এখন আমাদের দেশে রাজনৈতিক সহনশীলতা নেই বললেই চলে। সহনশীলতা শব্দটি এখন বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সে যেন এক ফেরারী। নির্বাসন জীবনে নিদারুণ দুঃখ দুর্দশায় তার এখন জীবন কাটছে। সে যেন এখন সুদূর অতীত।
সোনালী অতীত বলে একটা কথা বই পুস্তকে লিপিবদ্ধ থাকলেও বাংলাদেশের পঁচা রাজনীতির ক্ষেত্রে তা বলতে পারছিনা; সে অভিধায় তাকে অভিহিত করতে পারছিনা বলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কেননা বাংলাদেশ এমন একটা দেশ যে দেশে কখনো রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব একটা ভাল ছিল এমনটা হলফ করে কোন বাপের বেটা বীর বাহাদুরও বলতে পারবেন না। তবে ভাল না থাকলেও আজকের মত এমন খারাপ অবস্থা তখনকার দিনে অন্তত ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন সভাপতি শামনুল হক’কে ল্যাং মেরে সভাপতি হয়ে বসেন। এমনকি আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সাথে তেমন একটা সহনশীলতার পরিচয় দেখাননি।
২৮ অক্টোবর রাজপথে পিটিয়ে ছাত্র হত্যা, যুদ্ধাপরাদের খোঁড়া অভিযোগে জামায়াতের বর্ষীয়ান নেতাদের জেলে আটকে রাখা। খালেদা জিয়াকে তার স্বামীর স্মৃতি বিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একে একে ভাসানীর নাম পরিবর্তন করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেম প্লেট স্থাপন করলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২৮ নভেম্বরের জনসভায় বলেছেন-“ আগামীতে আমরা ক্ষমতায় গেলে অবৈধ সব নেমপ্লেট তুলে ফেলা হবে”। এগুলো নিশ্চয়ই রাজনৈতিক সহনশীলতার পরিচয় বহণ করে না।
জিয়াউর রহমান সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদে আসীন হন। তিনি কর্ণেল তাহেরসহ বিরোধী পক্ষের শত শত আর্মি অফিসারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন। কর্ণেল তাহেরসহ সে-সকল অফিসারকে বিনা বিচারে হত্যার কোন প্রমাণ পর্যন্ত অবশিষ্ট রাখা হয়নি। ইতিহাস তাই আমাদেরকে বলছে। এরপর আসে স্বৈরশাসক এরশাদ।
সে চোখ-কান বন্ধ করে জনমতের ইচ্ছাকে মূল্য না দিয়ে নয় বছর ক্ষমতায় ছিল। জনশ্রুতি রয়েছে এরশাদই প্রথম প্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্ত্রের রাজনীতি চালু করে। যা এখনও চলছে। এভাবে ক্রমানুসারে-এরপর বিএনপি-আওয়ামীলীগ-চারদলীয় জোট-মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকার- সর্বশেষ বর্তমান মহাজোটের ডিজিটাল আওয়ামীলীগ সরকার আমাদের দেশে ক্ষমতার মসনদে আসীন।
যে-কোন সরকারেরই প্রধান কাজ হচ্ছে সুচারুভাবে দক্ষতার সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করা।
অন্যদিকে বিরোধীদলের কাজ হল-সরকারকে সহযোগিতা করা। সরকারের ভাল কাজগুলোকে সমর্থন দেয়া আর ভুল কাজগুলোকে সংশোধন করে দেয়া; যুক্তিসংগত সমালোচনা করা। কিন্তু আমাদের দেশের তার উল্টো চিত্র চোখে পড়ে। সরকারী দল নিজেদের ইচ্ছেমত দেশ পরিচালনা করে থাকে; বিরোধীদল যুক্তিসংগত সমালোচনা না করে শুধুমাত্র বিরোধীতার খাতিরে বিরোধীতা করতে থাকে। উল্লেখ্য: এখানে একটি কথা স্বরণ করা যেতে পারে।
তা হল-কিছুদিন আগে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উনুষ্ঠিত হয়ে হল, উক্ত নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী বারাক ওবামা, রিপাবলিকান দলের প্রার্থী মিট রমনিকে হারিয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। ফলাফল ঘোষণার পর মিট রমনি বারাব ওবামাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং বারাক ওবামাকে সব ধরণের সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। অথচ আমাদের দেশ হলে ঘটতো তার উল্টো ঘটনা। এভাবে নির্বাচনের পর এক জনকে অপরজন শুভেচ্ছা জানানো তো দূরের কথা তার উপর নির্বাচন নিয়ে ক্ষুক্ষ্ম এবং স্থুল কারচুপির অভিযোগ তুলে পুরো নির্বাচনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে তারা। জাতিকে করা হয় বিভ্রান্ত।
যা একটা উন্নয়ণশীল গণতান্ত্রিক দেশের জন্য কখনো সুখকর হয় না। মাণনীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এ ক্ষেত্রে কেউ কারো থেকে কম যান না; সেয়ানে সেয়ানে লড়াই করতে পছন্দ করেন বলে মনে হয়। না হয় খালেদা জিততে হাসিনা মানে না; হাসিনা জিততে খালেদা মানেনা কেন? কেউ ধোঁয়া তুলসীপাতা নয়, দোষ বেশ-কম সবারই আছে। কিন্তু আমাদেরদেশেরকোন রাজনৈতিক দলেরনেতা প্রধানমন্ত্রী-বিরোধীদলীয়নেত্রী কেউ এটা বুঝতে রাজি নয়; শুধু মুখে বড়বড় কথার ফুলঝুরি। কাজের বেলায় ঠংঠং।
