লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। মধুর কলহ
মোহাম্মদ ইসহাক খান
আমি এখন একা।
বিবাহিত পুরুষ আমি।
বলা ভাল, বিবাহিত ছিলাম। এখন বিবাহিত এবং অবিবাহিত অবস্থার মাঝামাঝি অবস্থায় ঝুলে আছি।
আমার স্ত্রী দু'দিন হয় আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
অবশ্যই কারণ ছাড়া যায় নি। শিক্ষিত পরিবারে "ব্যক্তিত্বের সংঘাত" অতি পরিচিত দৃশ্য।
এটা নিয়ে কলহ হয়ে কত পরিবার ভেঙে গেছে এবং যাচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। হয়তো স্বামী স্ত্রীকে কিছু বলেছে, স্ত্রী চলে গেল। আমি শিক্ষিত মেয়ে, আমাকে বাজে কথা বলে? আমি তোমার চেয়ে কম কীসে? তেমনি উল্টো ঘটনাও ঘটে। স্ত্রী হয়তো স্বামীকে খোঁটা দিয়ে কিছু একটা বলেছে, স্বামী বলেছে, আর একসাথে থাকা সম্ভব নয়। তুমি এবার তোমার রাস্তা মাপো গিয়ে।
সন্তান থাকলে এসব ক্ষেত্রে কিছুটা ঝামেলা হয়। দুজনই সন্তানকে নিজের কোলে টানতে চায়। কারণ দুজনেরই ধারণা, "তার সন্তান" এই মর্কট মার্কা পিতা কিংবা মাতার সাথে থাকলে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার, অনিশ্চিত, নৈরাশ্যের গহ্বরে নিপতিত। কাজেই সন্তানকে নিয়ে চলে টানাহেঁচড়া। একটি সন্তান হলে তো আরও খারাপ অবস্থা, পারলে দুজন সন্তানকে দু'টুকরো করে নেয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব "তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কলহ" সম্পর্কচ্ছেদে গড়ায়।
আমার স্ত্রী সবসময় আমাকে বকাঝকা করতো। যেকোনো কিছু নিয়ে শুরু হয়ে যেত ঝগড়া। সকালে ঘুম থেকে দেরী করে ওঠা তার পছন্দ নয়, অলসভাবে দিনাতিপাত করা তার পছন্দ নয়, বন্ধুবান্ধব নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দেয়া তার পছন্দ নয়, বাজার থেকে যে পচা মাছ কিনে আনি সেটা তার পছন্দ নয়। কাজেই সে আমাকে প্রায়ই যেটা বলতো তা হল, আমি বলেই তোমার মতো অপদার্থের সংসার টেনে যাচ্ছি, অন্য কেউ হলে লাথি মেরে চলে যেত।
আমাদের প্রেমের বিয়ে। জ্ঞানী লোকেরা বলেন, প্রেম এবং বিয়ে অত্যন্ত আনন্দময় ব্যাপার, পরবর্তীতে একসাথে থাকতে গিয়েই যত ঝামেলার সমস্যা শুরু হয়। কাজেই অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক তিক্ততায় রূপ নিতে কয়েক মাস সময়ই যথেষ্ট ছিল।
অত্যন্ত ধৈর্যশীল মানুষ আমি। সাত চড়ে রা করি না।
কাজেই স্ত্রীর খোঁটা আমি অনেকদিন ধরে নীরবে সয়ে গেছি। কিন্তু একদিন আর সহ্য হল না। সুখী পরিবার হল সেই পরিবার, যে পরিবারে স্ত্রী বলে আর স্বামী শোনে। যেদিন স্বামী মুখ খোলে, সেদিনই সংসারের হুড়মুড় করে ভেঙে পড়া আরম্ভ হয়।
আমি উচ্চস্বরে বললাম, মানলাম আমি খুব খারাপ।
বেশ ভাল কথা। তুমি তাহলে আমার থেকে ভাল কোন স্বামী খুঁজে নাও গে। এখানে পড়ে আছ কেন? চলে যাও। নিজের রাস্তা দেখো। আমার আর সহ্য হচ্ছে না।
