সবার আগে দেশ -Country at First-
আমার চিন্তায় মনে হয় পচন ধরেছে । আমার আশপাশে ঘটমান নৈমিত্তিক ব্যাপারগুলো যখন অন্যদের কাছে স্বাভাবিক লাগে, ঠিক ঐ ব্যাপারগুলো আমাকে ভেতরে ভেতরে অনেক কষ্ট দেয় । আবার আমার কাছে যা একান্ত স্বাভাবিক তা নিয়ে অন্যদের অসন্তোষের শেষ নেয় ।
যেমন আমার বন্ধুমহলের বেশির ভাগ যখন ক্রিকেট খেলায় পাকিস্তান বা ভারতের ঘোর সমর্থক হিসাবে হাততালি দেয়, তখন বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দলের সমর্থক হওয়া যায় এ চিন্তাও আমার মাথায় আসে না । আবার ধরুন বন্ধুমহলের পনের আনায় তাদের নাম স্বাক্ষর করে বিদেশী ভাষায়, কিন্তু আমি বাংলা’র বিকল্প বা সমকক্ষ অন্য কোন ভাষা খুঁজে পাই না ।
আবার বাংলা ভাষায় প্রণীত ‘শ্রম আইন’ এর পাঠ আমাদের আইন শিক্ষা ক্লাসে যখন ইংরেজি তরজমা করে পড়ানো হয় তখন আমার পেটের ভেতর গুলিয়ে ওঠে, বমি আসার উপক্রম হয় । কিংবা দেশীয় বিজ্ঞাপন ও প্রচার মাধ্যমে বিদেশী মডেলদের উপস্থিতিকে আমার বন্ধুরা যখন বিশ্বায়নের প্রভাব বলে যুক্তি দেখায়, আমার মন তখন বাদামী চামড়ার দেশি মডেলদের জন্য আফসোসে ভরে উঠে ।
আমার এমনসব আচরণে আমার বন্ধুরা যারপরনাই বিরক্ত । কারও কারও কল্যাণে ইতোমধ্যে আমার গায়ে উগ্র দেশপ্রেমিক এর তকমা লেগে গেছে । আমার এ সকল কাজের জবাব যুক্তিসহ দেওয়া প্রয়োজন ।
তবে আজ শুধু ‘বাংলা’ ভাষায় স্বাক্ষর করা প্রসঙ্গে কিছু বলব ।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন শুরুর দিকে জনাব লর্ড ম্যাকুলে, এখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপেক্ষিতে, কিভাবে এদেশের মাটিতে দীর্ঘমেয়াদী ইংরেজ শাসন বলবৎ রাখা যায় সে সম্পর্কে একটা প্রতিবেদন ব্রিটিশ রাজের কাছে জমা দেন । সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, “আমি বহুদিন ধরে বাংলার গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে দেখলাম, কিন্তু এখানকার কোন মানুষকে ভিক্ষা করতে দেখি নি । এদেশের মানুষের মূল্যবোধ ও নিজস্ব সংস্কৃতির মূল এতটায় গভীরে যে সেগুলোকে যদি কোনভাবে দূষিত করা না যায় তবে ইংরেজ শাসন এদেশে বেশিদিন চালানো কারও পক্ষেই সম্ভব হবে না । ” লর্ড ম্যাকুলে আরও বলেছিলেন, “ইংরেজ রাজের উচিত হবে এমন আধুনিক বাঙালি সমাজ তৈরি করা যারা দেখতে হবে পুরোপুরি বাঙালি কিন্তু চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ-সংস্কৃতিতে যাদের ভেতরটা হবে শতভাগ ব্রিটিশ ।
”
সেই থেকে শুরু, আর এখন অবধি চলছে । তাই এখনও এদেশের মানুষ ইংরেজি ভাষা জানাটাই শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য মনে করে । হায় রে ! ! আচ্ছা, আমেরিকা বা ইংল্যান্ড এর সরকার প্রধান কিংবা সে দেশের আমলারা কোন ভাষায় নিজের নাম স্বাক্ষর করেন, বলুন দেখি ? অবশ্যই তাদের মাতৃভাষায়, তাই না ? ঠিক তেমনি আমাদের সরকার প্রধান কিংবা আমলারাও কিন্তু বাংলা ভাষায় তাদের নাম স্বাক্ষর করেন । দৈনিক পত্রিকাগুলোতে বিশেষ বিশেষ দিনে সরকারী যে প্রজ্ঞাপন বের হয় সেগুলোর যে কোন একটা দেখলেই আপনি পরিষ্কার বুঝতে পারবেন । অথচ আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছি বা করে বের হয়ে গেছি তারা মাতৃভাষায় নিজেদের পরিচয় পত্র বানাতে, ভিজিটিং কার্ড ছাপাতে বা নাম স্বাক্ষর করতে সীমাহীন হীনমন্যতায় ভুগী ।
কেউ কেউ আবার অন্ধের মতো আওয়াজ তুলি যে, এসব করা ছাড়া আধুনিক হওয়া যায় না, উন্নয়ন আশা করা যায় না । আমার এক বন্ধু তো একদিন বলেই ফেললেন যে বাংলা ভাষায় এসব করলে কেমন খ্যাত খ্যাত লাগে ! ! এমনক্ষেত্রে আর কি বলার থাকতে পারে ? ? সেরকম তির্যক তুলনা করলে তো আমাদের নিজেদের বা আমাদের বাবা মায়ের নামগুলোই সবচেয়ে খ্যাত খ্যাত লাগার কথা ! !
আমি জন্মসূত্রে বাংলাদেশী । আর বাংলা আমার মাতৃভাষা । অন্য দেশের মানুষ তাদের মায়ের ভাষায় যা যা করে আমি ও বাংলা ভাষায় তাই তাই করতে চাই । শুনে হয়ত কেউ কেউ বলবেন আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে, বলুন তাতে আমার আপত্তি নেই ।
কিন্তু আপনাকে অনুরোধ করছি বড় আয়নায় একবার নিজেকে দেখুন তো- বাদামী চামড়া, আর বাঙালি মত দেহে আপনাকে নিশ্চয় খ্যাত খ্যাত লাগে না । । । ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।