আজ আমার জন্মদিন। সাতাশ মার্চ উনিশশো বাহাত্তুরে আমার জন্ম। হিসেবমতো এই দু হাজার বারোতে আমার বয়স হলো চল্লিশ। অথচ আমার শরীরে এখনও উন্মাতাল যৌবনের পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। আবার অন্যান্য মেয়ের তুলনায় আমার শরীরে যৌবন এসেছিলও বেশ আগে।
আমার যখন দশ বছর বয়স তখনই একদিন আমার জামার পেছনদিকটায় লাল ছোপ দেখে মা আমার বাম হাতটা খপ করে ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে ঘরের এক কোণায় নিয়ে এলেন। তারপর ঠাস ঠাস করে আমার দুই গালে দুটো চড় মেরে বলে উঠলেন, বেহুঁশ বেলাজ ছেমরি। আমি কিছু বুঝতে না পেরে ভ্যালভ্যাল করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মা নির্মম হাতে ফস করে আমার ইজেরটা কোমর থেকে প্রায় টেনে ছিঁড়ে খুলে আনলেন। তারপর দুই রানের ফাঁকে ন্যাকড়া গুঁজে দিতে দিতে কেমন সাপের মতো হিস হিস করে বলে উঠেছিলেন, এডা বদরক্ত।
তর শইল ভরা বদ রক্ত। তর শইল্যের বেবাক বদ খুন বাইরাইয়া যাউক। তুই মর, মর।
আমি তখন মায়ের কথার আগামাথা কিছুই বুঝিনি। আমি ভেবেছি আমি জামাকাপড়ে রক্ত মাখিয়ে ভয়ানক অপরাধ করে ফেলেছি।
কিন্তু আমার দুপায়ের ফাঁক দিয়ে কেন কলের মতো লাল টকটকে তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল তা বুঝতে না পেরে ভয়ে আমি বুকফাটা চিৎকার দিয়েছিলাম। তাতে মা এক হাতে আমার মুখ চেপে ধরেছিলেন আর আর এক হাত রেখেছিলেন আমার গলায়। আমার নরম গলার চামড়ায় বসে যাচ্ছিলো মায়ের শক্ত আঙুল। দম আটকে গিয়ে আমার হেঁচকি উঠতে থাকে। আর মার গলাও যেন কেউ চেপে ধরেছে - এমনি ঘরঘর করে বলতে থাকেন, মইরা যা।
মইরা যা।
কিন্তু আমি মরি না। মা আমার গলা ছেড়ে দিয়ে আমাকে যত্ন করে কোমরে সুতলি পেঁচিয়ে ন্যাকড়া বাঁধা শিখিয়ে দেন।
আর শিখিয়ে দেন কীভাবে আমার তিনকোণা অঙ্গটিকে লুচ্চা বদমাশদের কাছ থেকে সাবধানে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নয় তো সুযোগ পেলেই না কি কোনো খানকুত্তা এসে আমার ওখানে পাকিস্তান ঢুকিয়ে দেবে।
খানকুত্তারা নাকি সব সময় জন্মায়।
সেই দশ বছর বয়সে আমি মায়ের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারিনি। কিন্তু একটা জিনিস বুঝেছিলাম কোনো কারণে আমার ওপর মায়ের প্রচণ্ড রাগ। সেই রাগটা কখন কীভাবে মাকে আছর করবে জানি না, কিন্তু যখন করবে, তখন মা আমাকে বঁটি দিয়ে জবাই করে ফেলবেন অথবা গলা টিপে মেরে ফেলবেন।
সেই দশ বছর বয়সেই আমি বালেগ হয়ে গেলাম।
আর আমার সারা শরীরে যেন একসাথে যৌবনের হাট বসে গেল।
প্রতি মাসে আমি রানের ফাঁকে ন্যাকড়া বাঁধতে বাঁধতে দেখি আমার শরীর কেমন জায়গায় জায়গায় ফুলে উঠছে।
বুকের দুপাশে তপ্ত দুটো আগুনের গোলা জায়গা করে নিলো।