তুমি যাবে, নাকি আমিই চলে যাবো? জীবনটা তো অতিষ্ঠ করে দিলে। আমার মতো একজন শিক্ষিত এবং ভদ্রলোকের পক্ষে তোমার সাথে থাকা আর সম্ভব নয়।
বলাই বাহুল্য, আমার ভাষা এবং বলার ভঙ্গি এতটা "পরিশীলিত" ছিল না।
স্ত্রী আমার মুখ থেকে কোন ধরণের জবাব পেয়ে অভ্যস্ত নয়। কাজেই সে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার মুখের দিকে, তারপর একটা কথাও না বলে চলে গেল।
"একবস্ত্রে গৃহত্যাগ" যাকে বলে। গল্পে-উপন্যাসে পড়া যায়, কিন্তু আমি বাস্তবে দেখলাম এই প্রথম।
প্রথম দিনটা অত্যন্ত আনন্দে কাটালাম। ব্যাচেলর জীবন হল শ্রেষ্ঠ জীবন, স্ত্রী থাকা মানেই একটা মহাযন্ত্রণা থাকা, মহাপুরুষরা অবিবাহিত থাকতেন, নারীজাতি সর্বনাশী, এ ধরণের উচ্চমার্গীয় চিন্তাভাবনা করে দিনটা কাটিয়ে দিলাম। অনেকদিন পর মুক্ত জীবনের স্বাদ পেলাম।
হাত পুড়িয়ে চা "রান্না করে" খেলাম, সেটাও অনেক আনন্দময় মনে হল। কাজের বুয়া রহিতনের মা যখন বলতে এলো, "কামডা ভালা করলেন না ভাইজান", তখন তাকে এক ধমকে হাঁকিয়ে দিলাম।
ঝোঁকের মাথায় কত কিছুই তো আনন্দের মনে হয়। চব্বিশ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই আমার আনন্দে ভাটা পড়া শুরু হল। কী যেন নেই, কী যেন ছিল, একটা খালি খালি ভাব এসে আমাকে গ্রাস করলো।
আমার পানি তেতো লাগা শুরু হল। নিশ্চয়ই জ্বর আসছে। নিজের কৃতকর্মের জন্য একটু অনুতাপ যে হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু আমি নিজের জায়গায় অটল। কিছুতেই স্ত্রীকে ফোন করে ক্ষমা চাইব না।
এ দেহে এক বিন্দু রক্ত থাকিতে ... ... ইত্যাদি ইত্যাদি।
খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে আমি সারাদিন জ্বর গায়ে শুয়ে আছি। কিছু মুখে দিচ্ছি না। কার সাথে আমার এই অভিমান সেটা আমার নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়। রহিতনের মা দুয়েকবার খাবার নিয়ে এসেছিলো, আমার মুখে কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ শুনে কানে আঙুল দিয়ে পালিয়ে গেছে।
ইংরেজি গালি তার বোঝার কথা নয়, কিন্তু কেন সে কানে আঙুল দিলো কে জানে।
শুধু ঐ মেয়েটার কথা মনে পড়ছে। আমার ওপর এই একটি বছর ধরে যে মেয়েটি "অত্যাচারের স্টিম রোলার" চালিয়েছে, কথায় কথায় ঝগড়া বাঁধিয়েছে, স্ত্রী হবার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমাকে কারণে-অকারণে "অপদার্থ" বলে সম্বোধন করেছে, শেষকালে আমাকে ত্যাগ করে চলে গেছে। কে জানে, ডিভোর্স লেটার হয়তো কয়েকদিনের মধ্যেই এসে হাজির হবে। সে আমাকে ফোন করে খবর নেবে না তা তো জানিই, সে অত্যন্ত আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন একটা মেয়ে।
আমার দিক থেকে খানিকটা বাড়াবাড়ি তো হয়েছেই। কিন্তু সে জন্য আমি মোটেই ব্যথিত নই। ক্ষমা চাইলে সে চাইবে, আমি নই। নয়তো এ সম্পর্কের এখানেই ইতি।
কী সব যা-তা ভাবছি? দেয়ালে তাকালাম, চুনকাম করা সাদা দেয়ালে একটা তরুণীর মুখ ভেসে উঠছে।
