সময়ের সাহসী কলম জামেয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের ৫০বছর পূর্তি ও দস্তারবন্দি মহাসম্মেলনে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান প্রদত্ত ভাষণ
শ্রুতিলিখন: মুহাম্মদ আবদুল কাদির [link|www.kadirsyl.blogspot.com|
আমার ভাই ও বন্ধুরা!
আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন, বিগত চার বছর যাবত আমি রোগাক্রান্ত হয়ে দুর্বল হয়ে গেছি। নিজে নিজে একা দাড়াতে পারি না। তার পরেও এই জামেয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর থেকে ফারিগ হওয়া হাজার হাজার আলেমদের চেহারা দেখা; তাদের দোয়া লাভ করা এবং জীবনের শেষ মুহূর্তে একটু আনন্দ লাভ করার জন্য আমি এখানে হাজির হয়েছি।
আমাকে আজ বাংলা ভাষায় ইসলামচর্চা সম্পর্কে কিছু বলতে বলা হয়েছে। আপনারা হয়তো অনেকই জানেন যে, আমি বিগত প্রায় ৬০ বছর যাবত কলমের খেদমতে আছি।
আমরা যখন প্রথম লেখালেখি শুরু করি তখনকার দিনের একটি কথা আমার স্মরণ হয়ে গেল। একদিন আমি মাওলানা আকরাম খাঁ সাহেবের কাছে গেলাম। সেখানে মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরি ও নুর মুহাম্মদ আজমি রাহ. বসা ছিলেন। মাওলানা আকরাম খাঁ আমাকে ডেকে বললেন, খান সাহেব, আমি আপনাকে একহাজার টাকা দিচ্ছি, এই টাকার পরিমাণ ইসলামি বইপুস্তক বাজার থেকে আমাকে কিনে এনে দেখাও। আপনারা বিশ্বাস করেন, তখনকার যুগে বাংলা ভাষায় একহাজার টাকা মূল্য পরিমাণ বইপুস্তক বাজারে ছিল না।
তখন আমাদেরকে লক্ষ্য করে মাওলানা আকরাম খাঁ বলেছিলেন, আপনারা বাংলা ভাষাকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করুন। এই ভাষা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। এই ভাষায় ইসলামি বইপুস্তকের একটি সয়লাব তোমরা সৃষ্টি করো। আমি আজ উৎফুল্লচিত্তে এ কথা বলতে চাই; একহাজার টাকা নয়; আপনি নগদ লক্ষ টাকা নিয়েও যদি বাংলাবাজারে ঢুকেন, তাহলে এই পরিমাণ অর্থের যথেষ্ট পরিমাণ বইপুস্তক পাবেন। এ কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই জামেয়া থেকে যারা ফারিগ হয়েছেন, তাদের পেছনে বর্তমান মুহতামিম আল্লামা জিয়া উদ্দিন সাহেবের বিশেষ একটি যত্ন আমি লক্ষ করেছি।
তিনি প্রতিটি ছেলেকে অত্যন্ত যত্নসহকারে কিছু লেখা এবং একজন লেখক হিসেবে গড়ে তোলার একটি প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। তার এই প্রচেষ্টার ফলে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট লেখক এই জামেয়া থেকে তৈরি হয়েছে এবং ইনশাআল্লাহ আমি আশা করব, ভবিষ্যতে আরো অনেক লেখক তৈরি হবে। যারা কলমযুদ্ধের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়বে। তাদের কলম দ্বারা সারা দুনিয়ার ঘরে ঘরে দ্বিনের বার্তা পৌঁছিয়ে দেবে।
আমার ভায়েরা!
