লিখতে ভালোবাসি যাস্ট বাফেটের প্রতিবেশী ছিলেন এক দর্জি। কাজে অবসেশন (আবিষ্টতা) ছিল তার। শার্ট-প্যান্ট নিখুঁতভাবে না বানাতে পারলে শান্তি পেতেন না। ওমাহায় তার নামডাকও ছিল। কাজের মান না আবার খারাপ হয়ে যায়, এ আশঙ্কায় বেশি অর্ডার নিতেন না তিনি।
ফলে খ্যাতি ছড়ালেও ভদ্রলোকের উপার্জন ছিল না তেমন। ছিলেন ক্যাথলিক ও ধর্মপরায়ণ। মনোবাঞ্ছা ছিল, জীবনে একবার হলেও নিজের পয়সায় ভ্যাটিকান যাবেন, দেখা করবেন পোপের সঙ্গে। এ ইচ্ছায় অর্থ সঞ্চয় পর্ব শুরু হয়ে গেল। অর্ডার বাড়ালেন না ভদ্রলোক।
কমিয়ে দিলেন সংসারের খরচ। পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে ঘুরেও এলেন ভ্যাটিকান থেকে। ফেরার পর প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে স্থানীয় গির্জার ফাদারও চলে এলেন বাড়িতে। তারা ফার্স্টহ্যান্ড বর্ণনা শুনতে চান— পোপ লোকটি আসলে কেমন? এ প্রশ্ন উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে দর্জি নির্দ্বিধায় জবাব দিলেন, ৪৪ সাইজ মিডিয়াম (এটি বাংলাদেশের মানদণ্ডের তুলনায় ভিন্ন)। বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের সিইওদের বাফেট এ গল্পটা বলতেন একটা উদ্দেশ্য নিয়ে— একজন মানুষ তার কাজে কতটা অবসেশড হতে পারে।
বাফেট বলতেন, প্রকৃত ম্যানেজার হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ঘুম থেকে উঠেই ব্যবসার হিসাব মেলাতে শুরু করেন আর ঘুমাতে যান ব্যবসা বাড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে। তিনি মাঝে মধ্যেই বলেন, অবসেশন ইজ দ্য প্রাইস ফর পারফেকশন (উত্কর্ষের মূলেই আবিষ্টতা)। বাফেটের নিজের অবসেশনের কথাও এখানে উল্লেখ করা দরকার। কোনো প্রয়োজন ছাড়াই ৬০ পেরোনোর পরও তিনি মুখস্থ করেছিলেন অত্যন্ত দুর্বোধ্য মুডিস (রেটিং কোম্পানি) স্টক ম্যানুয়ালের আগাগোড়া। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ম্যানুয়াল তার আগেই ঠোঁটস্থ।
নিজের এ ধরনের অবসেশন সৃষ্টির জন্য বাফেট ‘দায়ী’ করেন ছোটবেলায় ওমাহার আরেক ভদ্রলোককে। শিক্ষা-দীক্ষা খুব একটা এগোয়নি বলে তাকে ছোট চাকরি করতে হতো পানি সরবরাহকারী এক কোম্পানিতে। স্বপ্ন ছিল নিজের একই ধরনের একটি কোম্পানি গড়ার। কীভাবে যেন তার সঙ্গে স্কুলে পড়াকালে বন্ধুত্ব হয় বাফেটের। মজা পেয়েছিলেন বলেই হয়তো বাফেট মিশেছিলেন তার সঙ্গে।
যা হোক, ওমাহার মানুষজন কুলি করা, হাত ধোয়া থেকে শুরু করে সুইমিং পুলে সাঁতার পর্যন্ত কী পরিমাণ পানি ব্যবহার করে রোজ, সে হিসাব ছিল তার নখদর্পণে। সকালে দেখা হলেই তিনি কিশোর বাফেটকে তথ্য দিতেন, আজ ভোর ৫টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ওমাহার মানুষ ব্যবহার করেছে এত লিটার পানি; ব্যবসা করতে পারলে তার আর্থিক মূল্যমান হতো এত হাজার ডলার! ক্ষতিকর অবসেশন মানুষকে শেষ করে দিতে পারে। তবে কাজের বিষয়ে অবসেশন তাকে টেনে তোলে ওপরে। বাফেট নিজেই তার সাক্ষী। ওই ভদ্রলোক পরে ঠিকই একটা পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান খুলে বসেন এবং মিলিয়নেয়ার বনে যান।
বার্কশায়ারে একটি বিষয় চালু করতে চেয়েছিলেন বাফেট। পারেননি বোর্ডের আপত্তিতে। সেটি হলো, চাকরিপ্রার্থীদের ইন্টারভিউ বোর্ডে কেবল একটি প্রশ্ন করা হবে, তারা বিশেষ কোনো কাজের প্রতি অবসেশড কি না?
