জলের মেয়ে জলে থাকো, স্থলে আমার বাস । তোমায় ভুলে মন দিয়েছি, তাই ভুলের সাথে বাস । রাত প্রায় এগারটা । সেই বিকেল থেকে বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে, বছরের প্রথম বৃষ্টি । এক বৃষ্টিতেই পুরো শহর ভাসিয়ে নেয়ার মত বৃষ্টি ।
এই বৃষ্টিতে চার যুবক দেড় লিটার চোলাই মদ আর ২৫ গ্রাম গাঁজা নিয়ে উৎসব করতে বসেছে ।
যেই ছেলেটা খাটের উপর শুয়ে আছে তার নাম আশিক, বিএ পাশ করে গার্মেন্টসের জূটের ব্যবসা করছে এখন । প্রতিদিন উৎসবের শুরুতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে আশিক, বীর বিক্রমে অল্প সময়ের মধ্যেই বেশখানিক মদ আর গাঁজা খেয়ে প্রতিদিনের মত সবার আগেই টাল হয়ে পড়ে থাকে সে । এই ঘরের অন্যতম বাসিন্দা সে ।
এই ঘরের আরও দুই বাসিন্দা এখন খুব সূক্ষ্ম কাজে ব্যস্ত ।
খাটের উপর বসে যেই ছেলেটা গাঁজা থেকে বিষপাতা আলাদা করছে তার নাম রনি । রনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সে পড়ছে । জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য সাথে নিয়ে প্রায় ৮ বছরের শেষে আর কিছুদিন পরেই সে একটা মহামুল্যবান কাগজের সার্টিফিকেট নিয়ে তার শিক্ষাজীবনের ইতি টানবে বলে আশা করা যায় । তবে তা নিয়ে রনির কোন ভাবনা নেই । গ্রামে বাপ দাদার যেই সম্পত্তি আছে তাতে সে সারাজীবন বসে বসে খেতে না পারলেও, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ খেতে পারবে ।
আর এই মাত্র কেচি কাটা শিল্প শেষ করে হাতের তালুতে গাঁজা নিয়ে দলাই মলাই শিল্প করতে শুরু করেছে যেই ছেলেটা -সে এই ঘরের সর্বশেষ বাসিন্দা, বাবু । বাবু পাবলিক এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করেছে । চাকরি খুজতে খুজতে না পেয়ে বাবু এখন আর চাকরির খোজ করে না ; দুপুর হলে আশিকের সাথে জুটের ব্যবসা করতে বেড়িয়ে যায় ।
প্রায় প্রতিরাতে এই তিনজন মুখে কিছু গুজে দিয়েই উৎসব করতে বসে । তবে তাদের সাথে উৎসবে আজ এক অতিথি এসে যোগ দিয়েছে ।
খাটের উপর বসে বসে যেই ছেলেটা এখনো একটু একটু করে মদ ঢেলে খাচ্ছে, সেই ছেলেটা রনির বন্ধু সাব্বির । ভালো ফ্যামিলির ছেলে, লেখাপড়ায় ভালো, সখের বশে মাঝে মধ্যে এটা সেটা খেতে খেতে অভ্যাসটা ভালোভাবেই জেকে বসে গেছে ছেলেটার উপর । রনির বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও আশিক,বাবু দুইজনকেই এই ছেলে আপনি করে বলে । এই ছেলের চোলাই মদ খেয়ে অভ্যাস নেই সেটা ভালই বোঝা যাচ্ছে ।
টাকা থাকলে কি আর এই সস্তার জিনিস কেউ খেতে চায় ? তিনজন মিলে যে টাকা হয় তাতে একদিন ভালো জিনিস খেলে বাকি সব গুলো দিন মুখ বেজার করে বসে থাকতে হয় ।
তার চেয়ে এই চোলাই মদ আর গাঁজাই ভালো । খেতে ভালো না হলেও, দামে সস্তা, তাই প্রতিদিনই খাওয়া যায় ।
কল্কিতে গাঁজা ভরতে ভরতে সৌজন্যবশত বাবু সাব্বিরকে জিজ্ঞেস করল," চোলাই মদ খেতে কষ্ট হচ্ছে ??? শরীর সাপোর্ট না করলে বাদ দেন । "
সাব্বির মদের গ্লাস মুখে নিতে নিতে বলল, "না না ঠিক আছে ?"