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দিকে যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব, বাংলা ভাষার অগ্রগতি বিশেষ করে ইসলামি লাইনে অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক।
আমাদের দেশে ইসলামি শিক্ষার দু’টি সুস্পষ্ট ধারা রয়েছে। আমি এক আজব বস্তু। আমার শিক্ষা হয়েছে আলিয়া মাদরাসা লাইনে, আর তরবিয়ত হয়েছে কওমি মাদরাসায়। কওমি মাদরাসার যে শিক্ষকবৃন্দ ও মুরব্বিয়ানে কেরামের ‘জুতা বহন’ করে আমি কিছু হাসিল করেছি। এজন্য আমি মনে করি আপনাদের সামনেও আমর দু’চারটি কথা বলার অধিকার রয়েছে।
আমি এ কথা বলতে চাই, আপনারা সর্বপ্রথম এই দেশে আল্লাহর দ্বিনের দাওয়াতের জন্য বাংলা ভাষাকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করুন। আমার পার্শ্ববর্তী দেশ আসাম। সেখানকার লক্ষ লক্ষ মুসলমান যারা আমাদের মুখাপেক্ষি হয়ে আছে। আমি আসামের বিশিষ্ট মুরব্বিদের, এমনকি কিছু কিছু মহিলার চিঠিপত্র সংগ্রহ করে রেখেছি। তারা একটি আবেগের সাথে আমাকে লিখেছে, ভাইজান! আমাদের জন্য আপনি এমন কিছু বই লিখে দেন যেগুলো পড়ে আমরা দ্বিনের পথ থেকে সরে যাব না।
আপনারা জানেন ময়মনসিংহের কিছু লোক ভূমিহীন অবস্থায় আসামের চলে গিয়েছিল। তাদের কিছু লোক আমার গ্রামেরও ছিল। তাদের ছেলে-মেয়ে গত বছর (২০১০) আমাদের গ্রামে বেড়াতে এসেছিল। তারা ইউনিভার্সিটি লেভেলের ছাত্র-ছাত্রী। আমাকে দেখে তারা দুই হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে সালাম জানাল।
আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম এটি আবার কোন ধরনের সালাম? একটি মেয়ে আমাকে বলল, দাদা! এটিই আমরা শিখেছি। এটিই আমাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। আমরা জানি না কোন কোন পশু খাওয়া হালাল; কোন কোন পশু খাওয়া হারাম। সামান্য কিছু জানতে হলেও একজন আলেমের প্রয়োজন হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ আলেম আমাদের এখানে নেই।
আমি আপনাদেরকে বলি, অন্তত এই শাহজালালের পুণ্যভূমি সিলেটে যেসব আলেম আছেন, বা এখানে যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের একটি দায়িত্ব রয়েছে। এ দেশে যখন ইংরেজদের প্রচণ্ড দাপট ছিল, তখন ওলামায়ে কেরাম মিলে একটি প্রতিষ্ঠান করেছিলেন; যার নাম ছিল, নদওয়াতুল উলামা লক্ষৌ। ‘নদওয়া’ এখনো জীবিত আছে। এখন দারুল উলুম দেওবন্দের ছায়াতেই এর বিকাশ। আপনারা শুনলে অবাক হবেন, আজকে অনেকেই বলে থাকেন যে, পবিত্র কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন।
উনি নদওয়ার ছাত্র ছিলেন। সেখানে দীর্ঘ আট বছর তিনি লেখা-পড়া করেছেন। যে কারণে তিনি কুরআন শরিফ, মিশকাত শরিফ এবং তাযকিরাতুল আউলিয়ার অনুবাদ করার যোগ্যতা তিনি লাভ করেছিলেন। আপনাদের এই জামেয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরেও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে হবে। যাতে ওই পারের কিছু মুসলমানও অন্তত বৈধ পন্থায় এ দেশে এসে কিছু জ্ঞান অর্জন করে তাদের দ্বিন-ধর্ম রক্ষা করতে পারে।
আমি পঞ্চাশ বছরেরও বেশি দিন যাবত মাসিক মদিনার কাজ করছি। আপনারা সবাই পত্রিকাটি চেনেন। পৃথিবীর এমন কোনো অঞ্চল নেই; যেখানে বাংলা ভাষাভাষী কিছু মানুষ আছে অথচ মাসিক মদিনা নেই। এই মাসিক মদিনার সুবাদে আমি পৃথিবীর যেসব এলাকায় দ্বিনি ইলিম শিক্ষা করা কঠিন_যেসব এলাকার অন্তত নব্যশিক্ষিত ছেলে-মেয়েদেরকে কিছু শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ লাভ করেছি।
আপনাদেরকে আমি একটি নসিহত নয়; একটি ওসিয়ত করে যাচ্ছি।
হয়তো জীবনে আর কোনো দিন এতগুলো মানুষের মুখ একসাথে দেখতে পারব না, অথবা আপনারাও আমাকে দেখতে পারবেন না_ আজ আমি আপনাদেরকে এ কথা বলতে চাই, আপনাদেরকে বাংলা ভাষার নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বাস করুন, বাংলা ভাষায় মুসলমানদের প্রথম দৈনিক পত্রিকা ‘সুলতান’। এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একজন মুল্লা মানুষ। তার নাম মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদি। এর পরের দৈনিক পত্রিকা ছিল ‘আযাদ’।
সেটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাওলানা আকরাম খাঁ। তিনিও একজন মুল্লা মানুষ। সুতরাং টুপি মাথায় যারা লেখাপড়া করছেন তাদের হীনম্মন্যতায় ভোগার কোনো কারণ নেই...।
____________________ গ্রন্থনা
মুহাম্মদ আবদুল কাদির
সহ-সম্পাদক, আল কলম গবেষণা পরিষদ বাংলাদেশ
Mob: 01723 624242
Email:
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।