জীবনটা যদি স্বপ্ন হত, স্বপ্নভঙ্গ মানেই মৃত্যু । মন্দ হত না !!!! (গল্পটি ২০০৯ সালে কলেজ ম্যাগাজিন "তরুছায়া'' তে প্রকাশিত হয়েছিল । তখন আমি খুব একটা ভালো লিখতে পারতাম না । এখন যে অনেক ভালো লিখি সেটাও মনে করবেন না । )
শীতের রাত্রি ।
দুদিন থেকে শীতের প্রকোপটাও একটু বেশি । বিভা হোস্টেলের ছোট্ট একটি ঘরে থাকে আর বাইরে থেকে আসলে নিজের ঘরে প্রবেশ না করেই প্রথমে ঢেউ আপুর রুমে যায় । উনি অবশ্য কয়েকদিনের জন্য বাড়িতে গিয়েছিলেন, কিছুক্ষন আগেই হোস্টেলে ফিরেছেন । উনার ঘরে ঢুকতেই মন খারাপ করা একটা বিষণ্ণতা দোলা দিয়ে গেলো । ঢেউ আর বেলা চুপচাপ বসে আছে, ওদের দেখেই মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটেছে ।
কোন একটা কারনে বিভাকে সবাই খুব স্নেহ করে, ওকে দেখে দুজনের মুখেই শুষ্ক হাসি ফুটল তবে সেটা যে প্রাকৃতিক নয় তা বুঝতে বিভার সমস্যা হলনা । সে একটা হাসি দিয়ে বলল,
-এমন কেন আপু, কি হল আবার ?
- কিছুনা । তুই এই জায়গাটা ছেড়ে দে বিভা, এখানে থাকিস না ।
- হঠাৎ তুমি আমাকে তাড়াতে চাইছ কেন ?
- তোকে আর আমাদের ভালো লাগছেনা, তাই তাড়িয়ে দিচ্ছি । আপু একটু হাসার চেষ্টা করল ।
বিভা খুব ভালো করেই জানে এখানকার সবাই তাকে খুব ভালবাসে, তাড়িয়ে দেয়ার তো প্রশ্নই আসেনা । বিভা অনেক জোরাজোরি করল আসল কারণটি জানার জন্য কিন্তু কেউই মুখ খুলছেনা ।
বিভা তার বিছানার ওপর বসে পড়ল, এটা কেন হবে ? কি করবে এখন সে ? ঢেউ আপু যা বলছে তা যদি সত্যি হয় তবে এখানে থাকার প্রশ্নই আসেনা । বিভা ভেবেছিল তার যত কষ্ট সবই ফেলে এসেছে অতীতের মলাটে বাঁধা পুরনো বইটাতে কিন্তু ষষ্ঠদশ বর্ষীয়া এই তরুণীটি সবসময় খুব আপন করে পেয়েছিল কষ্টগুলোকেই । আজো ভোলে নি সে কথা, নতুন করে আবার ডানা মেলল সব কষ্টরা ।
তার জন্য বাড়ীওয়ালার কাছে চাঁদাবাজরা উড়োচিঠি দিয়েছে কিন্তু কেন ?