বাবু একটু হেসে গাঁজা ভরা কল্কিটাতে আগুন ধরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ।
কল্কিতে রনি একটান দিয়ে অনেকগুলো ধোঁয়া ছেড়ে সাব্বিরকে জিজ্ঞেস করল, "দোস্ত বঙ খায়া দেখছিস কখনো ???"
সাব্বির বলল, "বোতল ফুটা করে পানির ভিতর দিয়ে যে খায় ওইটা ??"
"হো দোস্ত, ওইটাই , গুড়ুক গুড়ুক শব্দ হয় সেইটা শুনতে খুব ভালো লাগে ।
তবে রিজলা, বঙ, স্টিক যত যাই বলিস কল্কির উপরে আর কিছু নাই", বলেই অকারণে নেশার কারণে হাসতে থাকে রনি ।
বমির গন্ধে নাড়ি ভুঁড়ি সব উল্টে আসতে চায় সাব্বিরের ।
আশিক মদ খেয়ে একটু পর পর বমি করে ঘরের পুরো মেঝে ভাসিয়ে দিচ্ছে । ভাসিয়ে দিয়েই আবার বেহুশ হয়ে পড়ছে । সাব্বির আশিককে দেখিয়ে বাবুকে জিজ্ঞেস করল," উনি তো বেহুশ হয়ে পড়ে আছে ।
এভাবেই পড়ে থাকবে নাকি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন ???"
বাবু হেসে বলল, "ওই শালা প্রতিদিনই এমন করে । শালা ভালো আছে । "
আশিক যে ভালো আছে তা সাব্বিরকে দেখাতে বাবু আশিক কে জিজ্ঞেস করল, "কিরে কষ্ট হচ্ছে নাকি ?"
আশিক শুয়ে থেকেই বলল, "নারে দোস্ত আমি ভালো আছি ..একদম ঠিক আছি,,. আমি মাতাল হই নাই তো । এইতো আমি তোরে চিনতে পারতাছি, তুই বাবু, আর ওই যে আমাদের আজকের চিফ গেস্ট সাব্বির । সাব্বির কেমন আছো ? "
বলেই গা দুলিয়ে হাসতে থাকে আশিক ।
বাবু সাব্বিরের দিকে তাকিয়ে বলল," দেখলেন ? ও ভালোই আছে । আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে নাকি ? কেমন করে যেন কাঁপছেন আপনি । "
বাবুর কাছ থেকে কল্কিটা নিয়ে তাতে একটান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে গিয়ে কাশতে শুরু করল সাব্বির ।
সাব্বিরের পিঠে হাত দিয়ে কাশি থামিয়ে কল্কিতে টান দিয়েই সাব্বিরকে গালি দিয়ে উঠল রনি, "ওই শালা, *** ভাই ,আগুন তো নিভায়ে ফেলছোস । ওই বাবু, একটু আগুন ধরায়ে দে তো ।
"
আরামসে কল্কিটাতে টান দিয়ে আবার বক বক করতে শুরু করল রনি," ওইদিন দোস্ত ড্যান্ডী খায়া তো আমি পুরাই ** ।
পুরাই ইনসেপশন মুভির মত ড্রিম ইন আ ড্রিম । দেখলাম কি আমি পাখি হয়া গেছি, তারপর আমি আবার আরেক ছাদে বসা এক পাখিরে নিয়া ঘর সংসারের স্বপ্ন দেইখা ফালাইলাম । পুরাই গায়েবি ব্যাপার স্যাপার । তবে পলিথিনটা মুখের মধ্যে লাইগা আঠাটা নাকে মুখে লাগলে চরম বিরক্ত লাগে, তবে একটা টেকনিক আছে..."
