো অধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে জলবায়ুর প্রভাব থেকে কিভাবে রক্ষা করা যায় এ ধরনের জরুরি বিষয়কে এ সম্মেলনে অগুরুত্বপুর্ণ ইস্যু হিসেবে দেখা হয়েছে।
কেবল আর্থিক বরাদ্দ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে তবে এ বরাদ্দ কিভাবে দেয়া হবে কতো দ্রুত দেয়া হবে তার কোন সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ চুড়ান্ত হয়নি। মুলত জলবায়ু সম্মেলনের নামে কালক্ষেপনের যে খেলা শুরু হয়েছে তা কবে কোথায় গিয়ে শেষ হবে তাও কেউ জানেনা।
হাসান কামরুল: জ্বালানী ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।