আমরা মুখে কথার হুল ফোটানো রাজনৈতিক বক্তা চাই না; চাই দেশপ্রেমিক, কর্মঠ, দুর্নীতিমুক্ত পরিচ্ছন্ন, সৎ আদর্শবান দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী উভয়ই গিয়েছিলেন কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বলেননি। এটা কেমন আচরণ কোন ধরণের সভ্যতা তা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বুঝে আসে না। এ রকম হিংসাতœক মনোভাবের লোক যদি ক্ষমতায় যায় তাহলে সে দেশ এবং জাতির ভাগ্য কেমন হতে পারে সে বিচার অভিজ্ঞ পাঠকবৃন্দের প্রতি অর্পন করলাম। একটা কথা সত্য যে আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপিরা কেউ তাদের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন না।
যদি করতেন তাহলে প্রধানমন্ত্রীর উচিৎ ছিল বিরোধীদলীয় নেতার সাথে কথা বলা। কেননা প্রধানমন্ত্রী দায়িত্বের দিক দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতার চাইতে বড় দায়িত্বশীল ব্যক্তি।
একথা আমাদেরকে ভুলে গেলে চলবে না যে, ইসলামের সোনালী দিনে দায়িত্বপ্রাপ্ত খলিফারা দায়িত্বানুভূতির সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করতেন। নাগরিকদের সুযোগ সুবিধা দেখার জন্য দিনের বেলায় চদ্মবেশে আর রাতের আঁধারে একা একা বের হতেন। তাইতো তারা তাদের নাগরিকদের মাঝে সাম্য এবং ন্যায়ের সৌধের উপর ভিত্তি করা মজবুজ ইসলামী রাষ্ট্র উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
চারদিকে পবিত্র একটা আবহ ছড়িয়ে পড়তো। নাগরিকরা স্বস্থি এবং শান্তিতে রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারত। কোন চাঁদাবাজি, গুন্ডামি, বদমাশির, ইভটিজিংয়ের ভয় আর শংকা তাদের মনে বিন্দুমাত্রও ছিল না। যা আমাদের দেশের সরকার প্রধানদের নিকট আশা করা অরণ্যে রোদন মাত্র। অনেকটা স্বপ্নের মতোও বটে।
কখনো কোনদিন যদি শুনি আমাদের দেশের কোন প্রধানমন্ত্রী, এমপি, মন্ত্রী বা কোন চেয়ারম্যান রাতের আঁধারে মানুষদের দুঃখ দুর্দশা দেখার জন্য পায়ে হেঁটে চুপিচুপি পথে বের হয়েছেন তখন সেই মহৎ লোকটির পায়ে কদমবুচি করে, হাতে একটা রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে আসব।
আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার কিভাবে জামায়াত-শিবিরের উপর পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে হীন রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করে চলছে। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে প্রতিশোধের একটা নির্লজ্জ সংস্কৃতি চালু করেছে যার দায়ভার একমাত্র আওয়ামীলীগকেই বহন করতে হবে। অন্যদিকে জামায়াত-শিবিরও যেভাবে পুলিশ এবং যানবাহন ভাংচুর করেছে তাও কিছুতেই সমর্থন দেয়া যায় না এবং মেনে নেয়া যায় না। এভাবে চলতে থাকলে আমরা সামনে এগুবো কিভাবে? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনীতি করার অধিকার সবার রয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৭ ও ৩৮ (ক) এবং (খ) ধারায় নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ-মিছিল-মিটিং করার অধিকারের কথা স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বর্তমানে রাজপথে আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংঘাত লেগেই রয়েছে। বলা চলে দিনদিন বেড়ে চলছে এর পরিমাণ। এ রকম রাজনৈতিক সংঘাতের ভেতর একজন শিশু জন্মগ্রহণ করলে সে কিভাবে স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠবে। তার মেধা-মনন কিভাবে বিকশিত হবে।
রাজনৈতিক দলেল নেতৃবৃন্দের প্রতি আমার আকুল আবেদন, আমাদের শিশুদের নিস্পাপ চেহারাগুলোর দিকে তাঁকিয়ে আপনারা দয়া করে রাজনীতি রাজনীতি খেলা বন্ধ করুন। গুম-হত্যার রাজনীতি বন্ধ করুন। না হয় আপনি তো চিরদিন বেঁচে থাকবেন না, আপনার জন্মভূমিকেই তার গ্লানি পোহাতে হবে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা এই দেশকে ভালবাসতে শিখুননা একবার।
বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান-আসুন, কৃষকের হাড়ভাঙা খাটুনি, প্রবাসীদের ঘামে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা, লক্ষ লক্ষ নদীভাঙা চিন্নমূল মানুষ, মায়ের পবিত্র মুখ আর শিশুদের নির্মল হাসির দিকে তাঁকিয়ে হলেও সকল প্রকার রাজনৈতিক হানাহানি দলাদলি-সংঘাত বন্ধ করা উচিৎ।
দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রযুক্তিগত উণœয়ণে আপনাদের মেধাকে কাজে লাগান। দেশ গড়ার কাজে ঝাপিয়ে পড়–ন। দেখবেন দেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে। তাহলেই কেবল আপনাদের রাজনীতিকে আমার সালাম এবং অভিনন্দন।
তাই সময় এসেছে এখন রাজনৈতিক সংঘাত বন্ধ করে সহনশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু করা।
জয় হোক দেশপ্রেমের, জয় হোক শুদ্ধ-সুষ্ঠু রাজনীতির। মনে রাখতে হবে সবার উপরে দেশ সত্য, এই দেশ ছাড়া আমাদের আর কোন ঠিকানা নেই। দেশকে নিয়েই আবর্তিত হোউক আমাদের সকল দুখ-দুঃখ আর চাওয়া-পাওয়ার কর্মকান্ড।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।