কথা শেষ করতে পারেনা রনি, দেখে সাব্বির বমি করতে শুরু করেছে ।
বমির সাথে গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে সাব্বিরের মুখ থেকে ।
সি এন জি না পেয়ে রিকশাতেই সাব্বির কে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দিয়েছে বাবু আর রনি । রক্ত বমিতে সাড়া শরীর ভিজে যাচ্ছে বাবুর । বাবুর সেদিকে খেয়াল নেই । সে রিকশাওয়ালাকে শুধু বার বার বলছে, তাড়াতাড়ি মামা তাড়াতাড়ি ।
বাবু বুঝতে পারছে সাব্বির মারা যাচ্ছে । সাব্বিরকে কোলে রেখেই বাবু মনে মনে শপথ করে ফেলল সে আর কোনোদিন নেশা করবে না, কোনোদিন না । এভাবে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবার কোন মানে হয় না ।
সাব্বির মারা গিয়েছে প্রায় একমাস । এই একমাস আর কোন নেশা করেনি আশিক, বাবু, রনি ।
তবে কি একটা মৃত্যু তাদেরকে বদলে দিল ? একজন মানুষ তার নিজের জীবনের মূল্য দিয়ে তাদেরকে জীবনের মূল্য শিখিয়ে দিয়ে গেল ?
গল্পটা এখানে শেষ হলেই হয়তো ভাল হত । কিন্তু এখানেই গল্পের শেষ না । এই গল্পের কখনো শেষ হয় না ।
আজকেও বাইরে সেদিনের মত ঝুম বৃষ্টি । চারজন যুবক দেড় লিটার চোলাই মদ আর ২৫ গ্রাম গাঁজা নিয়ে ছোট্ট ঘরটাতে আজ আবার উৎসব করতে বসেছে ।
সাব্বিরের বদলে আজ এসেছে রনির আরেক বন্ধু ।
কি আশ্চর্য !
যেভাবেই হোক প্রকৃতি যেন কিভাবে কিভাবে শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলে ।
প্রকৃতি কেন যেন শূন্যস্থান পছন্দ করে না ।
অবশ্য শূন্যস্থান আমারও পছন্দ না । হাহ্ হাহ্ হা ।
******************
পুনশ্চ :
আমি বিশ্বাস করি মানুষ কোন প্রকার নেশা বা লোভ ছাড়া কখনোই বাঁচতে পারে না ।
আমরা সবাই আসলে আসক্ত মানে লোভী ।
শুনতে খারাপ লাগছে শব্দটা ?
আচ্ছা ব্যাখ্যা করে বোঝাচ্ছি ব্যাপারটা ।
কারও লোভ জ্ঞানের, কারও লোভ ক্ষমতার, কারও লোভ ভোগের, কারও লোভ আবার মাদকের ।
আর কিছু মানুষের লোভ শুধুই বেঁচে থাকা ।
আসলে নির্লোভ বলতে কোন শব্দ বাস্তবে ( প্রায়োগিক অর্থে ) নেই ।
আমি মনে করি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নেশা/লোভ হচ্ছে জীবনের নেশা, বেঁচে থাকার নেশা ।
তাই সবার প্রতি অনুরোধ আসুন আমরা সব তুচ্ছ ঠুনকো বস্তুনির্ভর নেশা ছেড়ে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে ফিরি, আসুন জীবনের মাদকতায় আচ্ছন্ন হই সবাই । :-)
গল্পে কিছু বাজে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে , অনেক পাঠকের কাছে ব্যাপারটা ভাল লাগবে না । কিন্তু গল্পের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করার জন্যেই শব্দ গুলো ব্যবহার করতে হয়েছে ।
মাফ করবেন ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।