আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মিনা ও মিঠুর গল্প

সত্য ও সুন্দরের পথের অভিযাত্রী আমি, কিছুতেই যেন এ যাত্রা শেষ না হয়... ছোটবেলায় আমার দেখা কার্টুন ছবিগুলোর মধ্যে মিনা কার্টুন ছিল অন্যতম। সেই কার্টুনের একটা পর্ব ছিল এমন -যেখানে গ্রামের ছেলেমেয়েরা তাদের নিজেদের ও বড়দের বদঅভ্যাসগুলো দূর করে। কার্টুনটিতে মিনার যে মিঠু ছিল সেও একজনকে পালটে দিয়েছিল। তার বদঅভ্যাসগুলো দূর করতে সাহায্য করেছিল। এরপর সেই ছেলেটি মিঠুকে বলেছিল - “তুমিতো আমারে বদলাইয়া দিসো মিঠু“ আমার জীবনেও মিঠুর মত একজন এসেছে যে কিনা আমাকে বদলে দিচ্ছে।

অসাধারন, নিঃস্বার্থ একজন ভাল মানুষ। আমার চোখে দেখা একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ,যে মানুষটি ভালবাসা শব্দটি আমাকে নতুন করে শিখিয়েছেন। তিনি শিখিয়েছেন একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মাঝে প্রেম ভালবাসা কতো পবিত্র সম্পর্ক থাকতে পারে। আজ সেই মানুষটার গল্পই বলব। আমি ছোটবেলা থেকে শান্ত আর বোকা হলে কি হবে,আমি খুব জেদী।

তবে আমার কিছু খামখেয়ালিপনা স্বভাবের জন্য বাসার সবাই suffer করতো। নিজের কোনকাজটাই ঠিক মতো করতাম না। সবকিছুতেই আমার খুঁতখুঁতানি...যেমন শুচি-বাই,অকারনে বার বার হাত ধোয়া। খাবারের কথাই যদি বলি...গরুর মাংস আর ইলিশ ছাড়া আর কোন মাছ মাংসই খেতাম না। আমার জন্য আম্মু আলাদা করে রান্না করতেন।

ঘটনা যদি এখানেই শেষ হতো...তাহলে একটা কথা ছিল। বাসায় যদি ইলিশ বা গরু ছাড়া অন্য কোন মাংস রান্না হয় সেদিন আমি সবার মাথা খেয়ে ফেলতাম। যে হাঁড়িতে ওগুলো রাঁধা হয়, যে বাটিতে ওগুলো বাড়া হয়, এমনকি যে চামচ দিয়ে ওগুলো নেয়া হয় সেগুলো আমি কখনও স্পর্শ করি না বা আমি যেগুলো খাই তার ধারের কাছেও আমি ওগুলো রাখতে দেই না। ফেসবুক সম্পর্কে কখনোই আমার ধারনা যে খুব ভাল ছিল, তা নয়। আমি খুব নেগেটিভ ধারনা নিয়েই এই ভার্চুয়াল জগতে পদার্পণ করেছিলাম।

আমার ধারনা ছিল এই জগতের মানুষেরা অনেক মিথ্যাবাদী হয়, তারা ফেইক আইডি ব্যবহার করে। ছেলেরা মেয়ে সেজে, মেয়েরা ছেলে সেজে মানুষকে প্রতারিত করে। একসময় বুঝলাম সবাই যে ফেইক তা নয়। অনেক ভাল মানুষও আছেন। তেমনি একজনের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল।

আমি ফেসবুকে আমার ছবি দেই না। তাই কোন ছেলের সাথে পরিচয় হলেই আমার ছবি দেখতে চাইতো। একটা মানুষ ছিল আর দশজনের চেয়ে আলাদা। তার সাথে পরিচয় হবার পর কোনদিন জানতে চাননি আমি কেমন বা আমার ছবি দেই না কেন। মানুষটার সাথে কথা বলে তাকে খুব বেশি বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করলো।