আমি নিজের মনেই হাসলাম। সস্তা ভালোবাসা। এরকম হয়, প্রিয়জন ছেড়ে চলে যাবার পর রাস্তাঘাটে, গাছের ডালে ডালে, আকাশের মেঘে, এমনকি পানির গ্লাসেও প্রেয়সীর ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। তার ওপরে আমি এখন অসুস্থ, কাজেই দৃষ্টিবিভ্রম হওয়া স্বাভাবিক। আমার এখন দরকার পরিপূর্ণ বিশ্রাম, দৈহিক এবং মানসিক।
যত চিন্তা করবো, ততই চিন্তা বাড়বে।
আমি সিলিঙয়ের দিকে তাকিয়েও যখন স্ত্রীর মুখখানি দেখতে পেতে শুরু করলাম, তখন চোখ বুজে ঘুমোনোর চেষ্টা করলাম। তপ্তগাত্রে ঘুমোনো খুব কঠিন কাজ, সারা গা দিয়ে যেন ভাপ বেরুচ্ছে, কেউ যদি ঠাণ্ডা পানি দিয়ে সারা শরীর স্পঞ্জ করে দিত তাহলে হয়তো ভাল লাগতো। কিন্তু এখন সে সুযোগ কোথায়? অসুখবিসুখ হলে যে যত্ন করতো সে তো নেই। মাথা যে তুলবো সে শক্তিটুকুও নেই।
আমি অসাধ্য সাধন করলাম, এক সময় বোধহয় ক্লান্তিতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
***
আমার ঘুম ভেঙেছে। কেউ একজন আমার কপালে হাত রেখে বসে আছে।
চোখ ঘুরিয়ে তাকালাম। মাথার কাছে বসে আছে আমার স্ত্রী।
আমি নিশ্চয়ই ভুল দেখছি। নিজে তো খবর দিই নি যে আমি অসুস্থ। তাহলে কে খবর দিলো? নিশ্চয়ই রহিতনের মা, আমার কড়া নিষেধ সত্ত্বেও আগ বাড়িয়ে মাতবরি করেছে।
কপালের ওপর থাকা কোমল হাতটা সচল হল। আমি বললাম, কখন এসেছ?
সে জবাব দিলো না।
বরং বলে উঠলো, আমি চলে গেছি, আর দু'দিনেই জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছ?
আমি হতবাক। যাকে এতটা অসম্মান করলাম, সে কত স্নেহমাখা কণ্ঠে কথা বলছে। আমি ভুল শুনছি না তো? জ্বর গায়ে অনেকেই ভুল দেখে, ভুল শোনে। তাছাড়া আমার মনের অবস্থাও খারাপ, কাজেই হয়তো ভুল দেখছি।
কিন্তু স্ত্রীকে ছুঁয়ে দেখে নিশ্চিত হলাম, না, সে সত্যিই এসেছে।
সে আমার উত্তপ্ত মাথা এবং মস্তিষ্কের কষ্টকল্পনা নয়।
সে আবার বলল, আমি না থাকলে কে তোমার দেখাশোনা করবে? বলেই চুপ করে গেল।
আমি মুখের ওপর এক ফোঁটা তপ্ত পানির ছোঁয়া পেলাম। মেয়েটি কাঁদছে, আমার মতো অতি নগণ্য একজন মানুষের জন্য তার চোখ থেকে প্রগাঢ় মমতায় অশ্রু ঝরছে। আমি জানতাম যে মানুষের চোখের পানি অতি মূল্যবান, যেখানে সেখানে সেই পানি ফেলে অপচয় করতে হয় না।
বোকা মেয়েটা আমার জন্য চোখের পানি ফেলছে কেন?
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, তুমি আমাকে একটু বকাঝকা কর তো। তাহলেই সুস্থ হয়ে যাবো। পুরো দু'দিন আমার সাথে ঝগড়া কর নি।
আমি লক্ষ করলাম, আমার স্ত্রীর চোখে পানি, কিন্তু সে হাসছে। বড় সুন্দর সে হাসি।
প্রবল বর্ষণের পর মেঘ কেটে গিয়ে সূর্য ওঠার মতো আনন্দময় দৃশ্য। সৃষ্টিকর্তা অতি তুচ্ছ মানুষদের জন্যও অবর্ণনীয় আনন্দের কিছু মুহূর্ত ঠিক করে রাখেন। সে আনন্দে নিজের চোখেও পানি চলে আসে। মানুষ কত বিচিত্র প্রাণী, সে দুঃখেও কাঁদে, প্রবল আনন্দেও কাঁদে।
(১০ ডিসেম্বর, ২০১২)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।