আমার গায়ের চামড়া আগুনি রাঙতার মতো চিকচিক করতে লাগলো।
আঙুলগুলো মসৃণ ফুলের কলির মতো টসটসে হয়ে উঠলো।
নখের তলায় টলটলে রক্ত শিরশির করে নড়চড়া করতে থাকলো।
চুলগুলো ঘন হয়ে সাপের মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে আমার কপালে চোখেমুখে দুলতে শুরু করলো।
আমার চোখের তারায় কেমন অচেনা নীল রঙ।
ভুরুর লোমে কুচকুচে কালো ভয়াবহ দুটো সুঁয়োপোকা পিঠ উঁচিয়ে বসে গেল।
দু বছরের মধ্যেই আমার মাথাটা ধাঁ করে যেন ঘরের চালা ছুঁয়ে ফেললো।
আয়নায় নিজেকে দেখে আমি অবাক হয়ে যেতাম। মনে হতো আমার শরীরটা যেন আমার নয়। অচেনা একজন কেউ এসে আমার শরীর দখল করে ফেলেছে। আশেপাশে আমার সমবয়সী কোনো মেয়ের সাথেই আমার কোনো মিল নেই। ভয়াবহ সুন্দরী ঐ বালিকাকে আমার নিজের কেউ বলে মনে হতো না।
আমার শরীরের এই পরিবর্তনের পর আমার ওপর মায়ের রাগটাও এক অদ্ভুত পরিবর্তিত রূপ নিলো। মা আমার দিকে প্রায়ই কেমন শূন্য আর ঘোলা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন।
হঠাৎ করে বলতেন, তুই কে? কে রে? তুই মর। মর।
মায়ের চেহারা দেখে আমি ভয়ে কেঁদে ফেলতাম।
শব্দ না করে কাঁদতাম। আমার চোখ দিয়ে গরম অশ্র“ গড়িয়ে পড়ে মায়ের গাল ভাসিয়ে দিতো। মা আমাকে তাঁর বুকের সাথে লেপটে ধরে রেখে জোরে জোরে শ্বাস নিতেন। ধীরে ধীরে আমার ভয় কেটে যেতো।
আমি ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম, মা আমাকে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভালোবাসেন।
মায়ের মাথার ভেতর বা বুকের ভেতর বা মনের ভেতর কোথাও একটা অসুখ আছে। অসুখটা মাকে মাঝে মাঝে আউলা করে দেয়। তখন মা আমাকে ঐ সব বলেন। কিন্তু মা আমাকে ভালোবাসেন। পাগলের মতো ভালোবাসেন।
মায়ের পৃথিবীতে আমি ছাড়া কেউ নেই। আমার পৃথিবীতেও মা ছাড়া কেউ নেই। আমার বাবা নেই। ভাই বোন নেই। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কেউ নেই।
ছোট বেলায় আমি কিছুদিন স্কুলে পড়েছি। কায়দা সিপারা বুকে নিয়ে মসজিদে গিয়েছি। কিন্তু কেন যেন কিছুদিন পরেই দেখতাম মাস্টাররা আমার দিকে কেমন করে তাকায়। আমার সহপাঠিরা আমাকে বলে, ঐ তুই নাকি জাউরা। মসজিদের মৌলবী আমাকে একদিন আদর করে তার কোলে বসিয়ে আমার বুক হাতাতে হাতাতে বলে, তুই ডাঙ্গর হইয়া যাইতাছস।
আমি টের পাই মৌলভীর কোল থেকে আমার তিনকোণার ফাঁকে একটা শক্ত দণ্ড ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
আমি ভয় পেয়ে মৌলভীকে ধাক্কা মেরে বাড়ি চলে আসি। মাকে বলি, মৌলভী আমার ভেতরে পাকিস্তান ঢোকাবার চেষ্টা করছিলো। মা আমার মসজিদে যাওয়া বন্ধ করে দেন। সহপাঠীদের উক্তি শুনে আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন।
তারপর মা তাঁর ঘরে গড়ে তোলেন স্কুল। সেই স্কুলে একজন মাস্টার। একজন ছাত্রী। আমি আর মা, মা আর আমি। এই হলো আমাদের পরিচয়।