হয়তোবা তার জন্যই আমার আমার জীবনের সব কিছু খুলে বললাম। সব শুনে তিনি যেন আকাশ থেকে পরলেন। তিনি বললেন আমি anorexia nervosa ,obsessive compulsive disorder রোগে আক্রান্ত যা নাকি কাউসেলিং নিলেই অনেকটা ভাল হয়ে যায়। ভাইয়ার ছোট বোন ছিল না। আমাকে প্রায়ই বলতেন যদি আমার মতো একটা ছোট বোন থাকতো।

আমাকে বলতেন ......তুই এমনটা কেন করিস ? এতগুলো বছর তুই তোর মা-বাবাকে কষ্ট দিয়ে আসছিস। যখন তোর বাসায় এমন খাবার রান্না করে যা তুই খাস না, তখন তোর মাকে আবার আলাদা করে তোর জন্য রান্না করতে হয়। একবারও কি ভেবে দেখেছিস, এতে তোর মায়ের কতটাকষ্ট হয়?তোর জন্য আলাদা বাজার করতে হয়। তিনি আরও বললেন - যখন তোর বিয়ে হবে তখন তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজন এগুলো নাও মেনে নিতে পারে, তখন কতটা অশান্তির সৃষ্টি হবে ভেবেছিস। তুই এগুলো করে নিজের ক্ষতি করছিসই পাশাপাশি বাকিদেরও কষ্ট দিচ্ছিস।

তোর জন্য নিশ্চই তোর ভাইও এমন খাবার বাসায় আনে না যা তুই খাস না। তুই চিন্তা করে দেখ তোর জন্য তোর ভাইও ভালো খাবার খাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার কয়দিনপর যখন তোর বিয়ে হবে তখন তোর বাচ্চাগুলো অপুষ্টিতে ভুগবে। তুই এবার বল তুই একা কতগুলো মানুষের জীবনকে নষ্ট করছিস। এটা কি ঠিক হচ্ছে?তিনি বললেন, এমন কারা করে জানিস ? যারা মানসিক রোগী,তারাই এমনটা করে।

ভাইয়ার কথাগুলো হয়তোবা খুব সাধারণ কিন্তু কেউ আমাকে এতোটা আবেগ আর মমতা নিয়ে বুঝিয়ে বলেনি। ভাইয়ার মমতাটা আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করলাম। ভাইয়ার মমতামাখা কথা গুলো সত্যিই আমার চিন্তাধারা পালটে দিল। ভাইয়ার কথাগুলো জাদুর মত করল। আমি ভাইয়াকে promise করলাম যে আমি ভাল হয়ে যাব।

ভাইয়া বললেন,আমার কথা শুনলে তুই ভাল হয়ে যাবি ইনসাল্লাহ। যখন তুই সম্পূর্ণ ভাল হতে পারবি তখন সবাইকে বলবি। তোর প্রথম কাজ হচ্ছে ক্লাসের পর চিকেনশর্মা খাবি। তিনি সব খাবারই অল্প অল্প করে খেতে বললেন। এরপর ভার্সিটির ক্যান্টিনে শর্মা খেয়ে ভাইয়াকে জানালে সেদিন কি যে খুশি হয়েছিলেন বলে বোঝাতে পারব না।

এখন আমি আস্তে আস্তে সব খাবার খাওয়া শুরু করেছি। আমি এখন ভাবছি আম্মু আর ভাইয়ার কথা। তারা যদি জানেন আমি এখন মোটামুটি সব খেতে পারি তারা যে খুশি হবে তা ভাবতেই আমার ভাল লাগছে। সেদিন টুম্পা আমার চিকেন খাওয়া দেখে তো কেদেই ফেললো। ভাইয়া আমাকে পুরো বদলে দিয়েছেন।