ভালো ম্যানেজারের কথা উঠলেই বাফেট তুলে ধরতেন নেব্রাস্কা ফার্নিচার মার্টের প্রতিষ্ঠাতা রোজ ব্লাম্পকিনের দৃষ্টান্ত। তিনি বেশি পরিচিত মিসেস বি নামে। রাশিয়া থেকে আসা অভিবাসী রোজ ফার্নিচার ব্যবসা শুরু করেন ৫০০ ডলার ধার (হবু স্বামীর কাছ থেকে) করে; শহরের এক কোনায়, ছোট্ট দোকান নিয়ে।
এখন নেব্রাস্কায় প্রায় ৭৭ একরের বেশি স্থানজুড়ে (সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বড়) আউটলেট তার। ক্ষুদ্রাবস্থা থেকে এটি এত বড় হতে পেরেছে মিসেস বির অবসেশনের কারণে। বাড়ি ফিরেও দোকানের হিসাবপত্র মেলাতেন ভদ্রমহিলা। ব্যবসায় সক্রিয় ছিলেন ৬০ বছরেরও বেশি (১০৪ বছর বয়সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত)। জীবনে ছুটি নিয়েছিলেন মাত্র একবার।
তবে ছুটি পুরো না কাটিয়েই ফিরে আসেন, ক্রেতার সমস্যা হচ্ছে ভেবে। মাঝে মধ্যে অবশ্য গাড়ি নিয়ে বেড়াতেন মিসেস বি। বেড়ানো বলা ঠিক হবে না। নেব্রাস্কায় ঘুরে ঘুরে দেখতেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা কীভাবে ব্যবসা করছে।
বার্কশায়ারে এমন আছে আরও কয়েকজন।
যেমন বীমা কোম্পানি গেইকোর (প্রতিষ্ঠানটির ওপর বাফেটের নজর ছিল ২০ বছর বয়স থেকে) সিইও টনি নাইসলি। তিনি এখানে কাজ করছেন ১৯৬১ সাল থেকে। কয়েকবার তাকে বলাও হয়েছে, বয়স হলো না! আর কত? অথচ তিনি নাছোড়বান্দা, অফিসে আসবেনই। আরেকজন ফ্লাইটসেফটির চেয়ারম্যান অ্যালবার্ট লি ইউয়েলশি (তাকে আধুনিক বিমান চালনা প্রশিক্ষণের জনক বলা হয়)। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ১৯৫১ সাল থেকে চালাচ্ছিলেন কোম্পানিটি।
অনেক অনুরোধের পর ২০০৩ সালে মনে হয়েছিল, তিনি অবসর নিতে যাচ্ছেন। কিসের কী? ওই সময় ঘোষণা দিলেন, তিনি চেয়ারম্যান হতে চান। এটিই তার অবসর।
প্রচলিত অর্থে নিজেকে স্মার্ট ভাবেন না বাফেট। তার কাছে স্মার্টনেসের সংজ্ঞা অবশ্য ভিন্ন।
তিনি মনে করেন, কাজের প্রতি অবসেশন ব্যক্তিকে স্মার্ট করে তোলে। কেউ কেউ চাকরিপ্রার্থীকে ইন্টারভিউতে জিজ্ঞেস করেন, অমুক পদ পেলে আপনি কোম্পানির মুনাফা কতটা বাড়াতে পারবেন বলে মনে করেন? প্রার্থীরা কখনো কখনো নিজ থেকেই বলে, যোগ দিলে অমুক করব, তমুক করে দেখাব। বাফেট বলেন, এসব মানুষ বোর্ডকে শুরুতে কোম্পানির লাভের গল্প শোনায়, পরে তলে তলে নিজের আখের গোছাতে থাকে। বার্কশায়ারে এদের নেয়া চলবে না। বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে ও এর অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানে মাঝে মধ্যে উচ্চপদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের ইন্টারভিউ নেন বাফেট নিজে।
সে এক মজার কাণ্ড! প্রার্থীদের ব্যবসাসংক্রান্ত প্রায় কিছুই জিজ্ঞেস করেন না তিনি। কোত্থেকে কী বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েছে, সে সার্টিফিকেটও দেখতে চান না। তিনি গল্প করেন। জানতে চান, প্রার্থীর শৈশব-কৈশোর কীভাবে কেটেছে, কী কী ভালো লাগত, মজার অভিজ্ঞতা প্রভৃতি। এর মধ্য দিয়েই তিনি স্থির করেন প্রার্থীকে চাকরি দেয়া যায় কি না।
বাফেটের যুক্তি হলো, কাউকে যদি সাইকেল ব্যবসার দায়িত্ব দিতে চান, তিনি হার্ভার্ড না এমআইটি থেকে অ্যারোডায়নামিকসে পিএইচডি নিয়েছেন, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রার্থী শৈশবে সাইকেল চালাতে পছন্দ করতেন কি না, সাইকেল বিষয়ে তার অবসেশন রয়েছে কি না, সেগুলো জানা।
লেখাটি এই সাইট থেকে নেয়া ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।