চল্লিশ বছর ধরে আমরা যাপন করছি এক অদ্ভুত যুগল জীবন। আমার বিয়ে হয়নি। আমার মতো একজন ভয়াবহ সুন্দরী মেয়ের বিয়ে হবে না, এটা ভাবা যায় না। মা-ই আমাকে বিয়ে দেননি। মা রটিয়ে দিয়েছিলেন আমার ওপর জিনের আছর আছে।
জিনের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। জিন আমার সাথে সহবাস করে বলে আমার গায়ের রঙ এমন আগুনের মত। আমার চোখ এমন রঙদার। আমার চুলে এমন সর্পকুণ্ডল।
আমি একদিন একটা নতুন শাড়ি পরে কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে রঙ্গ করে বললাম, মা দেখো, আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
সত্যি বিয়ে।
মা আমার দিকে কতক্ষণ ভূতে-পাওয়া রোগীর মতো ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে থাকেন। তারপর আচমকা মেঝেতে হাত ঘসে ধুলোমাটি তুলে আমার মুখে মাখিয়ে দিতে দিতে আমাকে চাপটাতে থাকেন। মায়ের গলা থেকে সেই অতিচেনা ঘরঘর শব্দটি বের হয় Ñ তর বিয়া অইবে না। কুনুদিন বিয়া অইবে না ।
তুই মর। তুই মর। তর শইল্যে বদ রক্ত। এই রক্তের বংশ অইবে না।
ততদিনে মায়ের এইসব কথা আমার কাছে আর অর্থহীন মনে হতো না।
আমি বুঝতে পারতাম, মায়ের এক সত্তা অদ্ভুত ঘোর নিয়ে আমাকে ভালোবাসে আর এক সত্তা প্রচণ্ড ঘৃণায় আমাকে প্রতি মুহূর্তে ধ্বংস করতে চায়। মায়ের ভুবনে আমি ক্রমাগত জন্ম নিই আর মৃত্যুবরণ করি। মায়ের ইশকুলে পড়তে পড়তে, ভিন্ন চেহারা, ভিন্ন অবয়বে ভয়ঙ্করী সৌন্দর্য নিয়ে বড় হয়ে উঠতে উঠতে আমি জেনে যাই আমার বদ রক্তের ইতিহাস।
একাত্তরে আমার মায়ের বিশ বছরের কুমারী দেহে খানকুত্তারা ছয় মাস ধরে ক্রমাগত পাকিস্তান ঢুকিয়েছে। মা ছিলেন বরিশালের পিরোজপুরের মেয়ে।
মায়ের নাম ছিলো রানী। রানীগঞ্জের রানী। মায়ের গ্রামের নাম ছিলো রানীগঞ্জ।
একাত্তরে মা ছিলেন কলেজের ছাত্রী। মায়ের মাথা ছিলো খুব ভালো।
মায়ের অঞ্জলি দিদিমনি মাকে ডাকতেন বুদ্ধিরানী। মায়ের বড় ভাই বাশেত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই গেরিলা ট্রেনিং নিতে মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে সুন্দরবন চলে যান। আশেপাশের গ্রামের অনেক তরুণ যুবকই সেই দলে ছিলেন।
রাজাকারদের মাধ্যমে এই খবর জানতে পেরে পাকিস্তানী সৈন্যরা পিরোজপুর আক্রমণ করে। ওরা মানুষ মারার উৎসব শুরু করে।
গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। শত শত তরুণ যুবক, আর নামীদামী শিক্ষিত জ্ঞানী মানুষদের ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারে। নানান জায়গায় গণকবর উঠতে থাকে। নদীর স্রোতে বয়ে যেতে থাকে নারীপুরুষের লাশ।
মায়ের অঞ্জলি দিদিকে ওরা জীবন্ত পুড়িয়ে মারে।