এখন আমার বার বার হাত ধোয়ার মতো খুতখুতে অভ্যাসও আর নাই। শুধুমাত্র ভাইয়ার জন্য আমি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। তিনি মিনা কার্টুনের মিঠুর মতই আমাকে বদলে দিয়েছেন। আমারও বলতে ইচ্ছে করছে এখন -"ভাইয়া আপনেতো আমারে বদলাইয়া দিসেন" অসাধারন, অমায়িক, বিনয়ী, ভদ্র, মোট কথা খুব চমৎকার একজন মানুষ তিনি। এই পেজ এর যারা নিয়মিত পাঠক তারা সবাই এই নিঃস্বার্থ মানুষটিকে চেনেন...তার লেখা আপনারা অনেক পছন্দ করেন।

নামটা নাহয় নাই বললাম। মানুষটা সত্যিই আমাকে ছোট বোনের মত আদর করেন। সবসময় আমাকে সদোপদেশ দেন। আমাকে বলেন এটা করবি, ওটা করবি,এভাবে চলবি। অনিয়ম করবিনা।

ঠিক যেন নিজের বোনের মতো। এককথায় মাটির মানুষ। আমার জানায় এমন কোন শব্দ নাই যে আমি ভাইয়ার কথা বর্ণনা করব। যাই লিখিনা কেন সেগুলোকে অনেক তুচ্ছ মনে হবে। ভাইয়ার কিন্তু এখানে কোন স্বার্থ নেই, কিংবা এটা তার কোন দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।

পৃথিবীতে সবকিছু সবাই স্বার্থের জন্য করে,এই কথাটা এই মহৎ মানুষটির বেলায় প্রযোজ্য না। এই কথাটি আজ পরাজিত এই মানুষটির কাছে। আমি এই কথাগুলো আমার এই ভাইয়াটির গুণকীর্তন করার জন্য লিখিনি। আমি যে এটা লিখেছি আমার ভাইয়াটি তা জানেনও না। জানলে হয়তো রাগ করবেন।

ছোটবেলায় ইচ্ছা ছিল,যদি কোনদিন স্পাইডার ম্যান, সুপার ম্যান, ব্যাট ম্যান,এইরকম হিরো হতে পারি বা এমন হিরোর দেখা পাই,তাহলে জীবনটাই সার্থক হয়ে যাবে। আজ মনে হচ্ছে ওইসব কাল্পনিক হিরোগুলোর চাইতে আমার ভাইয়া অনেক উপরে,তিনি তাদের চাইতেও শ্রেষ্ঠ। তিনি সত্যিকারের হিরো। আমি যদি তারমত হতে পারতাম। পুরোটা না পারি,একটুও যদি পারতাম তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।

ভাইয়া আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে পুরোপুরি সুস্থ মানুষ বানানোর জন্য। আমি যদি আমার মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি তবুও সেটা আপনার অবদানের তুলনায় অনেক ছোট হয়ে যাবে। আপনি তো জানেন, আমার পৃথিবীটা অনেক ছোট। খুব সামান্য লোকের বসবাস সেখানে। এখন থেকে আপনিও আছেন আমার পৃথিবীতে।

আমার মা-বাবা, ভাইবোন এর সাথে এখন আপনিও আমার পৃথিবীর অংশ। ভাইয়া আপনি এত উঁচু পর্যায়ের পেশায় নিযুক্ত হয়েও যে দাম্ভিকতাহীন জীবনযাপন করেন,তা দেখে আমি মুগ্ধ। আপনার এবং আপনার পরিবারের সবার জন্য আমি মন থেকে দুয়া করছি। আল্লাহ আপনাদের সবার মঙ্গল করুন, জীবনকে সহজতর করে দিন, আপনাদের জীবনকে হাসিখুশিতে ভরিয়ে দিন। আমীন।

ভাইয়া আপনি ভাল থাকেন, খুব ভাল, অনেক ভাল ............... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.