আজ আবার পুরনো কথা মনে পড়ছে, নিজেকে অভাগী ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছিলনা তার । মায়ের কাছে সে শুনেছিল বাবা তার জন্মের ৩ মাস পরেও তার মুখ দেখেননি । কে যেন বলেছিল মেয়েছেলে কালো হলে বাবার দাম থাকেনা । কিন্তু বিভা ছোটবেলায় এত সুন্দর একটা বাচ্চা ছিল যে তার বংশের কেউই তেমন ছিলনা এবং খুব ফর্সা ও ছিল । তবু বাবা এমন করতে পেরেছিল অন্যের কথায় কান দিয়ে ! ভাবতেই বুকটা টনটন করে ।
সেই সময়টার পরে বাবা অবশ্য তাকে খুব ভালবাসত । বিয়ের আগে বাবার একজন প্রেমিকা ছিলেন, বিয়ের পরেও তিনি তাকে ভোলেননি । সেই কারনেই হয়তো মাকে কখনো পুরোপুরি মন থেকে গ্রহন করতে পারতেন না । বাবার প্রাক্তন প্রেমিকা মা হতে গিয়ে মারা যান, সেই থেকেই আবার সব দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে দ্রুত । জীবিত পিতার স্নেহবঞ্চিত হয়ে শৈশব কৈশোর কেটেছে, কারো বিন্দুমাত্র সহানুভূতি পর্যন্ত সে পায়নি ।
একের পর এক মিথ্যে অপবাদের মধ্যে জড়িয়ে থাকতে হয়েছে । তবু সে বেঁচে আছে, বেঁচে তাকে থাকতেই হবে । মায়ের চোখের জল মুছে সে বলেছিল, “মা, তুমি কাঁদবে না কখনো, আমি তোমার সব কষ্ট ঘুচিয়ে দেবো । ’’ মা এখনো প্রতীক্ষায় তার মুখপানে চেয়ে আছেন । মাকে সে কিচ্ছু বলতে পারেনা, বড্ড বেশি চিন্তা করেন মা ।
কয়েকমাস আগে মৃণাল নামের এক ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, প্রেমও হয়েছিল । মাত্র আঠারো দিনের সম্পর্কে মৃণালের পুরনো প্রেমিকা বিভাকে জানায় তাদের সম্পর্কের কথা । অবচেতন মনে বিভা এখনো মৃণালের অপেক্ষায় থাকে । কোথায় যেন সে পড়েছিল ‘ভালোবাসার মানুষদের খুব কাছে যেতে হয়না । ’ প্রবোধ দেয় মনটাকে, চোখের জলই সঙ্গী সারাক্ষণ ।
পৃথিবীতে অশ্রু খুব মূল্যহীন ! হৃদয়ে কষ্টের যে নিখাদ বুনন, সে তো আর অশ্রু দিয়ে সিক্ত হবেনা ।
গন্তব্যহীন গন্তব্যে যে পথ তার তো কোন শেষ নেই । অসীম কষ্টে গড়া কষ্ট তিতির টা কি কোনদিনই উড়ে যাবেনা ? মায়ের স্বপ্নগুলো কি শুধু দুঃস্বপ্ন হয়েই প্রতিনিয়ত পায়ের তলে দুমড়ে মুচড়ে যাবে ? তার প্রিয় বাবাকি কখনো কপালে চুমু দিয়ে বলবেন না, ‘ইংরেজি টা ভালো করে পড়িস মা । ’ ক্রমশ স্বপ্ন দেখার দুচোখ অন্ধ হয়ে যাচ্ছে । এখন চোখে ভাসে জীবনের অন্তিম মুহূর্তটির কথা ।
শ্রাবণের কোন এক সন্ধ্যায় দমকা হাওয়ায় জীবন প্রদীপ টা দপ করে নিভে যাবে । কয়েকজনের কান্নায় সেদিনের দখিনা হাওয়া হয়তো ভারী হবে । প্রেমের শরৎকাল ঠিকই ফিরে ফিরে আসবে, রুপালি জোছনায় পৃথিবীটা স্নান করবে, শুধু বিভাবরী ই থাকবেনা কোথাও । কষ্ট তিতিরটাকে মুক্ত করে দেবে বিভা, তার ডাকাডাকি তে বিভাকে যেন আর কখনো কাঁদতে না হয় । তবে বিভার সমাধির স্মৃতি প্রস্তরে তিতিরটাকে পাহারায় রাখবে, এতদিনের সঙ্গীকে এক পলকে ছেড়ে যাওয়া উচিত হবেনা ।
- বিভা কাঁদছিস কেন ? ওমা সব জিনিসপত্র বাধাই শেষ !
বিভা আলতো করে ঢেউকে আঁকড়ে ধরল ।
- আপু, আমি কাল সকালে চলে যাচ্ছি ।
***************************************************************
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।