হিন্দুপাড়াগুলো জ্বালিয়ে ছাই করে দেয়।
মায়ের বাবা মা ছোট দুই যমজ ভাই আর সত্তুর বছরের বৃদ্ধ দাদাকে এক দড়িতে বেঁধে পাক সেনারা বলেশ্বর নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলে।
মাকে ওরা মারে না। তবে বাবা-মা-ভাই-দাদার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড মাকে দেখতে বাধ্য করে ওরা। মা যাতে ভয়ে ওদের বাধ্য থাকে।
মা অনেকদিন কথা বলতে পারেন না। ঘুমাতে পারেন না। বলেশ্বরের টকটকে লাল জলের স্রোতের ঘূর্ণিতে মায়ের দিনরাত দুলতে থাকে।
জুন মাসের শেষ দিকে মা বন্দী হন ওদের ক্যাম্পে। মায়ের সঙ্গে আরও কয়েকজন নারী।
এদের কারুর বয়স মায়ের মায়ের সমান, কেউ বা একেবারে বালিকা। কাউকে ওরা রেহাই দিতো না। কোনো আড়ালেরও ওরা ধার ধারতো না। যাকে খুশি যখন খুশি, কখনো একজন, কখনো দুজন, কখনো চারপাঁচজন একসাথে ধর্ষণ করতো। অন্য সবার সামনেই।
ছবি নামে পনের বছরের একটা বাচ্চাকে ওরা পাঁচজনে মিলে ধর্ষণ করে মেরেই ফেললো। ছবির আর্তনাদ শুনে মা ওদের দিকে থুতু ছুঁড়ে পাকিস্তানী কুত্তা বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন। আর সে কারণে মাকে ওরা কখনো একজনে অত্যাচার করতো না। করতো দল বেঁধে। ওরা বারবার মার শরীরে পাশবিক উল্লাসে প্রবেশ করতো।
ওরা মায়ের শরীরের সমস্ত রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাকিস্তান ঢোকাতো।
ছয়মাসের মাথায় মায়ের পেট ফুলে উঠলো। রক্তশূন্যতা আর পুষ্টিহীনতায় মা লিকলিকে নির্জীব একটা জড়বস্তুতে পরিণত হলেন। এক ¯তূপ ন্যাকড়ার মতো মা মেঝের এক কোণে পড়ে থাকতেন। হয়তো এ কারণে মায়ের ওপর ওদের শারীরিক অত্যাচার বন্ধ হলো।
ওরা মায়ের উন্মুক্ত ফোলা পেটের ওপর জুতোর কালি দিয়ে লিখে দিলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ। মা বড় বড় নখ দিয়ে খামচে সেই লেখা কুচি কুচি করে কাটেন। মা তার পেটটাকে চিরে ফেলতে চান। দীর্ঘদিন না কাটার ফলে মায়ের নখগুলো ছুরির ফলার মতোই ধারালো হয়ে উঠেছিলো। মা পেটের চামড়ার ভেতরে আমূল ঢুকিয়ে দেন দুই তর্জনীর তীক্ষè নখের ফলা।
কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার কী হয় কে জানে, আমি হাতপা ছুঁড়ে চিৎকার করে উঠি।
আমি! হ্যাঁ, আমিই তো! মায়ের পেটের ভেতরে তো আমারই ভ্রূণ বড় হচ্ছিল! আমি মায়ের পেটের দেয়ালে মাথা ঠুকে বলি না, না, না! না মা না!
প্রতি জন্মদিনে মা আমার মুখের দিকে অদ্ভুত চোখে চেয়ে থাকেন।
তাঁর তলপেট উদলা করে সেখানে ডান হাতের পাতা রেখে আমার দিকে তাকান। তখন মায়ের এক চোখ থেকে ভয়াবহ আগুনের শিস উঠতে থাকে। আর এক চোখ থেকে ঝরতে থাকে পানি।
মা বলেন, প্যাটটা র্চিরা ফালায়া আমি ঘিন্নার জীবনডা দিয়া দিমু, হেই সুমায়ে আমার প্যাডের ভিতরে লইড়া উঠলো একটা য্যান কী!
আমি, মা, আমি নড়ে উঠেছিলাম! মাথা ঠুকেছিলাম তোমার পেটের দেয়ালে!
কিন্তু মাকে আমি এসব কিছু বলি না। একটা গোক্ষুর সাপের মতো ফণা দুলিয়ে মা আমাকে যেন বশ করে ফেলেন সেই সময়টায়। আমি চুপ করে বসে ছোবল খাওয়ার অপেক্ষায় থাকি। মা আমার মুখের চামড়ায় আদুরে স্পর্শ দিতে দিতে একসময় আমার গলা চেপে ধরেন।
ঘরঘর করে ওঠে মায়ের কণ্ঠ Ñ আরও এক বছর বাইচ্যা রইলি তুই! তুই মর! মর! মর!
তারপর মা তার পেটের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকেন।
মায়ের পেটটা যেন ধীরে ধীরে ফুলতে শুরু করে। পেটের ভেতর থেকে গুমগুম করে ধ্বনি উঠতে থাকে। সে যেন একটা দুন্দুভি। ধীরে ধীরে সেই ধ্বনি দিক থেকে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। সাত আসমান ভেদ করে সেই ধ্বনি একটা বিশাল কামানের গোলার মতো ছুটে যায়।
মা চিৎকার করে আমার জন্মকাহিনী শোনান।
পেটের ভেতর একটা অনাগত ভ্রƒণের নড়ে ওঠার সেই অদ্ভুত অনুভূতিতে মা কেমন দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। অদ্ভুতভাবে মায়ের মনে হয়েছিলো, তাঁর শরীরের ভেতরে পাকিস্তান নয়, স্বাধীনতা নড়ে উঠছে।
মায়ের সমস্ত সম্ভ্রম, অতুলনীয় সৌন্দর্য, অমূল্য কৌমার্য, অন্তহীন লজ্জা দুঃখ বেদনা আর জীবনীশক্তি এক হয়ে প্রাণ পেয়েছে এই ভ্রƒণ।
মা তার পেটটাকে মমতায় আঁকড়ে ধরেন। আমার কুমারী মা স্বাধীনতাকে জন্ম দিতে মানসিক প্রস্তুতি নেন।
নভেম্বরের দিকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণে পিরোজপুরের পাকঘাঁটিগুলো বিধ্বস্ত হতে থাকে।
অবস্থা বেগতিক দেখে হাইস্কুলের ক্যাম্পে আটক বন্দী নারীদের মুক্ত করে দেয় ওরা।
গভীর রাতে মা যখন তার কেড়ে নেয়া শাড়িটা পরে ফের আকাশের তলে এসে দাঁড়ালেন তখন মায়ের আগে দাঁড়ালো তাঁর পেট।
ততদিনে মায়ের পেট বিশাল এক জয়ঢাক। কিন্তু সেই ঢাক থেকে জয়ধ্বনি ওঠে না। বুক ভরে মুক্ত বাতাস টেনে নিতে গিয়ে মায়ের দম আটকে আসে। সারা শরীর ভারী। মায়ের মনে হতে থাকে পেট ফেড়ে একটা কুৎসিত জন্তু যেন বেরিয়ে আসবে।
চাঁদের আলোয় ফোলা পেটের এক নারীর একটি ভুতূড়ে ছায়া দেখে মায়ের শরীর শিউরে ওঠে। মা তাঁর কুমারী উদরে একটা পাকিস্তান বহন করে বাড়ি ফিরে যাবেন! না!
তারপর মা একটা কাণ্ড করেন। নদীর নির্জন পাড়ে উঁচু থেকে বারবার দৌড়ে নিচে নামাওঠা করতে থাকেন। পাগলের মতো লাফাতে থাকেন মা। পেটের পিণ্ডটা বেরিয়ে যাক।
ঘৃণিত একটা রক্তপিণ্ড। জঘন্য! কদর্য! ধর্ষণের কুৎসিৎ আর ভয়াবহ স্মৃতিগুলো মাকে চাবকাতে থাকে। ঘৃণিত পিণ্ডটাকে নদীর জলে ডুবিয়ে মা নিজেকেও নদীতে ধুয়ে মুছে সাফ করে নেবেন। আমি মায়ের পেটের দেয়ালে মাথা কুটে বলি না, না, না মা না!
মা লাফানো থামান। পেটের ওপর তাঁর ঠাণ্ডা শীর্ণ আঙুলগুলো চেপে ধরেন।
আমি বলি, হ্যাঁ মা, হ্যাঁ!
মা একটি লঞ্চে চেপে বসেন। তাঁকে চলে যেতে হবে দূরে। অচেনা জায়গায়।
আমি জন্ম নিলাম খুলনার একটি গ্রাম্য ছোট্ট মাতৃসদনে। মায়ের কোলে তোয়ালে জড়ানো শিশুকে তুলে দিতে দিতে নার্স বললেন, রক্তজবার মতো টুকটুকে মেয়ে হয়েছে।
এর বাবা খুব সুন্দর বুঝি!
মায়ের হঠাৎ মনে হয় তোয়ালের ভেতরে পেঁচানো আছে বিড়া পাকানো সাপ। মা শিউরে উঠে আমাকে মেঝেতে ফেলে দেন। নার্স ভাবে অসাবধানে পড়ে গিয়েছে। সে তরুণী জননীকে শিশু কোলে নেবার আর স্তন্য দেবার কায়দাকানুন শিখিয়ে দেয়।
সেদিন সন্ধ্যায় মা হাসপাতাল থেকে আমাকে নিয়ে পালিয়ে আসেন।
সন্ধ্যার আঁধারে গোরস্তানের জঙ্গলে আমাকে রেখে মা চলে যান।
আমি তোয়ালের ভেতর থেকে গলা ফাটিয়ে চেঁচাই না, না, না মা না!
আমার সাথে সাথে ভাঙা কবরের গর্ত থেকে চেঁচিয়ে ওঠে একপাল শেয়াল। মা আবার আমাকে কোলে তুলে নেন।
আমি বলি,হ্যাঁ মা, হ্যাঁ!
আমি মায়ের দুই বুকের মাঝখানে মাথা ঠুকতে থাকি। মা তাঁর ময়লা জামাটি খুলে ফেলে দেখেন বুকের দুপাশে দুটি তরল জোছনার মতো দুধ-ভরা চাঁদের বাটি ঝলমল করছে।
মা আমাকে নিয়ে আরও দূরে পালিয়ে যান। আমার এই চল্লিশ বছরের জীবনে মা আমাকে নিয়ে কতবার কত জায়গায় পালিয়েছেন তার কোনো হিসাব নেই। সুন্দরবনের বাঘিনীর মতো মা আমার ঘাড়ের চামড়া কামড়ে ধরে যেন এক ভয়ের জায়গা থেকে আর এক নিরাপদ জায়গায় যেতে থাকেন। বনে জঙ্গলে গ্রামে জনপদে শহর-উপান্তে Ñ কত জায়গায় আমাদের যুগলবন্দী জীবন কেটেছে। এই যুগলবন্দী আক্ষরিক অর্থে বন্দী।
আমি আর মা ঘর থেকে বের হতে গেলেই কালো বোরখায় নিজেদের মুড়ে নিই। আমার মা কাউকে নিজের মুখ দেখাতে চান না। কেউ যেন মায়ের কথা জানতে না পারে। আমিও আমার মুখ কাউকে দেখাতে চাই না। আমার কুৎসিত জন্মপরিচয় যেন কেউ জানতে না পারে।
আমরা দুজন শুধু দুজনের মুখ দেখি। কিন্তু তারপরেও শেষ রক্ষা হয় না। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে অজ্ঞাত মুক্তিযোদ্ধা অনুসন্ধান প্রকল্পের একটি দল গত বছর কী করে যেন আমাদের কথা জেনে ফেলেছিলো। এই এক বছরে ওঁরা আমাদের সাকিন খুঁজে বের করে ফেলেছে। আজ ওঁরা আসবে আমাদের কথা শুনতে।
আমাদের দুজনকে নিয়ে ওঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবেন। মায়ের জন্য পদক আদায় করবেন। আমাকে নিয়ে হবে প্রামাণ্যচিত্র। আরও অনেক কিছু।
আজ আমারও চল্লিশ বছর পূর্তি।
আমাকে জন্ম দেবার আগে মায়ের মনে হয়েছিলো তিনি স্বাধীনতার জন্ম দেবেন! আমি কি স্বাধীনতা? না কি আমি কদর্য কুৎসিত ঘৃণ্য এক প্রেতাত্মা?
আমার জন্মদিনের অনেকখানি সময় পেরিয়ে গেছে। মা এই দিনে আমাকে তাঁর কাছে বসাবেন। মুখের চামড়ায় হাত বুলিয়ে ঘোরলাগা চোখে চেয়ে থাকবেন আমার মুখের দিকে। তারপর একসময় তাঁর গলার ভেতর থেকে ফুঁসে উঠবে সাপ। আমার কণ্ঠনালী চেপে ধরে মা চিৎকার করে উঠবেন, তুই কে? কে রে? আরও এক বছর বেঁচে গেলি! তুই মর! তর শইল্যে বদ রক্ত! আমি সেই মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করি।
কিন্তু মা, আমার সাপিনী মা, আমার বাঘিনী মা, আমার কুমারী মা এখনও আমার কাছে আসেননি। সকাল দশটার উজ্জ্বল আলোয় চারপাশ ঝলমল করছে। আমি আয়নার সামনে দাঁড়াই। আরও এক বছর বেঁচে যাওয়া চল্লিশ বছরের এক নারী! তার মুখে এখনও ভয়াবহ সৌন্দর্য! এই সৌন্দর্য দিয়ে আমি কী করবো? এই বেঁচে যাওয়া নারীকে নিয়ে আমি কী করবো! আমি কী অনন্তকাল এই রকম করে বেঁচেই যাবো? আমি আর কতকাল আমার দুই রানের ফাঁকে বদ রক্ত গড়িয়ে পড়তে দেখবো? আমি কি এক বিষাক্ত রক্তজবার গাছ? বদ রক্ত থেকে ক্রমাগত আমি রক্তজবা ফুটিয়েই যাবো?
আমি ধীরে ধীরে মায়ের ঘরে আসি।
মা আমাকে দেখে অদ্ভুত চোখে হাসেন।
বলেন, তারা কুন সুমায় আইবো? বিকালে?
তারা মানে অনুসন্ধান প্রকল্প দল।
আমি সে কথার উত্তর না দিয়ে বলি, মা আজ আমার জন্মদিন! আমাকে কী দেবে?
মা কোনো কথা বলেন না। তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে। মা আচমকা বিছানার এক পাশ থেকে বিশাল একটি বঁটি আমার মাথার ওপর উঁচু করে ধরেন।
আমার বাম হাত মুহূর্তে মায়ের বঁটিসহ হাতটি ধরে ফেলতে চায়।
আর ডান হাত দিয়ে আমি নিজের কণ্ঠনালীর কাছে উদ্যত করে ধরি গোপনে কিনে আনা একটা ছোরা।
আমি জানি না কোন অস্ত্রটি কার্যকর হলো। তবে আমার গলা জড়িয়ে রাখা অজস্র সাপের কুণ্ডলির মতো কোঁকড়া চুলের ঘূর্ণিগুলো আচমকা জ্বলে ওঠে। আমি টের পাই, সেখান থেকে অজস্র বিষাক্ত রক্তজবা আমার মায়ের পায়ের কাছে ঝরে যাচ্ছে।
১১.১২.১২
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।